১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর। আজকের এই দিনে ঢাকা থেকে এমন একটি বিনোদনমাধ্যমের যাত্রা শুরু হলো যার সঙ্গে কেবল ঢাকা নয়, এই উপমহাদেশের মানুষেরই পূর্বপরিচয় ঘটেনি। মানবসভ্যতার ইতিহাসে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টিকারী টেলিভিশন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ৩৫ বছর পর যাত্রা শুরু করল পাকিস্তান টেলিভিশন, যা আজকের বাংলাদেশ টেলিভিশন বা বিটিভি।
তৎকালীন সরকারের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় টেলিভিশন সম্প্রচার শুরুর প্রস্তাবটি করেন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব জামিল চৌধুরী।
এমন প্রস্তাবে বিস্মিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা। জামিল চৌধুরীকে তখন পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল- এমন একটা শহরে তিনি বাণিজ্যিক টেলিভিশন তৈরির প্রস্তাব করেছেন যে শহরে রয়েছে মাত্র দুটি চায়নিজ রেস্তোরাঁ, তিনটি নিয়ন সাইন (ভিক্টোরিয়া পার্ক, ডিআইটি ভবন ও গুলিস্তানে) আর গাড়ি চলাচলের জন্য পুরো শহরে তিনটি সিগন্যাল বাতি। একজন ট্রাফিক পুলিশ সদস্য টিনের চোঙ দিয়ে গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণ করেন। এই যখন ঢাকার অবস্থা তখন টেলিভিশনের মতো একটা আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর গণমাধ্যমের সঙ্গে ঢাকা শহরের লোকদের পরিচয় হবে, ব্যাপারটি খুব স্বাভাবিক ছিল না। এর পরও জামিল চৌধুরীর একান্ত চেষ্টায় ঢাকার সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিং সিদ্ধেশ্বরীর ডিআইটি ভবন (উচ্চতা ১৪২ ফুট) থেকে শুরু হয় টেলিভিশনের অনুষ্ঠান সম্প্রচার। এভাবেই বিটিভির সম্প্রচার শুরুর সময়ের কথা লিপিবদ্ধ করেছেন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ফরিদুর রেজা সাগর তাঁর 'একজীবনে টেলিভিশন' গ্রন্থে।
জামিল চৌধুরীর সঙ্গে টেলিভিশনের অনুষ্ঠান পরিচালক হিসেবে যোগ দিলেন চিত্রশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার, রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী কলিম শরাফী, তারপর নাট্যকার আবদুল্লাহ আল মামুন প্রমুখ। মুস্তাফা মনোয়ার সেই সময়ের স্মৃতিচারণা করে বলেন, 'যখন যুক্ত হই তখন খুবই তরুণ ছিলাম।
জীবনে কখনো টেলিভিশন দেখিনি। দারুণ ভয় ছিল। আমরা আশ্চর্যজনকভাবে দ্রুততার সঙ্গেই শিখেছিলাম। স্বল্পতার মধ্যেও যে শেখা যায় তা প্রমাণ করেছি। তখন সেরা মেধাবীরা যুক্ত হয়েছিল টেলিভিশনের সঙ্গে। এখন এত এত টেলিভিশন হয়েছে, অনুষ্ঠান হচ্ছে; কিন্তু একটি অনুষ্ঠানের কথা কেউ বলতে পারবে না যা আমরা বিটিভিতে করিনি।'
নতুন টেলিভিশনটির অন্যান্য কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন কীর্তিমান ব্যক্তিত্বরা। নকশা ও ডিজাইন করেছিলেন ড. মিজানুর রহমান শেলী। লোগো ডিজাইন করেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। টেকনিক্যাল ইংরেজি শব্দগুলোর বাংলা করে দেন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী। অনুষ্ঠানমালায় যুক্ত হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপক ও আজকের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
শুরুর সময় সম্পর্কে জানা যায়, ডিআইটি ভবনে মাত্র ২০৪০ বর্গফুট আয়তনের একটি স্টুডিও থেকে শুরু হয়েছিল সম্প্রচার। সম্বল বলতে ছিল মাত্র দুটি ক্যামেরা। অনুষ্ঠান ও সংবাদ সবই হতো লাইভ। সম্প্রচার উদ্বোধন করেছিলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান। সঙ্গে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান। পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহর সমর্থকদের রাজনৈতিক বিক্ষোভের মুখে সম্পন্ন হয়েছিল উদ্বোধনী অনুষ্ঠান।
প্রথম যে অনুষ্ঠানটি দর্শকরা পর্দায় দেখতে পেয়েছিলেন তা ছিল একটি বিদেশি ছায়াছবি। তারপর ছিল গানের অনুষ্ঠান। গান করেছিলেন ফেরদৌসী রহমান। বিটিভিতে তিনি প্রথম যে গানটি গেয়েছিলেন সেটি ছিল- 'ঐ যে আকাশ নীল হলো আজ সে শুধু তোমার প্রেমে। ঐ যে বাতাস বাঁশি হলো আজ সে শুধু আমার প্রেমে...'। গানটি রচনা করেন গীতিকার আবু হেনা মোস্তফা কামাল। সুর করেন সংগীতজ্ঞ আনোয়ার উদ্দীন খান। ডিআইটি বিল্ডিংয়ের সবুজ চত্বরে প্রেসিডেন্টের উদ্বোধনের পর মাইক্রোফোন হাতে শিল্পী গানটি করেছিলেন।
ফেরদৌসী রহমান বলেন, 'সে এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা। গানটি করে খুবই রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। সবুজ বাংলাদেশের কথা ভেবে সেদিন পরেছিলাম সোনালি পাড়ের সবুজ শাড়ি। গায়ে ছিল লাল চাদর। কপালে ছিল টিপ।' দ্বিতীয় দিনে সন্জীদা খাতুন ও জাহেদুর রহিমের নেতৃত্বে ছায়ানটের শিল্পীরা নাচ ও গানের অনুষ্ঠান করেন।
প্রথম দিকে অনুষ্ঠান সম্প্রচার হতো সপ্তাহে ছয় দিন। সোমবার বন্ধ। প্রতিদিন ছিল তিন ঘণ্টার অনুষ্ঠান- সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা। ঢাকা শহরের ১০ মাইল এলাকায় প্রথম দিককার অনুষ্ঠান দেখা যেত। প্রথম দিকে অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হতো সাদা-কালো। ১৯৮০ সালে এসে রঙিন অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয়।
বাংলা ভাষার প্রথম এই টিভি সম্প্রচার কেন্দ্রে শুরু থেকেই সংবাদ প্রচার ছিল সরকার নিয়ন্ত্রিত। পাকিস্তান বেতার থেকে যে সংবাদ প্রচার করা হতো সেগুলোই প্রচারিত হতো এই টেলিভিশনে। অনুষ্ঠান সাজানো হতো প্রথমে একটি বিদেশি সিরিয়াল, তারপর একটি স্টুডিও অনুষ্ঠান, এরপর আবার বিদেশি সিরিয়াল। প্রথম সিরিয়ালটি থাকত ২৫ মিনিটের, পরেরটি ৫০ মিনিটের। যেহেতু লাইভ অনুষ্ঠান তাই যে সময় প্রথম সিরিয়াল কিংবা ছায়াছবি চলত সে সময় স্টুডিওর সেট তৈরি হতো। মাত্র ২০ মিনিটেই তৈরি হতো গানের অনুষ্ঠানের সেট।
পরবর্তীকালে বিটিভি অনেক কালজয়ী নাটক, তথ্য-বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, গানের অনুষ্ঠান দর্শকদের উপহার দিয়েছে। আজও সেসব অনেকের স্মৃতিতেই উজ্জ্বল হয়ে আছে। বিটিভিতে অনুষ্ঠান করে নন্দিত হয়েছেন কণ্ঠশিল্পী, অভিনয়শিল্পী ও উপস্থাপকরা। পরিচিতি পেয়েছেন দেশজুড়ে। এই তো সেদিন পর্যন্তও বিটিভির সাপ্তাহিক নাটক উপভোগ করার জন্য প্রতীক্ষার প্রহর গুনত সারা দেশের দর্শক।
কালের পরিক্রমায় বিটিভি ডিআইটির ক্ষুদ্র পরিসর থেকে রামপুরায় বৃহৎ পরিসরে স্থানান্তরিত হয়েছে। সম্প্রচারিত হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। বিটিভি কেবল বাংলাদেশ কিংবা উপমহাদেশের প্রথম টেলিভিশন নয়, প্রথম বাংলা টেলিভিশনও। আগেও ছিল এবং এখনো বিটিভিই দেশের একমাত্র টেরিস্ট্রিয়াল টেলিভিশন। সাধারণ এন্টেনা দিয়ে দেশের ৯৫ শতাংশ এলাকা থেকে দেখতে পাওয়ার কথা। সারা দেশে সম্প্রচারিত হওয়ার কারণে বিপুল দর্শকের কাছে পৌঁছে গেছে বিটিভি। এ কারণে বিজ্ঞাপনদাতাদেরও আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল এই গণমাধ্যম। তাই বেশ লাভজনক প্রতিষ্ঠান ছিল এটি। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তরকালে বিভিন্ন সরকার রাজনৈতিক স্বার্থে বিটিভিকে ব্যবহার করায় বর্তমানে বিটিভি তার দর্শক ও গৌরব হারিয়েছে। এখন প্রতিষ্ঠানটি চলছে ভর্তুকি দিয়ে। গণমাধ্যম-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার ছাড়াও মেধা সংকটের কারণে বিটিভি অনুষ্ঠানের মান ধরে রাখতে পারেনি।
বিটিভির আজ ৫০ বছর পূর্ণ হচ্ছে। এ উপলক্ষে শুরু হচ্ছে সাত দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা। বিকেল ৩টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন ঘোষণা করবেন। গতকাল বুধবার বিটিভি ভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বিটিভির সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানমালার পাশাপাশি ৩০০ পৃষ্ঠার স্মারক সংকলন এবং ২০০ পৃষ্ঠার অ্যালবাম প্রকাশ করা হবে। অন্য অনুষ্ঠানমালার মধ্যে থাকবে শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সম্প্রচার ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ৫০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে সম্মাননা প্রদান। আয়োজন করা হবে বিটিভি-সংশ্লিষ্টদের পুনর্মিলনীর অনুষ্ঠানের। এ ছাড়া বিশেষ নাটক ও সংগীতানুষ্ঠান সম্প্রচার করা হবে।
সংবাদ সম্মেলনে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, তথ্যসচিব মরতুজা আহমদ, বিটিভির মহাপরিচালক আসাদ মান্নান প্রমুখ বক্তব্য দেন।