শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মঞ্চে গতকাল মঞ্চস্থ হয় থিয়েটারের নতুন নাটক ‘পোহালে শর্বরী’। ছবি : মোহাম্মদ আসাদ
অভাবের সংসারে বেড়ে ওঠা কন্যা শীলবতীর আপাত সুপ্রসন্ন ভাগ্য তাকে রাজস্ত্রী করে তোলে। কিন্তু মল্লরাজ্যের রাজা ওক্কাকের ধনসম্পদের কমতি না থাকলেও শরীরী বিষয়ে আছে দ্বিধা, সংশয় ও অক্ষমতা। সেই কারণে স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করতে অসমর্থ এই রাজপুরুষ এক পর্যায়ে মহামাত্যের রাজনীতির ফাঁদে পড়ে। উত্তরাধিকারী তৈরির জন্য কুমারী স্ত্রী শীলবতীকে ঠেলে দেওয়া হয় উপপতির গলায় মালা পরিয়ে দিতে।
বিজ্ঞাপন
হিন্দি ভাষার সাহিত্যিক সুরেন্দ্র বর্মার এই নাটকের বয়স প্রায় ৫০ বছর। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে মারাঠি ভাষায় এর প্রথম প্রযোজনা করেছিলেন অমল পালেকর। তারপর ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার রেপার্টরি কম্পানির জন্য হিন্দিতে তিন-তিনবার এই নাটকের নির্দেশনা দিয়েছিলেন বরেণ্য নাট্যকার রামগোপাল বাজাজ। বাংলায় এই নাটক আগে হয়নি। গতকাল বিশিষ্ট নাট্যকার ও নির্দেশক রামেন্দু মজুমদারের নির্দেশনায় প্রথমবারের মতো নাটকটির দুটি প্রদর্শনী করল দেশের সুপ্রতিষ্ঠিত নাট্যদল থিয়েটার।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রায় সমবয়সী অন্যতম পথিকৃৎ নাট্যদল থিয়েটারের ৫০ বছর পূর্তি ছিল গত ফেব্রুয়ারিতে। সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরে নতুন নাটক এনে দলটি উদযাপনটিকে স্মরণীয় করে রাখল। থিয়েটার সর্বশেষ ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে ‘মায়া নদী’ নাটকটি মঞ্চে এনেছিল। সাড়ে ছয় বছর পর প্রদর্শিত ‘পোহালে শর্বরী’ তাদের ৪৭তম প্রযোজনা। প্রদর্শনী শুরু হওয়ার আগে নাটকটির নির্দেশক রামেন্দু মজুমদার জানালেন, প্রথম দিনের প্রদর্শনীর টিকিট বিক্রি থেকে পাওয়া অর্থ বন্যার্তদের সাহায্যে ব্যয় করা হবে।
হিন্দি থেকে নাটকটি অনুবাদ করেছেন কলকাতার নাট্য সমালোচক অংশুমান ভৌমিক। রামেন্দু মজুমদারের সঙ্গে নির্দেশনায় ছিলেন ত্রপা মজুমদার। নাটকটির পোশাক পরিকল্পনা করেছেন নাট্যব্যক্তিত্ব ফেরদৌসী মজুমদার।
নির্দেশক রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘আমরা যখন নতুন নাটকের জন্য পাণ্ডুলিপির খোঁজ করছিলাম, তখন সুরেন্দ্র বর্মার এই নাটকটির সন্ধান দেন খ্যাতিমান সমালোচক প্রীতিভাজন অংশুমান ভৌমিক। বিষয়বস্তুর কথা জেনে উৎসাহিত হই, কারণ সমাজে নারীর অবস্থান আমরা আমাদের একাধিক নাটকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। ’
রামেন্দু মজুমদার আরো বলেন, “মহাভারতের যুগের ‘মাধবী’ থেকে আমাদের কালের ‘কোকিলারা’ শুধু পুরুষের প্রয়োজনেই ব্যবহৃত হয়েছে। এই নাটকে দেড়-দুই হাজার বছরের আশপাশের এক কালপর্বে নারীর কামনা-বাসনার কোনো মূল্য না দিয়ে নিছক সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করার এক কাহিনি বিধৃত হয়েছে। তার পাশাপাশি রয়েছে ধর্মের নামে গোঁড়ামি ও রাজনীতির কূটকৌশল, যার শিকার হয়েছে পুরুষও। সামাজিক বিধি-বিধান, ব্যক্তি মানস বিশেষ করে নারীর চাওয়া-পাওয়াকে মর্যাদা দিতে এখনো উদাসীন। ‘পোহালে শর্বরী’ যদি দর্শকদের এই বিষয়ে কিছুটা হলেও ভাবায়, তবেই প্রচেষ্টা অর্থবহ হয়েছে বলে মনে করবে থিয়েটার।
নাটকটিতে স্থান-কাল-পাত্রের ক্ষেত্রে শিল্পের স্বাধীনতা নিয়েছে থিয়েটার। স্থান বা পাত্র কিছুটা নির্দিষ্ট করা গেলেও কালের ক্ষেত্রে ধরাবাঁধা নিয়মে খুব একটা বাঁধতে দেখা যায়নি। পোশাক ও মঞ্চসজ্জায় সেটি ছিল স্পষ্ট। দুই বছরের বেশি সময় আগে নাটকটির কাজ শুরু করেছিল থিয়েটার। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে মাঝে প্রস্তুতি থেমে যায়। নির্দেশক রামেন্দু মজুমদার জানালেন, নাটকটির প্রতিটি চরিত্রের জন্য দুজন করে অভিনেতা তৈরি করা হয়েছে। ফলে একদিকে যেমন দলের বেশি কর্মী কাজের সুযোগ পেয়েছেন, অন্যদিকে তেমনি কারো সমস্যার কারণে যেন প্রদর্শনী আটকে না যায়, সেটিও বিবেচনায় আনা হয়েছে। তবে এতে প্রস্তুতি পর্বে দুটি প্রযোজনার সমান শ্রম ও সময় ব্যয় হয়েছে।
নাটকের উদ্বোধনী প্রদর্শনীতে ছিলেন অনুবাদক অংশুমান ভৌমিক। তিনি বলেন, “সংস্কৃতে একটি কথা আছে, ‘পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা’, অর্থাৎ পুত্রলাভই স্ত্রী সান্নিধ্যের একমাত্র উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্য যদি বংশরক্ষা ও সাম্রাজ্য রক্ষার পার্থিব উদ্দেশ্যের সঙ্গে জুড়ে যায়, তবে নারী শুধু উৎপাদনযন্ত্র হয়ে ওঠেন। তাঁর সঙ্গী পুরুষটি যদি তথাকথিত অক্ষম হন, তবে সেই নারীর বঞ্চনাকে আরো প্রকট করতে ‘নিয়োগে’র মতো প্রথা আমাদের উপমহাদেশে প্রাচীনকাল থেকেই চালু আছে। ”
নাটকটির দুটি প্রদর্শনীতে আটজন করে মোট ১৬ জন মূল শিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন। অর্থাৎ একই চরিত্রে দুজন করে শিল্পী অভিনয় করেছেন। একেক শোতে একেক শিল্পী। প্রথম প্রদর্শনীতে মহামাত্যর চরিত্রে অভিনয় করেছেন ত্রপা মজুমদার। একই চরিত্রে দ্বিতীয় প্রদর্শনীতে অভিনয় করেছেন শেকানুল ইসলাম শাহী। শীলবতী চরিত্রে দুটি প্রদর্শনীতে অভিনয় করেছেন যথাক্রমে তানজুম আরা পল্লী ও তানভিন আরা সুইটি। আরো অভিনয় করেছেন গুলশান আরা, মাহমুদা আক্তার, নাজমুন নাহার, সামিয়া মহসীন, আপন আহসান, নূর-এ-খোদা মাশুক সিদ্দীকি, মুশফিকুর রহমান, সামিরুল আহসান, তানভীর হোসেন সামদানী, রাশেদুর রহমান, রবিন বসাক, জোয়ারদার সাইফ প্রমুখ। আবহ সংগীত পরিকল্পনায় ছিলেন তানভীর আলম সজীব। কোরিওগ্রাফিতে ছিলেন স্নাতা শাহরিন।
আজও (শনিবার) জাতীয় নাট্যশালায় বিকেল সাড়ে ৫টা ও সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় ‘পোহালে শর্বরী’র পর পর দুটি প্রদর্শনী রয়েছে।