ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের এক টেবিলে বসে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে খাবার খাওয়ানো ‘জাতিকে নিয়ে মসকরা’ বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর ‘লাইভ রাউন্ড’ (তাজা গুলি) ব্যবহার না করার নির্দেশনা চাওয়ার রিটের শুনানিতে গতকাল সোমবার হাইকোর্ট এ মন্তব্য করেন।
বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসাইন দোলনের বেঞ্চে রিটটির শুনানি চলছিল। শুনানির এক পর্যায়ে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ডিবি হেফাজতে নেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়কের বিষয়ে বলেন, ‘টিভিতে আমরা দেখেছি, ডিবি অফিসে এই ছয়জন কাঁটাচামচ দিয়ে খাচ্ছে।
’ তখন আদালত বলেন, ‘এগুলো করতে আপনাকে কে বলেছে? কেউ বলেনি। কেন করছেন এগুলো? জাতিকে নিয়ে মসকরা কইরেন না।’
দেশের বিভিন্ন জায়গায় কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর সরাসরি লাইভ রাউন্ড (তাজা গুলি) ব্যবহার না করার নির্দেশনা চেয়ে রিট আবেদন করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মানজুর-আল-মতিন এবং আইনুন্নাহার সিদ্দিকা। রিটে নিরাপত্তার কথা বলে হেফাজতে নেওয়া সমন্বয়কদের দ্রুত মুক্তির নির্দেশনাও চাওয়া হয়।
আইনসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান, পুলিশের মহাপরিচালক, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর প্রধানকে বিবাদী করা হয়েছে রিটে। এতে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সরাসরি তাজা গুলির ব্যবহার কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না এবং তাজা গুলি ব্যবহার না করার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা জানাতে বিবাদীদের প্রতি রুল জারির আরজি জানানো হয়েছে।
রিটের শুনানির শুরুতেই আবেদনকারী আইনজীবী মানজুর-আল-মতিন বলেন, আন্দোলনকারীদের ওপরে অবাধে গুলি ছোড়া হয়েছে। বিবিসি, আলজাজিরাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের ভিডিও ফুটেজ আছে।
আন্দোলনকারীদের হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ১৪৭ জনের মুত্যুর কথা বলেছেন।
হাইকোর্ট তখন বলেন, অনেক বিদেশি মিডিয়া নিউজ বিকৃত করে থাকে। সুতরাং ওই সব নিউজ অকাট্য ধরে নেওয়ার সুযোগ নেই।
আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে ডিবি হেফাজতে নেওয়ার বিষয়ে আইনজীবী মানজুর বলেন, নিরাপত্তার কথা বলে হাসপাতাল থেকে তাঁদের তুলে নেওয়া হয়েছে।
এখন তাঁদের খাওয়াদাওয়ার ছবি দেওয়া হচ্ছে। তিনি প্রশ্ন করেন, ইন্টারনেট কেন বন্ধ ছিল? এ পর্যায়ে হাইকোর্ট বলেন, এখানে অনেক রাজনৈতিক বিষয় আছে। সুতরাং কোর্টকে নষ্ট (বিতর্কিত) করবেন না। সংবিধানের ৩৪ অনুচ্ছেদের কথা বলতে পারেন।
এরপর আইনজীবী অনীক আর হক শুনানিতে বলেন, ‘আমাদের আরজি হলো তাজা গুলি ছোড়া বন্ধ করা। এতে প্রাণহানি হতে পারে। আমরা চাই না দেশের সম্পদ নষ্ট হোক। এই ছাত্ররা কি দেশের সম্পদ নয়? তবে কোনো সহিংসতা হলে পুলিশ কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে? অবশ্যই না। পুলিশের অধিকার আছে সহিংসতা বন্ধ করার। কিন্তু সেটা তাজা গুলি ছুড়ে না।’
এরপর শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন। তিনি বলেন, বলা হচ্ছে ছয় সমন্বয়ককে তাঁদের নিরাপত্তার জন্য তুলে নেওয়া হয়েছে। ডিবি বলছে তাঁরা তাদের হেফাজতে আছে। কিন্তু সংবিধান বা আইনে এভাবে হেফাজতে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
প্রবীণ আইনজীবী জেড আই খান পান্না শুনানিতে বলেন, দরজায় নক করে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে ছাত্র আছে কি না। তাদের মোবাইল কেড়ে নিয়ে চেক করা হচ্ছে। এটা কি আইনসংগত?
এরপর রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে এসে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মেহেদী হাছান চৌধুরী বলেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী কিভাবে আইনের প্রয়োগ করবে, সেটা তাদের নিজস্ব বিষয়। যাঁরা রিট আবেদন করেছেন তাঁরা কি নিশ্চয়তা দিতে পারবেন যে বিটিভি, সেতু ভবন, মেট্রো রেল বা এক্সপ্রেস ওয়েতে আর হামলা হবে না? নরসিংদীর জেলে হামলা করা হয়েছে। সেখান থেকে জঙ্গিসহ বন্দিরা পালিয়েছে।
তখন আদালত বলেন, এ ঘটনার আগে মিছিলে একটি ছেলে গুলিতে মারা গেছে। তারপর একটি গ্রুপ হামলা করেছে।
অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মেহেদী হাছান চৌধুরী বলেন, প্রতিটি ছাত্রের মৃত্যুর জন্য কমিশন গঠন করা হবে, হয়েছে। দেশে যদি মব (বিশৃঙ্খল জনতা) হয়, সেখানে কি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী আইন প্রয়োগ করতে পারবে না? যারা মারা গেছে, তাদের মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। পুলিশ যদি বেআইনিভাবে গুলি করে থাকে, তাহলে তদন্ত সাপেক্ষে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, প্রতিটি ঘটনার তদন্ত হবে। তাহলে এই রিট আবেদনের উদ্দেশ্য কী? ভুক্তভোগী বা তাদের পরিবার কেউ এসে এই রিট আবেদন করেনি।
ছয় সমন্বয়ককে ডিবি হেফাজতে রাখার বিষয়ে এই সরকারি আইন কর্মকর্তা বলেন, ‘টিভিতে আমরা দেখেছি, ডিবি অফিসে এই ছয়জন কাটা চামচ দিয়ে খাচ্ছেন।’
তখন আদালত বলেন, ‘এগুলো করতে আপনাকে কে বলেছে? কেউ বলেনি। কেন করছেন এগুলো? জাতিকে নিয়ে মসকরা কইরেন না। যাকে ধরে নেন, নিয়েই একটি খাবার টেবিলে বসিয়ে দেন। জাতিকে নিয়ে মসকরা কইরেন না।’
শুনানির এ পর্যায়ে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ বলেন, দুই পক্ষেই হতাহত হয়েছে। ২০০ লোক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর গুলিতে মারা গেছে, এই তথ্যের ভিত্তি কী?
আদালত বলেন, যদি ছয় (সমন্বয়ক) ছাত্রকে আটক করে না থাকেন, তাহলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করেন।
শুনানির এ পর্যায়ে রিট আবেদনকারী পক্ষের আইনজীবী অনীক আর হক আদালতের কাছে মৌখিক আদেশ চান। আদালত তখন বলেন, ‘মৌখিক আদেশে তো কোনো কাজ হবে না। রিট আবেদনের আরজি সংশোধন (আটক রাখা হয়নি মর্মে ছয় সমন্বয়ককে আদালতের সামনে হাজির করার নির্দেশনা চেয়ে) করে নিয়ে আসুন। কাল শুনানি করে আদেশ দেব।’
তখন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আজহারুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা দেশে শান্তি চাই। আজকে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্দোলন নেই। তার পরও আন্দোলন হচ্ছে। বাংলাদেশের সংবিধান, আইন এবং সার্বিক বিবেচনা করে একটি আদেশ দেওয়া প্রয়োজন।’
এ আইনজীবীর শুনানির পর আদালত মধ্যাহ্ন বিরতিতে যান।