সরকারি চাকরিতে নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিচয় জানতে চাওয়ার বিধান বাতিল হচ্ছে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এখন তা বাস্তবায়ন করবে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগ।
এ ছাড়া কোনো কর্মচারী যদি কোনো পদে পদোন্নতির সর্বোচ্চ ধাপে পৌঁছে যান এবং তিনি গুরুদণ্ডে দণ্ডিত না হন, তিনিও আর্থিক সুবিধা পাবেন।
পাশাপাশি উপজেলা পরিষদকে শক্তিশালী করতে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হবে। এ ছাড়া কলেজ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটিতে সরকারি কর্মকর্তারাও থাকতে পারবেন।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন নিয়ে গত সোমবার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে এক সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে ওই দিন দ্বিতীয় সভা হয়।
এর আগে ১৬ জুন প্রথম সভায় জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ১৮টি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করা হয়। সেদিন আটটি অপেক্ষাকৃত সহজে বাস্তবায়নযোগ্য প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা ও বাস্তবায়নের বিষয়ে কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সোমবার দ্বিতীয় সভায় এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি নতুন করে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে কিছু সুপারিশ শিগগিরই বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয় বলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের পক্ষ থেকে মতামত দেওয়া হয়েছে। কিছু সুপারিশ বাস্তবায়নের বিষয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবদের সমন্বয়ে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
নিয়োগ-পদোন্নতিতে রাজনৈতিক যাচাই : দীর্ঘদিন ধরেই সরকারি চাকরিতে নিয়োগ ও পদোন্নতিতে পুলিশ-গোয়েন্দাদের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় প্রার্থী ও পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীর নিজের ও তাঁর আত্মীয়স্বজনের রাজনৈতিক পরিচয় খোঁজা হয়। এর মাধ্যমে অনেক সময় চাকরির সুপারিশ পেয়েও অনেক প্রার্থীকে ‘বিরূপ মন্তব্যের’ কারণে নিয়োগ দেওয়া হয় না। একই কারণে অনেক যোগ্য কর্মকর্তা পদোন্নতি পান না।
এ নিয়ে প্রবল আপত্তি থাকলেও বছরের পর বছর ধরে তা চলে আসছে। এমন পরিস্থিতিতে পদোন্নতির ক্ষেত্রে পুলিশ বা কোনো গোয়েন্দা বিভাগের কাছে রাজনৈতিক পরিচয় জানতে চাওয়ার প্রথা বাতিল করার সুপারিশ করে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন।
বাতিল হচ্ছে পুলিশ ভেরিফিকেশন : চাকরির লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ফল ঘোষিত হওয়ার আগে কোনো প্রার্থীর পুলিশ ভেরিফিকেশন করা যাবে না। বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় চূড়ান্ত নিয়োগের আগে পুলিশ বিভাগের কাছে শুধু সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা আছে কি না, সে সম্পর্কে প্রতিবেদন চাইবে। প্রয়োজনে মন্ত্রণালয় দুর্নীতি দমন কমিশনে প্রতিবেদন চাইতে পারে। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, জননিরাপত্তা বিভাগ ও সুরক্ষা সেবা এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে।
চুক্তিতে নিয়োগ : প্রস্তাবিত ‘সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিসের’ বাইরে ৫ শতাংশ পদে সরকার বিশেষ কোনো যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে চুক্তিভিত্তিক যুগ্ম সচিব বা সংস্থাপ্রধান পদে নিয়োগের সুপারিশ করেছিল সংস্কার কমিশন। প্রচলিত পদ্ধতিতে বিশেষ কোটায় পার্শ্বনিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের সততা ও দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন আছে বলে আলোচনা হয়। পরে সিদ্ধান্ত হয়, এ নিয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ ও স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবের সমন্বয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ একটি কমিটি করবে। কমিটি এ বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দেবে।
পদোন্নতি না হলেও আর্থিক সুবিধা : জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ছিল, কোনো কর্মচারী যদি কোনো পদে পদোন্নতির সর্বোচ্চ ধাপে পৌঁছে যান এবং এরপর আর ইনক্রিমেন্ট না পান ও বিভাগীয় মামলায় গুরুদণ্ডে দণ্ডিত না হন, তাহলে তাঁকে দুই বছর পর পরবর্তী বেতন স্কেল দেওয়া।
এ বিষয়ে সোমবারের সভায় অর্থ বিভাগের সচিব বলেন, পরবর্তী পে স্কেলের মাধ্যমে এই সুপারিশ বাস্তবায়ন করা সমীচীন হবে। এ অবস্থায় সভায় সিদ্ধান্ত হয়, এই সুপারিশ বাস্তবায়নে আর্থিক সংশ্লেষ থাকায় এ বিষয়ে বিস্তারিত পর্যালোচনা করে অর্থ বিভাগ ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে প্রস্তাব দেবে।
উপজেলা পরিষদ শক্তিশালী করতে কমিটি : উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) উপজেলা পরিষদের অধীন ন্যস্ত না রেখে তাঁদের সংরক্ষিত বিষয়, যেমন—আইন-শৃঙ্খলা, ভূমি ব্যবস্থাপনা, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা ইত্যাদি বিষয়ে দেখাশোনার ক্ষমতা দেওয়ার সুপারিশ করেছিল জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। এর উদ্দেশ্য হলো তাঁকে রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে রাখা। এ ক্ষেত্রে একজন সিনিয়র সহকারী সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে উপজেলা পরিষদের সচিব পদে নিয়োগ করতে বলেছে কমিশন। এখন সিদ্ধান্ত হয়েছে, এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ ও অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব বা সচিবদের সমন্বয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ একটি কমিটি গঠন করবে। এই কমিটি কমিশনের ওই সুপারিশ বাস্তবায়নের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দেবে।
স্থায়ী জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন : জনপ্রশাসন সংস্কার কার্যক্রম চলমান বিষয় হওয়ায় এ নিয়ে একটি স্বাধীন ও স্থায়ী জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছিল জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ এবং আইন ও বিচার বিভাগের সচিবদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হবে, যাঁরা এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দেবেন। এ ছাড়া ভূমি রেজিস্ট্রেশন দপ্তর আইন মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন ন্যস্ত করার সুপারিশ শিগগিরই বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে সোমবারের সভায় মতামত দেন আইন ও বিভাগের প্রতিনিধিরা। পরে সভায় আলোচনা হয়, এ বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এবং প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।
আগের ৮ বিষয়ে যেসব সিদ্ধান্ত হলো : গত ১৬ জুনের সভায় অপেক্ষাকৃত সহজে বাস্তবায়নযোগ্য আটটি প্রস্তাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা ও বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এসবের অগ্রগতি নিয়েও সোমবারের সভায় আলোচনা করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যান্য কাজ শেষ করে ২৫ জুলাইয়ের মধ্যে কলেজ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি গঠন সংক্রান্ত নীতিমালা জারি করা হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া এক মাসের মধ্যে মন্ত্রণালয় বা বিভাগের গুচ্ছে থাকা (ক্লাস্টার) ওয়েবসাইটগুলোর ইন্টারফেস পরিবর্তনসহ ওয়েবসাইট হালনাগাদ করতে হবে। সব সরকারি দপ্তরে নির্দিষ্ট বিরতিতে গণশুনানি নিশ্চিত করার বিষয়ে এুসংক্রান্ত সংশোধিত পরিপত্র ২৪ জুলাইয়ের মধ্যে জারি করতে হবে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতন হলে গত বছরের ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এরপর রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের লক্ষ্যে প্রথমে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনসহ ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। পরে আরো পাঁচটি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনগুলো তাদের প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দিয়েছে।