কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দাম নির্ধারণ ও ঘোষণায় বিভ্রান্ত হয়েছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। ফলে এবার কোরবানির পশুর চামড়ায় ধস নেমেছে। এতে দেশের কোথাও কোথাও কয়েক হাজার পশুর চামড়া ময়লার ভাগাড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে এটি অপপ্রচার।
তৃণমূল পর্যায়ে মাদরাসাগুলোতে লবণ সরবরাহ করায় অন্য বছরের তুলনায় দামও বেশি পেয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, লবণসহ এবং লবণ ছাড়া চামড়ার দাম ভিন্ন হয়। সরকার শুধু লবণযুক্ত চামড়ার দামের কথা বললেও লবণ ছাড়া চামড়ার দাম নিয়ে কোনো ঘোষণা না দেওয়ায় মৌসুমি ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। ফলে অনেক চামড়া ব্যবসায়ী কাঙ্ক্ষিত দাম পাননি।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মুক্তবাজার অর্থনীতিতে দাম নির্ধারণ করা এমনিতেই ঠিক নয়। বাজারকে নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হয়। সরকার চামড়ার দাম নির্ধারণ করায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। ফলে লাভ-লোকসান বিবেচনায় না নিয়ে সরকারি দামে চামড়া কিনতে গিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়েছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।
পরে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন লবণ ছাড়া চামড়ার দাম ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা নির্ধারণ করলেও তা গুরুত্ব পায়নি।’
বিটিএর তথ্যানুসারে, গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ট্যানারিগুলো পাঁচ লাখ চামড়া সংগ্রহ করেছে। আরো দুই লাখের মতো সাভারের ট্যানারি পল্লীসংলগ্ন বাজারে আছে। রাজধানীর বাইরের চামড়া কয়েক দিনের মধ্যে আসা শুরু করবে। এবার কোরবানির মৌসুমে ৮০ থেকে ৮৫ লাখ চামড়া সংগ্রহ হবে বলে মন করছেন সংগঠনের নেতারা।
এদিকে বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘লবণ ছাড়া চামড়ার দাম নির্ধারণ হয় না। এবারও লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া এক কোটি চামড়ার মধ্যে চট্টগ্রামে ৬২০ পিস চামড়া নষ্ট হয়েছে। সেই গল্প বড় করে দেখানো হচ্ছে। কারণ ট্যানারি মালিকরা চান না তাঁরা বেশি দামে চামড়া কিনুন।’
তিনি বলেন, ‘কোরবানির চামড়া সংরক্ষণে এবার এতিমখানা ও মাদরাসায় সরকারের পক্ষ থেকে লবণ সরবরাহ করা হয়েছে। ফলে রাজধানীর বাইরে বিপুল চামড়া সংরক্ষিত হয়েছে। কমপক্ষে আগামী তিন মাস দর-কষাকষির সুয়োগ তৈরি হয়েছে। এর ফলে নায্য দাম নিশ্চত হবে। ব্যবসায়ীরাও ভালো দাম পাবেন।’
চট্টগ্রাম প্রতিনিধি জানান, চট্টগ্রামে উপযুক্ত দাম না পেয়ে ১৫ হাজার চামড়া ময়লার ভাগাড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এবারও চট্টগ্রামে চামড়ার মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে ৭০০-৮০০ টাকায় প্রতি পিস চামড়া কিনে শহরে এনে ৫০০ টাকার বেশি বিক্রি করতে পারেননি। ক্ষেত্রবিশেষে ২০০ কিংবা ৩০০ টাকা বিক্রি করতে হয়েছে। আবার অনেক আড়তদার তাঁদের কাছ থেকে চামড়া কেনেননি। এ জন্য মৌসুমি ব্যবসায়ীদের চামড়া সংরক্ষণের কৌশল না জানাকে দায়ী করছেন চামড়ার আড়তদাররা। আবার গরমের কারণে পচন ধরেছিল কিছু চামড়ায়। ফলে এবারও প্রায় ১৫ হাজার পশুর চামড়ার ঠিকানা হয়েছে সিটি করপোরেশনের ময়লার ভাগাড়। উপজেলা পর্যায়ে ফটিকছড়িতে হালদা নদীর শাখা খালে প্রায় ৭০০ চামড়া ফেলার ঘটনায় মামলা হয়েছে।
মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বলছেন, আড়তদারদের কাছে জিম্মি হয়ে কম দামে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন তাঁরা। অন্যদিকে আড়তদাররা বলেছেন, সরকারিভাবে লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হলেও কাঁচা চামড়ার নির্ধারিত দাম না থাকায় মৌসুমি ব্যবসায়ীরা না জেনে বেশি দামে মানহীন চামড়া কিনে কাঙ্ক্ষিত দাম পাননি।
ট্যানারি মালিকরা বলছেন, বাংলাদেশে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিক্রির জন্য সুসংগঠিত বাজার নেই। কোরবানির সময় হঠাৎ প্রচুর চামড়া বাজারে আসে, কিন্তু তা যথাযথভাবে সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করার মতো অবকাঠামো না থাকায় চাহিদা কমছে। এ ছাড়া সাভারের ট্যানারিপল্লী পরিপূর্ণভাবে কার্যকর না হওয়ায় প্রক্রিয়াকরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক ট্যানারি এখনো পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিতে রূপান্তর করতে পারেনি। ফলে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা আগ্রহ হারাচ্ছে। ভারত, চীন, ভিয়েতনাম—এসব দেশ কম খরচে চামড়া সরবরাহ করায় প্রতিযোগিতা বাড়ছে।
যশোর প্রতিনিধি জানান, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় চামড়ার মোকাম যশোরের রাজারহাটে ঈদ-পরবর্তী প্রথম হাট বসে গত মঙ্গলবার। তবে হাটে কাঙ্ক্ষিত চামড়ার সরবরাহ যেমন ছিল না, তেমনি ছিল না আশানুরূপ ক্রেতা বা দাম। ফলে হতাশ হয়েছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।
তাঁদের অভিযোগ, সরকার যে দাম নির্ধারণ করেছে, সে অনুযায়ী তাঁরা মাঠ পর্যায়ে তুলনামূলক বেশি দামে চামড়া কিনেছেন। কিন্তু হাটে এসে আড়তদারদের কাছ থেকে তাঁরা সেই মূল্যের আশপাশেও দাম পাচ্ছেন না। প্রতি পিস চামড়া ৮০০-৯০০ টাকায় কিনলেও বাজারে ৭৫০-৮০০ টাকা বলছে। ফলে অনেকেই চামড়া হাটে না তুলে গুদামে মজুদ করে রেখেছেন। তাঁরা অপেক্ষা করছেন শনিবারের মূল হাটের জন্য।
নাটোরে চামড়ায় সরকার নির্ধারিত দাম না পাওয়ার অভিযোগ উঠেছে বলে জানিয়েছেন কালের কণ্ঠের নাটোর প্রতিনিধি। তিনি জানান, নাটোরে চামড়ার আড়তগুলোতে এখন চলছে নীরবতা। তারা অপেক্ষা করছে দেশের দক্ষিণ ও উত্তারঞ্চলের জেলাগুলো থেকে চামড়া আসার। মূলত এসব জেলা থেকে চামড়া ব্যবসায়ীরা নাটোরের আড়তগুলোতে লবণ ও চুন প্রক্রিয়াজাত চামড়া নিয়ে আসেন। ট্যানারি মালিক বা তাঁদের প্রতিনিধিরা এখান থেকে চামড়া কিনে নিয়ে যান।
নাটোর চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হালিম বলেন, আগামী সপ্তাহ থেকে তাঁরা চামড়া আসার জন্য অপেক্ষা করছেন। তবে ঈদের দিন এবং ঈদের পরের দিন স্থানীয়ভাবে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক কম দামে চামড়া কেনার অভিযোগ উঠেছে। চামড়া নিয়ে আড়তে এসে বিপাকে পড়েছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীসহ মাদরাসা শিক্ষক ও বিক্রি করতে আসা সাধারণ ব্যবসায়ীরা। অনেক চামড়া লবণ না দেওয়ার কারণে পচন ধরে নষ্ট হয়েছে। তবে আড়তদারদের দাবি, মান অনুযায়ী সরকার নির্ধারিত দামেই চামড়া কিনছেন তাঁরা।
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন চট্টগ্রাম, সাভার, যশোর, ও নাটোর প্রতিনিধি]