জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পাঁচ নেতাকে দলের পক্ষ থেকে দেওয়া কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাব দিয়েছেন তাঁরা। এতে বলেছেন, জুলাই ঘোষণাপত্রকে কেন্দ্র করে কিছু বিষয়ের প্রতি নীরব প্রতিবাদে তাঁদের এই কক্সবাজার সফর। এ ছাড়া তাঁরা ধীরস্থিরে চিন্তা করার জন্য সেখানে গেছেন বলে জানান। গতকাল বৃহস্পতিবার এনসিপির পক্ষ থেকে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।
সারজিস আলম ছাড়া বাকি চার নেতা গতকাল রাতে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কক্সবাজারে অবস্থান করছিলেন বলে দলীয় সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
কক্সবাজার সফরে আসা এনসিপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা এখনো শহরের সাগর পারের বিলাসবহুল হোটেল প্রাসাদ প্যারাডাইজে অবস্থান করছেন। গতকাল সকালে এনসিপির নেতা সারজিস আলম ও তাঁর স্ত্রী হোটেল থেকে গাড়িতে ঘুরতে বের হলেও সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত ফেরেননি।
হোটেল প্রাসাদ প্যারাডাইজ কর্তৃপক্ষ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেলেও তাঁরা কখন কক্সবাজার ছেড়ে যাবেন, এ ব্যাপারে জানা সম্ভব হয়নি।
হোটেল প্রাসাদ প্যারাডাইজের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) ইয়াকুব আলী বলেন, বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত এনসিপির নেতারা হোটেল কক্ষ বুকিং রেখেছিলেন। তবে কক্ষ ছাড়ার সময় পেরিয়ে সন্ধ্যা গড়ালেও তাঁরা এখনো হোটেলে অবস্থান করছেন। এনসিপি নেতারা হোটেল কক্ষ নতুন করে বুকিং না দেওয়ায় বৃহস্পতিবার কক্সবাজার অবস্থান করবেন না ছেড়ে দেবেন, এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত নন বলে জানান।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সারজিস ও তাঁর স্ত্রী গাড়ি যোগে বান্দরবান ঘুরতে গেছেন।
বান্দরবান থেকে চট্টগ্রামে যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেলেও তাঁদের সফরসূচি সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না।
গত ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের প্রথম বর্ষপূর্তির ঐতিহাসিক দিন হঠাৎ করে কক্সবাজারে আসেন এনসিপির পাঁচজন শীর্ষস্থানীয় নেতা। তাঁরা হলেন হাসনাত আবদুল্লাহ, সারজিস আলম, ডা. তাসনিম জারা, নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী ও খালিদ সাইফুল্লাহ। এ ছাড়া সার্জিসের স্ত্রী রয়েছেন। এর পর থেকে শুরু হয় নানা গুঞ্জন।
এই গুঞ্জনের মধ্যে উখিয়ার ইনানীর সী পার্ল হোটেলে এক রাত অবস্থান করে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টসংলগ্ন হোটেল প্রাসাদ প্যারাডাইজে ওঠেন।
বুধবার দুপুর পৌনে ১টায় এনসিপি নেতাদের দলটি উখিয়া উপজেলার জালিয়াপালং ইউনিয়নের সী পার্ল হোটেল ত্যাগ করেন। দুপুর ২টার দিকে কক্সবাজার শহরের কলাতলীতে পৌঁছান। পরে সেখানে শালিক রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাবার খান তাঁরা। বিকেল ৩টার দিকে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত তীরের অভিজাত হোটেল প্রাসাদ প্যারাডাইজে গিয়ে ওঠেন।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রথম বর্ষপূর্তির দিনে গত মঙ্গলবার কক্সবাজার সফরে যাওয়ার ঘটনায় গত বুধবার পাঁচ কেন্দ্রীয় নেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় এনসিপি। নোটিশে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দলের দুই শীর্ষ নেতার কাছে সশরীরে উপস্থিত হয়ে এই সফরের কারণ ও প্রেক্ষাপট সম্পর্কে লিখিত ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়। তবে সশরীর উপস্থিত না হলেও যথাসময়ে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা, উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম ও যুগ্ম আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাব দিয়েছেন বলে দলের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে। এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব (দপ্তর) সালেহ উদ্দিন সিফাত গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন।
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী ও হাসনাত আবদুল্লাহর নোটিশের জবাব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের পোস্টে প্রকাশ করা হয়েছে।
গতকাল বিকেল সোয়া ৫টার দিকে কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাব দিয়ে ফেসবুকে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘৪ আগস্ট সন্ধ্যায় জানতে পারি যে আমাদের আন্দোলনের আহত এবং নেতৃত্বদানকারী অনেক ভাই-বোনকে এই অনুষ্ঠান থেকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে। এটা আমার কাছে শুধু রাজনৈতিক নয়, নৈতিক ব্যর্থতা বলেই মনে হয়েছে। তাই আমি ব্যক্তিগতভাবে এই অনুষ্ঠানে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। যেখানে ঐক্যের পরিবর্তে বিভাজনকে, শহীদ এবং আহতদের পরিবর্তে কিছু মুষ্টিমেয় গোষ্ঠীর কথা এবং মতামতকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, সেখানে উপস্থিত থাকার কোনো ইচ্ছা বা প্রয়োজন আমি বোধ করিনি। কাজেই এর পরদিন ঢাকার বাইরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। উদ্দেশ্য ছিল এই গুরুত্বপূর্ণ সময়টিতে পূর্বে গৃহীত সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা, সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো বোঝার চেষ্টা করা এবং পরবর্তী করণীয় নিয়ে চিন্তা করা। একই সঙ্গে এটি ছিল একটি অসম্পূর্ণ জুলাই ঘোষণাপত্রের প্রতি আমার নীরব প্রতিবাদ।’
তিনি বলেন, ‘৪ আগস্ট রাতে প্রথমে আমি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি। তাঁকে না পেয়ে দলের মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীকে অবহিত করি যে, আমি আমার স্কুলবন্ধুদের সঙ্গে দুই দিনের জন্য ভ্রমণে যাচ্ছি। যেহেতু তিনি সে সময় অফিসে আহ্বায়কের সঙ্গে ছিলেন, আমি তাঁকে অনুরোধ করি যাতে তিনি আহ্বায়ককে বিষয়টি জানান। তিনি আমাকে জানান যে তিনি তা করবেন। প্রায় ৩০ মিনিট পর নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী আমাকে নিশ্চিত করেন যে তিনি আহ্বায়ককে বিষয়টি জানিয়েছেন এবং আহ্বায়ক এতে সম্মতি প্রদান করেছেন। পরবর্তী সময়ে আমার সঙ্গে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, সস্ত্রীক সারজিস আলম, তাসনিম জারা ও খালেদ সাইফুল্লাহ দম্পতি যুক্ত হন।’
বিকেল পৌনে ৫টার দিকে কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাব দিয়ে ফেসবুকে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘আমি ঘুরতে গিয়েছিলাম রাজনীতির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা নিয়ে একান্তে চিন্তা-ভাবনা করতে। সাগরের পারে বসে আমি গভীরভাবে ভাবতে চেয়েছি গণ-অভ্যুত্থান, নাগরিক কমিটি, নাগরিক পার্টির কাঠামো, ভবিষ্যৎ গণপরিষদ এবং একটি নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধানের রূপরেখা নিয়ে। আমি এটিকে কোনো অপরাধ মনে করি না, বরং একজন রাজনৈতিক কর্মীর জন্য এটি একটি দায়িত্বশীল মানসিক চর্চা।’
কক্সবাজার সফরের আগে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে বিষয়টি জানিয়েছেন বলে জানান নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী।