<p>আলাউদ্দিন আলী ছিলেন যন্ত্রবাদক। প্রথম দিকে দেখতাম স্টুডিওতে বেহালা বাজাতেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যে মানুষের সঙ্গে মিশতে পারার গুণ ছিল তাঁর। স্বাধীনতার এক কী দুই বছর পরের কথা। হঠাৎ একদিন আমাকে বললেন, একটি ছবিতে সংগীত পরিচালনা করার সুযোগ পেয়েছেন। আমাকে দিয়ে প্রথম গানটি গাওয়াতে চান। কোনো আপত্তি আছে কি না! আমি বললাম, আপত্তি থাকবে কেন? ছবিটির নাম আমার মনে নেই। মনে থাকারও কথা নয়। কারণ ছবিটি কখনো আলোর মুখ দেখেনি। ‘ও আমার বাংলা মা’ নামের সেই গানটি পরবর্তী সময়ে আমি টেলিভিশনে গেয়েছিলাম। এরপর তো হৈচৈ পড়ে গেল। গানটি প্রশংসিত হলো। আলাউদ্দিন আলী নামটিও ছড়িয়ে পড়ল সবদিকে।</p> <p>তাঁর বাবা ছিলেন একজন যন্ত্রশিল্পী। সেই সূত্রে সংগীতটা তাঁর মনের ভেতর গাঁথা ছিল। তাঁর পরিবারের অনেকেই তখন রেডিও ও টেলিভিশনের সংগীত পরিচালক। তাই ছোটবেলা থেকেই হয়েছিল সংগীতের হাতেখড়ি। আমার প্রতি একটি আলাদা টান ছিল তাঁর। কোনো ছবির সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব পেলেই হয়েছে। আমাকে একটি গানের জন্য হলেও তাঁর চাই। আমিও খুব হাসি মুখে তাঁর রেকর্ডিংয়ে হাজির হতাম। হাদী ভাই, আমি, আমজাদ ভাই আর আলী। আমাদের এই চারজনের গান মানেই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার—এমন একটি রীতিও তখন চালু ছিল।</p> <p>আলী খেতে খুব ভালোবাসতেন। আরো ভালোবাসতেন অন্যকে খাওয়াতে। একটি স্মৃতির কথা না বললেই নয়। একদিন রেকর্ডিং করতে করতে কখন যে রাত ১টা বেজে গেছে জানি না। রাত ১২টার পরই আমার জন্মদিন। আলী কিভাবে যেন জেনে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে জাহাঙ্গীরকে (আলীর সহযোগী) পাঠালেন শেরাটনে। সেই রাতে আনলেন কেক। ঘটা করে উদ্যাপন করলেন জন্মদিন। মানুষটা আমার চোখে উপমহাদেশের অন্যতম সেরা সুরকার ও সংগীত পরিচালক। কিন্তু বিন্দুমাত্র অহংকার তাঁর মধ্যে কখনো পাইনি। সব সময় শিশুসুলভ আচরণ করতেন। তাঁর হাসির মধ্যে ছিল সারল্যভাব। আলীর সংগীত পরিচালনায় শেষ কাজ করেছিলাম বছর দুই আগে। ছট্কু আহমেদের পরিচালনায় ছবিটির নাম ছিল মনে হয় ‘দলিল’। সেদিন গানটি গাইতে গিয়ে আমি আর এন্ড্রু (এন্ড্রু কিশোর) কেঁদে ফেলেছিলাম। কে জানত এই গানটিই হবে আলী, আমি আর এন্ড্রুর জীবনের শেষ গান!</p> <p>অসুস্থ থাকাকালে প্রায়ই আমার সঙ্গে আলীর কথা হতো। বারবার ‘আদরের সন্তান’ ছবির ‘সময় হয়েছে ফিরে যাবার’ গানটি গাইতে বলতেন। আমি গাইতাম। ওপাশ দিয়ে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসত। খুব মন খারাপ হতো, কিন্তু বুঝতে দিতাম না। সাহস রাখার ভান ধরে বলতাম, কিছুই হবে না আপনার। দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন। অনেক গান বাকি। আমার জন্য নতুন গানের সুর করেন। তিনি আমার এমন কথায় খুব খুশি হতেন। কয়েক দিন আগে তাঁকে কথা দিয়েছিলাম, করোনা একটু নিয়ন্ত্রণে এলেই দেখতে যাব। কিন্তু সেই সৌভাগ্য আর হলো না। আল্লাহ আমাদের কাছ থেকে তাঁকে কেড়ে নিয়ে গেলেন। তাঁর অভাব আর কখনো আমরা পূরণ করতে পারব না। আমার বিশ্বাস আলী বেহেশতে জায়গা পাবেন। যে মানুষ এত সুন্দর সুর করতে পারেন, এত মানুষের মনে তৃপ্তি দিয়েছেন, আল্লাহ তাঁকে কখনো ঠকাবেন না, নিশ্চয়। কারণ আল্লাহ মহান।</p> <p>অনুলিখন : সুদীপ কুমার দীপ</p>