<p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">থ্যালাসেমিয়া একটি জন্মগত রক্তরোগ। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের শরীরে রক্তের মূল্যবান উপাদান হিমোগ্লোবিন ঠিকমতো তৈরি হয় না। শিশুর বয়স এক বা দুই বছর হলে শিশুর রক্তশূন্যতা দেখা দেয় এবং ফ্যাকাশে হয়ে পড়ে। শিশুর স্বাভাবিক দৈহিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে শরীরের দরকারি অঙ্গ যেমন—প্লীহা, যকৃৎ বড় হয়ে যায় এবং কার্যক্ষমতা হারাতে থাকে। মুখমণ্ডলের হাড়ের অস্থিমজ্জা বিকৃত হওয়ার কারণে শিশুর চেহারা বিশেষ রূপ ধারণ করে, যা দেখে চিকিৎসক সহজেই থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুকে চিহ্নিত করতে পারেন।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের অন্যের রক্ত নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের বাঁচিয়ে রাখতে বিশাল রক্তের ভাণ্ডার প্রয়োজন হচ্ছে। আনুষঙ্গিক খরচ বহন করতে গিয়ে মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন লাখো মা-বাবা। শুধু তা-ই নয়, মা-বাবার সামনেই ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সের মধ্যে বেশির ভাগ থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুর জীবন প্রদীপ নিভে যাচ্ছে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন থ্যালাসেমিয়া রোগের একমাত্র চিকিৎসা, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। আবার তা সব সময় সফল হয় না। কাজেই থ্যালাসেমিয়া রোগের চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ জরুরি।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">দেশে বর্তমানে প্রায় এক লাখের মতো থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশু রয়েছে। দেশে সংগৃহীত রক্তের প্রায় ৬০ শতাংশই থ্যালাসেমিয়া রোগীদের বাঁচিয়ে রাখতে ব্যবহার করা হয়। বারবার রক্ত সঞ্চালনের ফলে তাদের দেহে হেপাটাইটিস-বি, সি-সহ মারাত্মক জীবাণুর সংক্রমণও ঘটে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">কেন থ্যালাসেমিয়া রোগে শিশুরা আক্রান্ত হয়? : মানব কোষে হিমোগ্লোবিন তৈরি করার জন্য দুটি জিন থাকে। একটি বাবা ও একটি মায়ের কাছ থেকে আসে। যাদের একটি জিন ভালো ও একটি জিন ত্রুটিযুক্ত থাকে, তাদের থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক বলা হয়। বাহকদের যেহেতু হিমোগ্লোবিন তৈরির জন্য অন্তত একটি জিন ভালো থাকে তাই তারা স্বাভাবিক জীবন যাপন করে। তবে থ্যালাসেমিয়া রোগের নারী বাহক গর্ভবতী হলে রক্তের হিমোগ্লোবিন বেশি কমে যেতে পারে। যে কারণে কারো কারো গর্ভাবস্থায় দু-এক ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হতে পারে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের প্রায় ১২ শতাংশ মানুষ থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক। স্বামী-স্ত্রী দুজনই যদি থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক হন, তবে ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের সন্তান থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে, ৫০ শতাংশ বাহক হিসেবে এবং ২৫ শতাংশ সুস্থ শিশু হিসেবে জন্ম নিতে পারে। তবে এটা লটারির মতো! প্রথম, দ্বিতীয় যেকোনো সন্তান থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে জন্মাতে পারে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">প্রতিরোধের উপায়</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">সচেতনতা : এ রোগ প্রতিরোধে ব্যাপক সচেতনতা জরুরি। সাধারণ মানুষ থেকে স্বাস্থ্যকর্মী সব পর্যায়ে সচেতনতার জন্য গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার, আলাপ-আলোচনা, টক শো, ডকুমেন্টারি প্রদর্শন, লিফলেট বিতরণ, পোস্টার, বিলবোর্ড প্রদর্শন ইত্যাদির মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া রোগ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে সচেতনতার জন্য সভা-সেমিনার করে মসজিদের ইমাম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা, বিভিন্ন করপোরেট সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে থ্যালাসেমিয়া রোগ সম্পর্কে সম্যক ধারণা তৈরি করতে হবে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বাহক নির্ণয় : যেহেতু স্বামী-স্ত্রী উভয়ে থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক হলেই শুধু থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুর জন্ম হতে পারে, কাজেই বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রীর থ্যালাসেমিয়া বাহক নির্ণয়ে পরীক্ষা করা প্রয়োজন। থ্যালাসেমিয়ার এক বাহকের সঙ্গে আরেক বাহকের বিয়েকে নিরুৎসাহ করাই থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের কার্যকর উপায়। যাদের পরিবারে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশু আছে, সেসব পরিবারের সদস্যদের বাহক নির্ণয় করা সবার আগে জরুরি। কারণ সবচেয়ে বেশি বাহকের বিস্তার এসব পরিবারে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীদের থ্যালাসেমিয়ার বাহক নির্ণয়ে পরীক্ষা করে আইডি কার্ডে সংযুক্ত করা যেতে পারে। যেসব দম্পতি সন্তান নেওয়ার চিন্তা করছেন, তাঁদেরও বাহক নির্ণয় জরুরি। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">সন্তানসম্ভবা কোনো নারী চিকিৎসাকেন্দ্রে এলে অন্যান্য পরীক্ষার সঙ্গে বাহক নির্ণয় পরীক্ষাও করা যেতে পারে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">প্রশিক্ষণ ও বাহক নির্ণয় পরীক্ষা সহজলভ্য করা : চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে জড়িত সব জনবলকে থ্যালাসেমিয়ার বাহক নির্ণয়সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে হবে। উপজেলা পর্যায়ে থ্যালাসেমিয়ার বাহক নির্ণয় সহজলভ্য করতে হবে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">গর্ভাবস্থায় ভ্রূণের পরীক্ষা : স্বামী-স্ত্রী দুজনই যদি থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক হন তবে দম্পতির সন্তান গ্রহণের ক্ষেত্রে মাতৃজঠরে বাচ্চার ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে পরীক্ষা করে দেখতে হবে অনাগত সন্তান থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে জন্মাবে কি না। রোগাক্রান্ত ভ্রূণ অপসারণ করে থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত শিশুর জন্ম প্রতিরোধ সম্ভব। এ জন্য দেশে বিদ্যমান গর্ভপাত আইন পরিবর্তনসহ গর্ভবতী মাকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সহায়তা দিতে হবে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আইন প্রণয়ন : পৃথিবীর অনেক দেশে যেমন—সাইপ্রাস ১৯৭৩, বাহরাইন ১৯৮৫, ইরান ও সৌদি আরব ২০০৪ এবং সর্বশেষ পাকিস্তান ২০১৩ সালে বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রীর বা সন্তান নেওয়ার আগে স্বামী-স্ত্রীর থ্যালাসেমিয়া আছে কি না, তা পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে। এমন আইন প্রণয়ন আমাদের দেশেও জরুরি। বিয়ে পড়ানোর আগে এনআইডির মতো থ্যালাসেমিয়া বাহক নির্ণয় পরীক্ষার রিপোর্ট বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সময় বাহক নির্ণয় পরীক্ষার সার্টিফিকেট প্রদান বাধ্যতামূলক করতে হবে। এনআইডিতে বাহক কি না, সে তথ্য থাকবে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">শেষ কথা : কয়েক বছর আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে একটি ‘গাইড লাইন’ তৈরি করলেও তা তেমন প্রচার হয়নি। ওই গাইডলাইন অনুযায়ী থ্যালাসেমিয়ার বাহক নির্ণয়ের জন্য প্রাথমিকভাবে রক্তের সিবিসি পরীক্ষা করার কথা বলা হয়েছে। সিবিসি পরীক্ষায় এমসিভি ৮০ এফএলের নিচে বা এমসিএইচ ২৭ পিজির নিচে হলে থ্যালাসেমিয়ার বাহক হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ রকম রিপোর্ট হলে পরবর্তী সময়ে হিমোগ্লোবিন ইলেট্রোফোরেসিস পরীক্ষার মাধমে নিশ্চিত হওয়া যাবে কেউ থ্যালাসেমিয়ার বাহক কি না। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">দেশে থ্যালাসেমিয়ার বাহক নির্ণয়, গর্ভস্থ ভ্রূণ পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। গত কয়েক বছরে এই ব্যবস্থাগুলো নিয়ে কয়েক হাজার সুস্থ শিশুর জন্ম নিশ্চিত করা গেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ২০২৮ সালের মধ্যে থ্যালাসেমিয়ামুক্ত বাংলাদেশ গড়ার রূপরেখা তৈরি করেছে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আমাদের দেশে থ্যালাসেমিয়া এখনো এক নীরব মহামারি। শিশু মৃত্যুর হার কমাতে হলে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুর জন্ম প্রতিরোধ করতে হবে। সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করার জন্য ৮ মে সারা বিশ্বে থ্যালাসেমিয়া দিবস পালন করা হয়। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">‘দৈনন্দিন জীবনে আমরা ভালো থাকার জন্য কত না পরিকল্পনা করি। আসুন সুস্থ সন্তানের মা-বাবা হওয়ার জন্য, মেধাদীপ্ত দেশ গড়ার জন্য, থ্যালাসেমিয়া রোগ সম্পর্কে সচেতন হই।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ডা. রেজাউল করিম কাজল : অধ্যাপক, প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।</span></span></span></span></p>