মেহেরপুর শহরের বোসপাড়ার বাড়িটিতে যেন রাত নামত না। বাড়ির সামনের খোলা জায়গায় সারি সারি গাড়ির ভিড় লেগেই থাকত। দলের, সমাজের নানা অপকর্ম, বদলি-পদায়নের তদবির ও দেনদরবারের জন্য লোকজন আসত। আগত লোকজনের ভিড়ে বোঝাই যেত না বাইরে রাতের অন্ধকার না দিনের আলো ফুটছে।
রাত নামত না ফরহাদ রাজ্যে
ইয়াদুল মোমিন, মেহেরপুর

ওই বাড়িতে হাজিরা না দিলে মন্ত্রীর আস্থাভাজন হওয়া যেত না। জেলা, পুলিশ প্রশাসনসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অফিসের কর্মচারীরাও হাজিরা দিতেন।
গত ৫ আগস্ট দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর পালিয়ে যাওয়ার পর মেহেরপুরের ওই বাড়িতেও নেমে আসে দুনিয়ার তাবৎ নীরবতা।
ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করতেন ভগ্নিপতি : মেহেরপুরের বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের উন্নয়নকাজের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করতেন ফরহাদের ভগ্নিপতি আব্দুস সামাদ বাবলু বিশ্বাস ও ভাই সরফরাজ হোসেন মৃদুল। মূলত অন্যদের প্রতিষ্ঠানের নামে কাজ নিয়ে বাবলু তা নিয়ন্ত্রণ করতেন। ২০২৩ সালের ২০ অক্টোবর সরফরাজ হোসেনের বিরুদ্ধে এক কোটি ৮০ লাখ টাকার চেক প্রত্যাখ্যানের (ডিজঅনার) মামলা করেন দেবাশীষ বাগচি নামের এক ব্যক্তি। মামলায় গত ২৩ ফেব্রুয়ারি মেহেরপুর অর্থঋণ আদালতের বিচারক ফরহাদের ছোট ভাই সরফরাজ হোসেন মৃদুলের এক বছর জেল, তিন কোটি ৬০ লাখ টাকা জরিমানা করে রায় দেন। আদেশে বলা হয়, তিন কোটি ৬০ লাখ টাকা জরিমানার এক কোটি ৮০ লাখ টাকা বাদীকে এবং এক কোটি ৮০ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে। বাদী দেবাশীষ বাগচি মৃদুলের ব্যবসায়ী অংশীদার ছিলেন।
দেবাশীষ বলেন, ২০১৫ সাল থেকে তিনি সরফরাজের সঙ্গে যৌথভাবে ঠিকাদারি ব্যবসা শুরু করেছিলেন। ২০২০ সাল পর্যন্ত গণপূর্ত, জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা প্রকৌশল, এলজিইডিসহ বিভিন্ন সংস্থার ৩৫টি দরপত্র সরফরাজ প্রভাব খাটিয়ে বাগিয়ে নেন। এর আনুমানিক মূল্য ছিল প্রায় ২৭ কোটি টাকা। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে সরফরাজ দেবাশীষকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দেন। পাওনা টাকা বাবদ গত বছরের ১২ জুলাই এক কোটি ৮০ লাখ টাকার চেক দেন। কিন্তু টাকা উত্তোলন করতে গেলে দেবাশীষ দেখেন, ব্যাংক হিসাবে কোনো টাকা নেই। পরে আদালতে মামলা করেন তিনি।
দাপুটে ভাই-ভগ্নিপতি-ভাগ্নি : আব্দুস সামাদ বাবলু বিশ্বাস ফরহাদের ভগ্নিপতি। তিনি পিরোজপুর ইউপির চেয়ারম্যান। মন্ত্রীর ভগ্নিপতি হওয়ায় বাবলুর বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে সাহস করত না। ১০ বছর পিরোজপুর ইউনিয়নের দাদ বিল তিনি দখলে রেখেছিলেন। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে বিভিন্ন ভাতা ও সরকারি সুবিধা দিতে তিনি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিতেন। গত ৫ আগস্টের পর স্থানীয়রা বাবলুর বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে। দীর্ঘদিন আত্মগোপনে ছিলেন। পরে ঢাকার ভাটারা থেকে পুলিশের কাছে ধরা পড়েন।
মেহেরপুর সরকারি বালিকা ও বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে দুটি ছয়তলাবিশিষ্ট একাডেমি ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। প্রতিটি ভবন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ছয় কোটি টাকা। বালিকা বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণের ঠিকাদার বাবলু, বালক বিদ্যালয়ের কাজের ঠিকাদার সরফরাজ। পাশাপাশি অবস্থিত বিদ্যালয় দুটির শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকরা অভিযোগ করছিলেন, ঠিকাদারদের লোকজন বিদ্যালয়ের খেলার মাঠ দখল করে ভবনের নির্মাণসামগ্রী রেখেছিলেন। এগুলো সরিয়ে মাঠ পরিষ্কার রাখার কথা বলার সাহস তাঁরা করেননি। তবে ৫ আগস্টের পর মাঠ পরিষ্কার করা হয়েছে।
গত ২৯ আগস্ট মেহেরপুর শহরের ক্যাশবপাড়ায় ফরহাদ হোসেনের ফুফাতো ভাই শাজাহান সিরাজের ভাড়া বাড়ি থেকে কোটি টাকা মূল্যের বিপুল সরকারি মালামাল জব্দ করে যৌথ বাহিনী। এর মধ্যে ছিল বিনামূল্যে বিতরণের কোরআন শরিফ, কম্বল, বিভিন্ন ধরনের ক্রীড়াসামগ্রী, সেলাই মেশিন, হুইলচেয়ার, চিকিৎসকের অ্যাপ্রোন, পিইপি, শাড়ি, লুঙ্গি, থ্রিপিস, অক্সিজেন সিলিন্ডার। ছিল শিক্ষার্থীদের টিফিন বক্সও।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন (অব.) আব্দুল মালেক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ফরহাদ ক্ষমতার প্রভাবে তাঁর বড় ভাই শহিদ সাদিক হোসেন বাবুলসহ কয়েকজন আত্মীয়কে দিয়ে ৬৯ জনের কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছিলেন। ৬৯ জনের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে তাঁদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ক তালিকাভুক্ত করেছিলেন। আমরা কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবাদ করে সেই তালিকা বাতিল করিয়েছি। এ জন্য নানাভাবে আমাদের হয়রানি ও হুমকি দেওয়া হয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘কারো কাছ থেকে দুই লাখ, কারো কাছ থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নিয়েছেন তিনি।’
ফরহাদের ভাগ্নে সাবেক ছাত্রনেতা ও ব্যবসায়ী নেতা আমিনুল ইসলাম খোকনও ছিলেন আরেক ত্রাস। তাঁর বড়বাজারের কার্যালয়ে বসত সালিস। কোনো কাজ করাতে তাঁর সুপারিশ লাগত। হাসপাতাল, সমাজসেবা, ব্যবসা ক্ষেত্রে সুপারিশ তদবির চলত তাঁর হুকুমে।
ফরহাদ, তাঁর স্ত্রী শীলা, ভাই সরফরাজ হোসেন মৃদুল, ভগ্নিপতি আব্দুস সামাদ বাবুল বিশ্বাস কারাগারে আছেন। ভাগ্নে খোকন আত্মগোপনে রয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তাঁদের ঘনিষ্ঠ অনেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
সম্পর্কিত খবর

তিস্তার বুকে জেগে ওঠা চরে পাট চাষ

তিস্তার বুকে জেগে ওঠা চরে করা হয়েছে পাট চাষ। সেই পাট কেটে মহিষের গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পানিতে জাগ দেওয়ার জন্য। গতকাল রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার মর্নেয়া ইউনিয়নের চর বাঘমারা থেকে তোলা। ছবি : মো. আসাদুজ্জামান
।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী মুগদা হাসপাতালে

খিলগাঁওয়ের সিপাহীবাগ এলাকার আড়াই বছর বয়সী নূরজাহান ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মুগদা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। গতকাল তোলা। ছবি : মঞ্জুরুল করিম
।
২২৩ আসনে প্রার্থী ঘোষণা খেলাফত মজলিসের
নিজস্ব প্রতিবেদক

আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২২৩টি আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর পুরানা পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন দলটির আমির মাওলানা মুহাম্মদ মামুনুল হক।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দলটি আগামী জাতীয় সংসদে নিম্নকক্ষে আংশিক আনুপাতিক ও উচ্চকক্ষে পূর্ণ আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক দ্বিকক্ষীয় সাংবিধানিক কাঠামোর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। দলের নেতারা বলেন, একদলীয় শাসনব্যবস্থা জনগণের প্রকৃত মতামতের প্রতিফলন ঘটাতে ব্যর্থ।
মাওলানা মামুনুল হক বলেন, ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তিগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আক্রমণাত্মক বক্তব্য দেওয়া আত্মঘাতী। এতে ফ্যাসিবাদের দোসররা আরো উৎসাহী হচ্ছে। আমরা সবাই যদি ঐক্যবদ্ধ না হই, তবে ফ্যাসিবাদ ফের মাথা চাড়া দেবে।
গোপালগঞ্জে এনসিপির কর্মসূচিতে হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রথমে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী শৈথিল্য দেখালেও পরে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে দুষ্কৃতকারীরা দ্রুত প্রতিহত হয়েছে, যা প্রশংসনীয়। হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।’
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন—দলের সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা ইউসুফ আশরাফ, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আতাউল্লাহ আমীন ও মাওলানা তোফাজ্জল হোসাইন মিয়াজি, সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা এনামুল হক মূসা, মাওলানা আবুল হাসানাত জালালী, মাওলানা ফয়সাল আহমদ। এ ছাড়া ছিলেন মাওলানা ফজলুর রহমান, মাওলানা হারুনুর রশীদ, মাওলানা রুহুল আমীন খান, মাওলানা হাসান জুনাইদ, মাওলানা আব্দুস সোবহান, মাওলানা ছানাউল্লাহ আমিনী, মাওলানা জয়নুল আবেদীন ও মাওলানা মুহসিন বেলালী।

রামেকে ইন্টার্ননির্ভর চিকিৎসায় ঝুঁকিতে মুমূর্ষু রোগীরা
রফিকুল ইসলাম, রাজশাহী

পাবনার ঈশ্বরদী এলাকার ওয়াহেদুজ্জামান (৭১) জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে পরিবারের সদস্যরা গত ১৩ জুলাই সন্ধ্যার দিকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসে। রোগীকে জরুরি বিভাগ থেকে পাঠানো হয় ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে (মেডিসিন ওয়ার্ড)। ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়ার পরে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা তাঁকে ভর্তি করে নেন।
পরের দিন ১৫ জুলাই সকালের দিকে রোগী কিছুটা সুস্থ বোধ করলে তাঁকে ছুটি দেওয়ার কথা জানিয়ে দেন চিকিৎসকরা। কিন্তু দুপুর গড়াতে না গড়াতেই রোগী আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন।
এটি রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রতিদিনের চিত্র। চিকিৎসকসংকটে দিনের প্রায় ১৮ ঘণ্টাই ইন্টার্ন চিকিৎসকনির্ভরতার মাধ্যমে চলছে এই হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা।
খুব জরুরি প্রয়োজনে ফোনে পরামর্শ নেওয়া হয় অভিজ্ঞ ডাক্তারদের। এর বাইরে এফসিপিএস ডিগ্রিধারী বা এফসিপিএস করছেন এমন মধ্যম মানের চিকিৎসকরা থাকেন ভর্তির দিন ধার্য থাকা ওয়ার্ডগুলোতে। এ ছাড়া দিনের ২৪ ঘণ্টা প্রতিটি ওয়ার্ডেই চার থেকে ছয়জন করে পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করতে হয় ইন্টার্ন চিকিৎসকদের। এ নিয়ে মাঝেমধ্যেই ইন্টার্নদের সঙ্গে রোগীর স্বজনদের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে।
পাবনার ঈশ্বদীর রোগী ওয়াহেদুজ্জামানের ছেলে হামিম আবেদীন বলেন, ‘রামেকে অভিজ্ঞ চিকিৎসক দিনে একবার করে আসার কারণে আমার বাবার সমস্যাগুলো জটিল হয়ে গিয়েছিল, যা ইন্টার্ন চিকিৎসকরা বুঝে উঠতে পারেননি।’
ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি আব্দুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করি রোগীর সেবা দেওয়ার। কিন্তু যে পরিমাণ রোগীকে চিকিৎসা দিতে হয়, সে পরিমাণ ইন্টার্ন চিকিৎসকও নেই।’
রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহমেদ বলেন, ‘হাসপাতালে পর্যাপ্ত আনসার সদস্যও নেই। অন্যদিকে যেসংখ্যক রোগী ভর্তি হচ্ছে, সেসংখ্যক অভিজ্ঞ চিকিৎসক, নার্স, চিকিৎসাসামগ্রী ও ওষুধপথ্যও আমরা দিতে পারছি না। কারণ সব কিছু বরাদ্দ হচ্ছে ৫০০ শয্যার বিপরীতে। কিন্তু এখানে শয্যাই আছে এক হাজার ২০০টি। এর বাইরেও অতিরিক্ত আরো দুই থেকে আড়াই হাজার রোগীকে চিকিৎসা দিতে গিয়ে আমাদের নানাভাবে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।’