<p>সবারই কমবেশি ধারণা, বিজ্ঞান প্রাকৃতিক জগৎ সম্পর্কে সবচেয়ে সাধারণ আর বড় প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়েছে; অন্তত যে প্রশ্নগুলোর জবাব নিছক আকার-আকৃতির ওপর নির্ভরশীল। প্রযুক্তির এই চরম উৎকর্ষের যুগেও কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে সরল এক প্রশ্নের সোজাসাপ্টা জবাব মিলছে না। তা নিয়ে বিভ্রান্তি অব্যাহত রয়েছে ২০২৩ সালেও। প্রশ্নটি হচ্ছে, বিশ্বের দীর্ঘতম নদী কোনটি?</p> <p>এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা ও গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের মতো নির্ভরযোগ্য উৎস ‘বিশ্বের দীর্ঘতম নদী’ শিরোপাটি দিয়ে রেখেছে আফ্রিকার নিল নদকে (ইংরেজিতে নাইল)। কিন্তু এ নিয়ে কোনো কোনো মহলের আপত্তি আছে। দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন নদীকেই দীর্ঘতম নদী মনে করে তারা। আমাজনকে বিজয় গৌরবে ভূষিত করার লক্ষ্যে এ মতের সমর্থক একদল আন্তর্জাতিক অভিযাত্রী ও গবেষক এবার এক নদী অভিযানে বেরোচ্ছেন। ভেলা, ঘোড়া আর সোলার প্যানেলযুক্ত নৌকা হবে তাঁদের এ ভ্রমণের পরিবহন মাধ্যম।</p> <p>ব্রাজিলিয়ান অভিযাত্রীদলের নেতা ৫৫ বছর বয়সী অভিজ্ঞ অভিযাত্রী এবং চলচ্চিত্র প্রযোজক ইউরি সানাদা। সানাদার মন্তব্য : ‘নিল নদ একটা কেঁচো। আর আমাজন এক অ্যানাকোন্ডা সাপ।’</p> <p>আমাজন সত্যিই এক সমীহ জাগানো নদী। এটি অন্য যেকোনো প্রতিদ্বন্দ্বী বড় নদীর চেয়ে চার গুণ বেশি পানি বহন করে। সানাদা বলেন, ‘এ কারণে আমাজনকে কারো সঙ্গে নিয়ে তুলনা করার দরকার নেই। আমাদের নদীই সবচেয়ে বড়। হ্যাঁ, দীর্ঘতমও কি না তা আমরা দেখব এবার।’</p> <p>পরিকল্পিত পাঁচ মাসব্যাপী অভিযানটি চলবে সাত হাজার কিলোমিটার ধরে। ২০২৪ সালের এপ্রিলে শুরু হতে যাওয়া এ অভিযানে নদীটির পূর্ণ দৈর্ঘ্য বরাবর ভ্রমণ করা হবে। অভিযানকারীরা বলছেন, তাঁরা স্থায়ীভাবে প্রমাণ করবেন, আমাজন শুধু বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পানি বহন করা নদী নয়, দীর্ঘতমও বটে। এ জন্য তাঁরা ব্যবহার করবেন নদীর মানচিত্র তৈরির আধুনিক স্যাটেলাইট প্রযুক্তি।</p> <p>উল্লেখ করা দরকার, আমাজন একটি একক বৃহৎ জলধারা নয়, বরং এটি দক্ষিণ আমেরিকার উত্তরাঞ্চলের বেশির ভাগ অংশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এক বৃহত্তর ‘নদীব্যবস্থার’ অংশ। একটি গাছের বড় শাখার সঙ্গে এর তফাত বেশি নয়। নদীটির কাঠামোয় আছে একাধিক উৎস ও উপনদী।</p> <p>নিল ও আমাজনের মধ্যে দৈর্ঘ্যের বিরোধটি মূলত আমাজন নদীর যাত্রা কোথা থেকে শুরু হয়েছে সেই প্রশ্ন থেকে। ব্রিটানিকা এবং অন্য প্রধান সূত্রগুলো বলে আসছে, নদীটির সূচনা দক্ষিণ পেরুর আপুরিমাক নদীর উৎস থেকে। কিন্তু মার্কিন স্নায়ুবিজ্ঞানী শখের নদী-অভিযাত্রী জেমস ‘রকি’ কন্টোস (৫১) দাবি করেছেন, তিনি আমাজনের আরো দূরবর্তী উৎস আবিষ্কার করেছেন। সেটি হচ্ছে উত্তর পেরুর মান্তারো নদী। পাহাড়ি নদীপথের জনপ্রিয় অ্যাডভেঞ্চার  ক্রীড়া হোয়াইটওয়াটার র‌্যাফটিংয়ের পথ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে এটি আবিষ্কার করার কথা বলেছেন কন্টোস। তিনি বলেন, ‘আপুরিমাক নদীকে যে আমাজনের সবচেয়ে দূরবর্তী উৎস বলে মনে করা হয় তা আমার জানা ছিল। তবে পেরু ভ্রমণের প্রস্তুতি হিসেবে সব তথ্য সংগ্রহ করার সময় বুঝতে পেরেছিলাম অন্য একটি দীর্ঘতর নদী রয়েছে এখানে।’</p> <p>ওই এলাকায় কায়াকিং করার সময় টপোগ্রাফিক মানচিত্র, স্যাটেলাইট চিত্র ও জিপিএস দিয়ে মাপজোখের মাধ্যমে এই তথ্যটি আরো যাচাই করেন কন্টোস। ২০১৪ সালে তাঁর এই গবেষণা প্রকাশিত হয়।</p> <p>জেমস কন্টোসের মতে, ‘নতুন উৎস’ আবিষ্কারের ফলে আগের জানা উৎসর তুলনায় আমাজনের দৈর্ঘ্যে ৭৭ কিলোমিটার (৪৮ মাইল) যোগ হয়েছে।</p> <p>পরিকল্পিত সাত হাজার কিলোমিটারের অভিযানের রুটটি যাবে পেরু, কলম্বিয়া ও ব্রাজিলের মধ্য দিয়ে। যাত্রা শুরু হবে পেরুর আন্দিজ পর্বতের গভীরে অবস্থিত সেই মান্তারো নদী থেকে।</p> <p>মান্তারো থেকে কন্টোসের নেতৃত্বে শুরু হবে র‌্যাফটিং অভিযান। মান্তারো নদী এনি নদীর সঙ্গে মিলিত হলে শুরু হবে যাত্রার দীর্ঘতর অংশটি। এটিতে থাকবে বিশেষভাবে নির্মিত সৌর ও প্যাডেলচালিত তিনটি নৌকার বহর। আমাজনের বাকি অংশ ধরে আটলান্টিক মহাসাগরে এর মোহনা পর্যন্ত (ব্রাজিল উপকূল) যাবেন অভিযাত্রীরা।</p> <p>অন্যতম দলনেতা ইউরি সানাদা বলেছেন, ২০২৫ সালের গোড়ার দিকে পেরুর আপুরিমাক নদীতেও আরেকটি অভিযান শুরু হবে, যা আমাজনের ঐতিহ্যগতভাবে স্বীকৃত উৎস। এতে দুইয়ের মধ্যে যাচাই করার একটি সুযোগ পাওয়া যাবে।</p> <p>সানাদা বলেছেন, অভিযানটি নিয়ে আয়োজকরা উৎসাহে টগবগ করে ফুটলেও তা বেশ বিপজ্জনক হবে। তাঁর ভাষায় : ‘এ ধরনের অভিযানে অনেক ধরনের সমস্যা হতে পারে। আছে নৌকা বিগড়ে যাওয়ার আশঙ্কা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে আছে অন্য ধরনের ঝুঁকি। জঙ্গলে আছে জাগুয়ার, বিশালাকার অ্যানাকোন্ডা, বিষাক্ত ব্যাঙসহ অনেক বিপজ্জনক প্রাণী।’ তবে অন্য মানুষের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার বিষয়টিই হতে পারে সবচেয়ে বিপজ্জনক। আমাজনের গহিনে দেখা মিলতে পারে বিপজ্জনক মাদক ব্যবসায়ী চক্র বা বৈরী অন্য কারো। আবার বন্ধুত্বপূর্ণ কোনো আদিবাসী গোষ্ঠীর মানুষও এগিয়ে আসতে পারে রাতের খাবার খাওয়ার দাওয়াত দিতে। অভিযাত্রীরা তাই অবৈধ খনি ও মাদকপাচারের কুখ্যাত অংশগুলো দিয়ে যাওয়ার সময় সশস্ত্র পাহারার জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সহায়তা নেবেন। নৌকার কেবিনগুলোও বুলেট ও তীর নিরোধক উপাদান দিয়ে সুরক্ষিত করা হচ্ছে।</p> <p>অভিযানে যে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানোই যাবে, সে বিষয়ে অবশ্য নিশ্চিত নন ইউরি সানাদা। খোলাখুলিভাবে সে কথা নিজেই বলেছেনও। এর কারণও আছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্যান ডিয়েগো বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও মহাসাগর বিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক সুজান ওয়ালথার নদী ব্যবস্থা এবং পরিমাপ বিশেষজ্ঞ। তিনি অভিযাত্রীদের জানিয়েছেন, নদীর আকার পরিমাপের অনেক চ্যালেঞ্জ। জলপথের গতিশীল ও জটিল বৈশিষ্ট্য আর উৎস ও সমাপনী অংশ নিয়ে নানাজনের ব্যাখ্যার তফাত বিষয়টিকে কঠিন করে তোলে।</p> <p>আমাজন অভিযানের ফলাফল যাই হোক না কেন, সানাদা বলেছেন, তিনি একই কৌশল ও পরিমাপের পদ্ধতি ব্যবহার করে আগামী দিনে আফ্রিকায় নীল নদ অভিযানেও যেতে চান।</p>