এক দশক আগে কার্যকর হওয়া অর্পিত সম্পত্তি আইনের তিনটি ধারা মৌলিক অধিকার পরিপন্থী নয় বলে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন, ২০০১-এর ৯, ১৩ ও ১৪ ধারা সাংবিধানিকভাবে বৈধ।
এ রায়ের ফলে আইনের ১৪ ধারা অনুসারে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ না হওয়া পর্যন্ত সেই সম্পত্তি ইজারা দেওয়ার বা ইজারা বাতিল করার যে ক্ষমতা আইনে জেলা প্রশাসকদের দেওয়া আছে, সেটি বৈধ। রায়ে বলা হয়েছে, আইনের ১৪ ধারা অনুসারে সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে না হলে জনগণের সম্পত্তি বেহাত হবে।
সরকার রাজস্ব হারাবে। তাই এই বিধান যথাযথ।
এসংক্রান্ত দুটি রিটে জারি করা রুল খারিজ করে বৃহস্পতিবার এ রায় দিয়েছেন বিচারপতি নাইমা হায়দারের নেতৃত্বাধীন বৃহত্তর হাইকোর্ট বেঞ্চ। বেঞ্চের অন্য দুই বিচারপতি হলেন বিচারপতি সহিদুল করিম ও বিচারপতি এ এম কুদ্দুস জামান।
রায়ে বলা হয়েছে, ২০১২ সালে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ ট্রাইব্যুনাল গঠনের আগে দেশের বিভিন্ন দেওয়ানি আদালতে বিচারাধীন বা অনিষ্পন্ন সব মোকদ্দমা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। এসব মোকদ্দমা বাতিল করার জন্য সংশ্লিষ্ট আদালতের কোনো আদেশের প্রয়োজন পড়বে না।
আদালতে রিটের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী কামরুল হক সিদ্দিকী ও ওমর ফারুক। ভূমি মন্ত্রণালয়ের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।
রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাশগুপ্ত।
রায়ের পর আইনজীবী মনজিল মোরসেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘হাইকোর্ট রুল জারির সময় আবেদনকারীদের দাবি করা সম্পত্তিতে স্থিতাবস্থা জারি করেছিলেন। সেই স্থিতাবস্থা তুলে নিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালত দুই রিট আবেদনকারীকে নিয়ে বলেছেন, যেহেতু অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ ট্রাইব্যুনালে তাঁদের মোকদ্দমা চলছে, ফলে আইনের ১৩ ধারা অনুসারে দেওয়ানি আদালতের মোকদ্দমা বাতিল হলেও তাঁদের অধিকার ক্ষুণ্ন হবে না।’
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাশগুপ্ত কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ ট্রাইব্যুনালের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সম্পত্তির প্রকৃত মালিককে তাঁর সম্পত্তি ফিরিয়ে দেওয়া।
ফলে এটি কোনোভাবেই সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় বলে রায় দিয়েছেন
হাইকোর্ট।’
তবে রিট আবেদনকারী চট্টগ্রামের মো. মশিউর রহমানের আইনজীবী ওমর ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আইনে জেলা প্রশাসককে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, আমরা মনে করি এই ক্ষমতা অবাধ, স্বেচ্ছাচারী, নীতিবহির্ভূত। এই ক্ষমতার প্রয়োগ মানেই ক্ষমতার অপব্যবহার। এই বিধান থাকা মানেই নাগরিকের প্রতি অন্যায় করা, যা সংবিধানের ৪২ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন। আইনটি বহাল থাকলেও জেলা প্রশাসকের ক্ষমতাসংক্রান্ত বিধানটি বাতিল ঘোষণার আরজি ছিল আমাদের। পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত বা পর্যবেক্ষণ আসে জানি না। তবে আদালত বলেছেন, আমাদের যুক্তিগুলো তুলে ধরে সিদ্ধান্ত, অভিমত বা পর্যবেক্ষণ দেওয়া হবে। তবে জেলা প্রশাসকের ক্ষমতাসংক্রান্ত বিধানের ব্যাপারে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করা হবে।’
রায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যে আইনটি এখন আছে, সেটি অনেকবার সংশোধন হওয়ার পর এই পর্যায়ে এসেছে। আমি মনে করি হাইকোর্টের রায় যথাযথ হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘যখন আইনের অধীনে ট্রাইব্যুনাল থাকে তখন অন্য কোর্টের আর এখতিয়ার থাকে না। ফলে আইনে যেভাবে নির্দেশনা আছে সেভাবেই কার্যকর হবে। তবে একটা সমস্য হচ্ছে, আইনে জেলা প্রশাসককে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সে বিষয়টি হাইকোর্ট বিবেচনা করতে পারতেন। কারণ জেলা প্রশাসকদের দাপট ও কর্মকাণ্ডে এমনিতেই মানুষ নিগৃহীত। সম্পত্তি অর্পণ করার আগ পর্যন্ত সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ, ইজারা দেওয়া বা ইজারা বাতিল করার যে ক্ষমতা জেলা প্রশাসকদের দেওয়া হয়েছে, তাতে এ ক্ষমতার অপব্যবহার বাড়বে। জনসাধারণের হয়রানি বাড়বে বলে আমি মনে করি।’
চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ ট্রাইব্যুনালে ৪৪ হাজার ৬২৭টি মামলা বিচারাধীন বলে জানান সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান।
আইনের প্রেক্ষাপট : ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ বাধে। এই যুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিল ১৭ দিন। যুদ্ধ শুরুর দিন পাকিস্তান সরকার জরুরি অবস্থার সঙ্গে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ ও পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধি জারি করে। এই অধ্যাদেশের ধারাবাহিকতায় ৬ সেপ্টেম্বরের আগে থেকে ১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ভারতে বসবাসরত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকার জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করে নেয়। তবে ওই একই দিন সংখ্যালঘুদের ওপর আরোপিত হয় ‘শত্রু সম্পত্তি জরুরি বিধান অবিরত’ নামের এক অধ্যাদেশ।
১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের পর পাকিস্তান আমলের অনেক আইন বাতিল করা হলেও শত্রু রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রণীত শত্রু সম্পত্তি আইন বাতিল করা হয় না। নতুন মোড়কে শত্রু সম্পত্তি আইন অর্পিত সম্পত্তি নামকরণে বহাল রাখা হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হয়ে অর্পিত সম্পত্তি এ দেশে বসবাসকারী মূল মালিকদের বরাবর প্রত্যর্পণের উদ্যোগ নেয়। প্রণীত হয় অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন ২০০১। আইনটি তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ পর্যায়ে প্রণীত হওয়ায় ওই সময় বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। বর্তমান সরকার অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন ২০০১ একাধিকবার সংশোধন করেছে। ২০১৩ সালের ১৮ এপ্রিল ৩ নম্বর অধ্যাদেশ জারি করে সরকার আইনটিতে ব্যাপক সংশোধনী আনায় ট্রাইব্যুনালে মোকদ্দমা দ্রুত নিষ্পত্তির সুযোগ তৈরি হয়।
২০০১ সালে প্রণীত অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন ২০১২ সালে কার্যকর হওয়ার পর সরকার ওই বছর ৮ এপ্রিল অর্পিত সম্পত্তি তফসিলভুক্ত করে গেজেট প্রকাশ করে। তফসিলভুক্ত অর্পিত সম্পত্তি নিজের দাবি করে খুলনার শ্যামল কুমার সিংহ রায় ও চট্টগ্রামের মো. মশিউর রহমান হাইকোর্টে রিট করেন। রিটে তফসিলভুক্তির আদেশের পাশাপাশি আইনটির ৯, ১৩ ও ১৪ ধারা চ্যালেঞ্জ করা হয়।
রিটে বলা হয়, সংবিধানের ৪২ অনুচ্ছেদ অনুসারে সম্পত্তির অধিকার ব্যক্তির মৌলিক অধিকার। সুতরাং রাষ্ট্র বা সরকারের কোনো কর্মকর্তা বা কোনো কর্তৃপক্ষ তা অস্বীকার করতে পারবে না। অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন ২০০১-এর ৯, ১৩ ও ১৪ ধারা আবেদনকারীদের সেই মৌলিক অধিকারকে ক্ষুণ্ন করেছে। সুতরাং তিনটি ধারা বাতিলযোগ্য। আদালত দুটি রিটে প্রাথমিক শুনানির পর রুল জারি করেন। রুলে তিনটি ধারা বাতিল এবং রিট আবেদনকারীদের দাবি করা সম্পত্তি তফসিলভুক্ত করে প্রকাশিত গেজেট কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, জানতে চাওয়া হয় রুলে। একই সঙ্গে তফসিলভুক্ত সম্পত্তি আবেদনকারীদের বুঝিয়ে দেওয়ার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয় রুলে। আইনসচিব, ভূমিসচিব, খুলনা ও চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক, কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব, জনশক্তি ব্যুরোর উপপরিচালকসহ ১২ বিবাদীকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়। রুল জারির পর প্রধান বিচারপতি রিট মামলা দুটি নিষ্পত্তির জন্য বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করে দেন। সেই বেঞ্চে দীর্ঘ শুনানির পর রায় দিলেন উচ্চ আদালত।