সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে চলমান বার্ষিক জলবায়ু সম্মেলনে এবার রেকর্ডসংখ্যক জীবাশ্ম জ্বালানি লবিস্ট নিবন্ধন করেছেন। সংখ্যাটি গতবারের প্রায় চার গুণ বলে জলবায়ু আলোচনায় কার্বন নিঃসরণকারী বড় প্রতিষ্ঠানের অন্তর্ভুক্তির বিরোধী ‘কিক বিগ পলিউটারস আউট’ (কেবিপিও) জোটের নতুন এক পর্যালোচনায় বেরিয়ে এসেছে।
বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে রাখতে কত দ্রুত জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করা যায়, সেটিই এই সম্মেলনের অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয়। জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল ধনী অনেক দেশই ধীরেসুস্থে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করতে চায়।
অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের যারা বেশি ভুক্তভোগী অথচ কার্বন নিঃসরণে অংশীদারি নগণ্য, তারা চায় যত দ্রুত, পারলে এখনই জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বন্ধের ঘোষণা দিতে। এ নিয়ে দর-কষাকষি চলছে যে সম্মেলনে, সেখানে জীবাশ্ম জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্ট বিপুলসংখ্যক লবিস্টের উপস্থিতি পরিবেশবাদীদের উদ্বেগের কারণ হবে সেটাই স্বাভাবিক।
গ্লোবাল সাউথ বা দক্ষিণ গোলার্ধের অনেক দেশ কপ সম্মেলনের মতো গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাগুলো থেকে দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্বকারী ও লবিস্টদের বাইরে রাখার দাবি জানিয়ে আসছে। জাতিসংঘসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠন, বিভিন্ন দেশের অসংখ্য সরকারি কর্মকর্তা এবং বিশ্বব্যাপী ক্রিয়াশীল বিস্তৃত নাগরিক সমাজও এই দাবিতে সংহতি জানিয়েছে।
কেবিপিও জানিয়েছে, এবারকার কপে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা ১০টি দেশের প্রতিনিধির সংখ্যা সব মিলিয়ে এক হাজার ৬০৯ জন। অথচ এবারই অন্তত দুই হাজার ৪৫৬ জীবাশ্ম জ্বালানি লবিস্ট দুবাই কপে ঢোকার সুযোগ পেয়েছেন। এতেই বোঝা যাচ্ছে, জীবাশ্ম জ্বালানি খাত কী করে এ ধরনের সম্মেলনেও সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের দাবিয়ে রাখতে পারে, বলেছে কিক বিগ পলিউটারস আউট কোয়ালিশন।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে চলা বার্ষিক জলবায়ু সম্মেলনের এবারের ২৮তম আয়োজনে অংশ নেওয়া প্রত্যেক প্রতিনিধিকে তিনি কার হয়ে প্রতিনিধিত্ব করছেন সেটাসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তৃত তথ্য দিতে হয়েছে।
ওই তথ্য এবং জীবাশ্ম জ্বালানি অনুসন্ধান, খনন, উত্তোলন, সরবরাহ ও কেনাবেচা এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন খাতের কম্পানির তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে কেবিপিও এই লবিস্টদের সংখ্যা বের করতে পেরেছে।
গতবারের মিসর সম্মেলনে অংশ নেওয়া লবিস্টের সংখ্যা ছিল ৬৩৬, আগের গ্লাসগো সম্মেলনে ছিল ৫০৩—বলছে কেবিপিওর পর্যালোচনা। অবশ্য আগের সম্মেলনগুলোতে প্রতিনিধিদের খুব বেশি তথ্য দিতে হতো না, যে কারণে সেসব সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী লবিস্টের যে সংখ্যা পাওয়া গেছে, তা প্রকৃত সংখ্যার চেয়ে কম বলেই মনে হচ্ছে।
এবারের সম্মেলনে কেবল দুটি দেশের প্রতিনিধির সংখ্যা লবিস্টদের মোট সংখ্যার বেশি। একটি ব্রাজিল, যারা কপে এসেছে তিন হাজার ৮১ জনকে নিয়ে, আর দ্বিতীয় দেশটি স্বাগতিক সংযুক্ত আরব আমিরাত, তাদের প্রতিনিধির সংখ্যা চার হাজার ৪০৯।
এই লবিস্টদের বড় অংশকেই সম্মেলনে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংঘ। এই সংঘগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ১০টি সংঘের ৯টিই উত্তর গোলার্ধের অর্থাৎ ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় বহর হচ্ছে সুইজারল্যান্ডের জেনেভাভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল এমিশনস ট্রেডিং অ্যাসোসিয়েশনের (আইইটিএ); তাদের ১১৬ জনের মধ্যে শেল, টোটালএনার্জিস ও নরওয়ের ইকুইনরের মতো বিপুলসংখ্যক দূষণকারী কম্পানির প্রতিনিধিরাও রয়েছেন।
কেবল ব্যাবসায়িক সংঘই নয়, জীবাশ্ম জ্বালানি লবিস্টরা বিভিন্ন দেশের অফিশিয়াল প্রতিনিধিও হয়েছেন। ফ্রান্সই তাদের প্রতিনিধিদলের সদস্য করেছে টোটালএনার্জিস, ইডিএফের মতো জ্বালানি জায়ান্টদের কর্মকর্তাদের। ইতালি করেছে ইএনআই প্রতিনিধিদের, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি হয়েছেন বিপি, ইএনআই আর এক্সনমবিলের কর্মীরা।
প্রভাবশালী বিভিন্ন দেশের এমন ভূমিকায় এবং সম্মেলনে বিপুলসংখ্যক লবিস্টকে ঢোকার সুযোগ করে দেওয়ায় পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন তীব্র ক্ষোভ ব্যক্ত করেছে।
‘আপনারা কি সত্যিই মনে করছেন শেল, শেভরন বা এক্সনমবিল লবিস্ট পাঠিয়েছে চুপচাপ আলোচনা শুনতে? যাদের বাতাস আর পানি তারা দূষিত করেছে বা করছে, তাদের উপকারে যেন জলবায়ুসংশ্লিষ্ট সমাধান বের হয় তা নিশ্চিত করতে? মানুষ ও ধরিত্রীকে তাদের লাভ আর ডলারের লালসার ওপরে রাখতে? বড় বড় দূষণকারীদের এমন বিষাক্ত উপস্থিতির কারণেই আমরা বারবার পিছিয়ে যাচ্ছি। জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছি না,’ বলেছেন স্টার্ট এমপাওয়ারমেন্টের সহপ্রতিষ্ঠাতা এলিশিয়া লেক্লার্ক।