ঢাকা মোহামেডানের জন্মের ৩৮ বছর আগে আত্মপ্রকাশ ময়মনসিংহ মোহামেডানের! বাংলার ক্রিকেটের জনকখ্যাত সারদা রঞ্জন রায়ের আদি বাড়ি ময়মনসিংহে। মুক্তাগাছার জমিদার স্নেহাংশু কান্ত আচার্য ছিলেন ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গলের (সিএবি) প্রেসিডেন্ট। জনশ্রুতি ছিল ময়মনসিংহের লোকাল ট্রেন ঢাকায় না পৌঁছলে ক্রিকেট লিগের খেলাই মাঠে গড়াত না! এমনকি ১০১ ভরি রুপার তৈরি লীলাদেবী শিল্ড শুধু ময়মনসিংহের নয়, বাংলাদেশের ফুটবলেরই অন্যতম প্রাচীন টুর্নামেন্ট। ক্রীড়াঙ্গনের এমন ঐতিহ্য যে জেলার সেখানকার স্টেডিয়ামের বাইরে 'রাস্তার ছেলের চেয়ে মাঠের ছেলে ভালো' লেখাটা পড়ে খুব বেশি বিস্মিত হওয়ার নেই।
ক্রীড়া ঐতিহ্যের ময়মনসিংহ

দিনবদলের পানসিতে চড়ে ময়মনসিংহবাসী পেয়েছে নতুন বিভাগ। ক্রীড়াঙ্গনও এখন প্রতীক্ষায় নতুন সাজের রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া স্টেডিয়ামে নতুন পথচলার। শহরের কাচিঝুলি এলাকায় প্রায় ১৮ একর জায়গায় নির্মিত স্টেডিয়ামে ১৯৬৮ সালে মোনেম খান গোল্ড কাপে মোহামেডান-ইপিআইডিসি ম্যাচ দিয়ে খেলা গড়ায় মাঠে। স্টেডিয়ামের উন্নয়নে ২০১২ সালে ১৬ কোটি টাকায় শুরু হয় উন্নয়নকাজ।
১৯০১-১৯০২ মৌসুমে গঠিত হয়েছিল তিন সদস্যের ময়মনসিংহ স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশন (এমএসএ)। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শ্রী রমনীকান্ত চৌধুরী ও সদস্য মহারাজা শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী। এর পর থেকে স্থানীয় জমিদার, প্রশাসক, শিক্ষক, চিকিৎসক, ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষকতায় পুরো ভারতবর্ষেই সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল ক্রীড়াঙ্গনের। তবে গত ১৫ বছরের চিত্রটি হতাশার। আর্থিক সহযোগিতার জন্য ধনাঢ্য ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতা নেই।
ময়মনসিংহে ফুটবলের আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু ১৯১৪ সালে লীলাদেবী শিল্ড ও সূর্যকান্ত শিল্ড দিয়ে। সেই বছর জেলার মুক্তাগাছা উপজেলায় এশিয়াটিক ইউনাইটেড ক্লাবের উদ্যোগে হয়েছিল এই দুটো শিল্ড। লীলাদেবী শিল্ড ১০১ ভরি রুপা দিয়ে তৈরি। ১৯১৮ সাল থেকে এটিকে আনা হয় স্কুল পর্যায়ে। সেই থেকে এটার আয়োজন করে আসছিল জেলা স্কুল। ১০০ বছর পূর্তির আগে এটা বন্ধ করে দেওয়ায় ক্ষুব্ধ স্থানীয়রা। ফুটবল লিগের শুরু ১৯১৮ থেকে ১৯২০ সালের কোনো একসময়ে। জমিদারি প্রথার সময় বিভিন্ন জমিদারের একটা করে ফুটবল দলও ছিল ময়মনসিংহে। লীলাদেবী শিল্ডের মতো আকর্ষণীয় ছিল সুরেন্দ্র সরোজিনী শিল্ড, থমসন কাপ, মোনেম খান গোল্ড কাপ ও আন্ত মহকুমা তাজমহল শিল্ড। সর্বশেষ আশির দশকে হওয়ার পর বন্ধ হয়ে গেছে সূর্যকান্ত শিল্ড। তাজমহল শিল্ড এখন জেলা প্রশাসক গোল্ড কাপ। জেলার ফুটবল লিগের যেমনই হাল হোক না কেন, উপজেলাগুলোকে নিয়ে এই জেলা প্রশাসক গোল্ড কাপ একপ্রকার নিয়মিত।
১৯৩৮ সালে ভারতের বিখ্যাত কলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব প্রদর্শনী ম্যাচে ড্র করেছিল ময়মনসিংহ মোহামেডানের সঙ্গে। ১৯৩৯ সালে লক্ষ্নৌর 'ইন্ডিয়ান ফুটবল কাপ'-এ অংশ নিয়ে শিরোপাই জিতেছিল ময়মনসিংহের ফ্রেন্ডস ইলেভেন ক্লাব। ১৯৪৩ সালে কলকাতা লিগ জেতার পর ইস্ট বেঙ্গলের মতো ক্লাব ৩-২ গোলে হেরে গিয়েছিল ময়মনসিংহ জেলা দলের কাছে। ফুটবলে শক্তিশালী দল থাকায় ১৯৫১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আন্তজেলা ফুটবল টুর্নামেন্ট চালু হলে প্রথমবারই শিরোপা জেতে ময়মনসিংহ। ১৯৫২ সালে রানার্সআপ হওয়ার পর ১৯৫৩ সালে আবারও শিরোপা জেতে তারা। শেরেবাংলা কাপ বা সোহরাওয়ার্দী কাপে কখনো শিরোপা না জিতলেও ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ফুটবল রমরমা ছিল এ জেলায়। কিন্তু সারা দেশের মতো এ জেলাতেও একসময় ঝিমিয়ে পড়ে ফুটবল। এর মধ্যেও ২০১৫ সালে জেএফএ অনূর্ধ্ব-১৪ ফুটবলের প্রথম আসরের ফাইনালে টাঙ্গাইলকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছে ময়মনসিংহ মহিলা জেলা ফুটবল দল। ধোবাউড়ার প্রত্যন্ত এলাকার কলসিন্দুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের নিয়ে গড়া হয়েছিল এই দল। এই স্কুলের মেয়েরাই জাতীয় বঙ্গমাতা স্কুল টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে দুবার। জাতীয় মেয়েদের ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন একবার আর গ্রীষ্মকালীন আন্তস্কুল প্রতিযোগিতাতেও সেরা একবার।
জেলায় আছে তিনটি স্টেডিয়াম ও ১১৮টি মাঠ। জেলা স্টেডিয়ামের পাশাপাশি সদর থেকে চার কিলোমিটার দূরের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আছে আরেকটি স্টেডিয়াম। অন্য স্টেডিয়ামটি গৌরীপুর উপজেলায়। মাঠগুলোর মধ্যে বিখ্যাত সার্কিট হাউস মাঠ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর খেলা মাঠে গড়ায় এখানে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এখানে দুটো ড্রেসিংরুম করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনো হয়নি সেটা।
বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই নিয়মিত ক্রিকেট লিগ আর মহারাজা কাপ টুর্নামেন্ট হতো ময়মনসিংহে। এই জেলার গণেশ ভট্টাচার্য, কার্তিক বোস, বাদল চন্দ, বিকাশ রায়, চুনী গোস্বামী, হেমাঙ্গ মোহন বোসসহ অনেকে সুনাম অর্জন করেছিলেন কলকাতার মাঠে খেলে। ১৯২৯ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত ঢাকায় অনুষ্ঠিত জ্যাকসন কাপে টানা তিনবার শিরোপা জিতেছিল ময়মসিংহ ফ্রেন্ডস ক্লাব। ১৯৩৭ সালে 'নাথান কাপ'-এর ফাইনালে শক্তিশালী ওয়ারীকে অবলীলায় হারিয়েছিল ময়মনসিংহের পণ্ডিতপাড়া অ্যাথলেটিকস ক্লাব। সে সময় কলকাতার সিসিবি, ঢাকার ওয়ারী বা ভিক্টোরিয়ার মতো দলগুলো নিয়মিতই খেলতে আসত ময়মনসিংহে। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর অনেক হিন্দু ক্রিকেটার পাড়ি জমান ভারতে। তবে গ্রিন স্পোর্টিং, মুকল ফৌজ অ্যাথলেটিক ক্লাব, কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাবের মতো নতুন কিছু দলের আবির্ভাবে থমকে যায়নি জেলার ক্রিকেট। পঞ্চাশ দশকে দুর্গা দাস বিকাশ, ডা. দামাল, এল রহমান মাখন, খগেন সরকাররা ঢাকার ক্রিকেটে নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ রাখেন। সেই ধারাটা ষাট বা সত্তরের দশকের পর ধরে রাখেন রামচাঁদ গোয়ালা, আমির আহমেদ চৌধুরী রতন, হাবিবুর রহমান ভুলুরা।
১৯৭৪-৭৫ সালে ময়মনসিংহ লিগে প্রথম প্রতি দল ৪০ ওভার খেলার প্রচলন হয়। ১৯৭৬-৭৭ সালে হয়েছিল সুপার লিগের প্রচলন। প্রিমিয়ার ডিভিশন শুরু ১৯৯৯ থেকে। এমনও হয়েছে জাতীয় দলের ক্যাম্পে একসঙ্গে ময়মনসিংহেরই কয়েকজন খেলোয়াড়। সেই চিত্রটা আর নেই। বলার মতো সর্বশেষ দুটি সাফল্য ১৯৮৯ সালে নির্মাণ ক্রিকেটের ফাইনালে বিকেএসপিকে হারিয়ে মুকুল নিকেতন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিরোপা জয়। আর ২০১১ সালে জেলা দলের জাতীয় ক্রিকেট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে খেলা। বয়সভিত্তিক জাতীয় ক্রিকেটে ঢাকা উত্তরে অনূর্ধ্ব-১৮তে সবচেয়ে বেশিবারের চ্যাম্পিয়ন ময়মনসিংহ জেলা দল। অনূর্ধ্ব-১৪ ক্রিকেটে জাতীয় চ্যালেঞ্জ কাপে ২০১১-১২ মৌসুমের রানার্সআপ তারা। অনূর্ধ্ব-১৬তেও প্রায় সময়ই খেলে আঞ্চলিক সেমিফাইনাল বা ফাইনালে।
হকিতে ১৯২০ সালে স্থানীয় পণ্ডিতপাড়া এসি ক্লাব 'বাইটন কাপ' ও 'লক্ষ্মীবিলাস কাপ'-এ অংশ নিয়েছিল। ১৯৬৪ সালে ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজ হকি দল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আন্তকলেজ প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের মাহবুবুল এহসান রানা ২০০৪ সালে বাংলাদেশ হকি দলের অধিনায়ক ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে 'ব্লু' পেয়েছিলেন শিবলী। দেশব্যাপী সুনাম অর্জন করেছিলেন শাহীন হালিম ডনও। সেই হকিরও করুণ হাল। লিগই হয়নি গত চার বছর।
চল্লিশের দশকে অ্যাথলেটিকসে সুনাম ছিল রাম সেন, শান্তি মুখার্জি, মতিয়ার রহমান, রাখাল মজুমদার, মকবুল হোসেন, অরবিন্দ গুহ রায়, গোলাম আলী, আব্দুল মান্নান খান, সরোজ ঘোষদের। জাহাঙ্গীর ফয়েজ ১১০ মিটার হার্ডলসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান গেমসে প্রথম হয়েছিলেন। শহীদ শাহেদ আলী ৪০০ মিটার দৌড়ে একাধিকবার প্রাদেশিক প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন। আল বদর বাহিনী ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে এ কৃতী খেলোয়াড়কে নির্মমভাবে হত্যা করে। সরোজ ঘোষ, রেহান আলী, জাহাঙ্গীর ফয়েজ, নজরুল ইসলাম রুমি, মাহমুদা খাতুন, জেসমিন আক্তার, খাদিজা বেগম, মোরসেলিনা, ফিরোজা খাতুন, মৌসুমী আক্তার, মার্জিয়া খাতুনরাও ময়মনসিংহের অ্যাথলেটিকসের স্বনামধন্য নাম। ১৯৭৭ সালে প্রথম বিভাগীয় অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় ১২ সোনা, ৭ রুপা, ১০টি ব্রোঞ্জ নিয়ে রানার্সআপ হয়েছিল ময়মনসিংহ। একটা সময় আনন্দমোহন কলেজের বার্ষিক ক্রীড়াও আনন্দঘন একটা দিন বয়ে নিয়ে আসত পুরো জেলায়।
মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, পণ্ডিতপাড়া, প্রেসক্লাব, আনন্দমোহন কলেজ, অফিসার্স ক্লাবে একসময় টেবিল টেনিস ছিল ভীষণ জনপ্রিয়। এখন খেলাটি ধরে রেখেছে কেবল মোহামেডান। আর লন টেনিস হয় কেবল ময়মনসিংহ অফিসার্স ক্লাবে। ২০১২ সালে প্রথমবারের মতো হয় বাস্কেটবল লিগ। এই খেলায় সেরা অর্জন মুকুল নিকেতন উচ্চ বিদ্যালয়ের জাতীয় আন্তস্কুল বাস্কেটবলে রানার্সআপ হওয়া। ময়মনসিংহ প্রেসক্লাব অঙ্গনে প্রায় এক দশক ইভিনিং রিক্রিয়েশন ক্লাবের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়েছে ব্যাডমিন্টন। জাতীয় ক্রিকেটার মাহমুদ উল্লাহর বাবা ওবায়েদ উল্লাহ ছিলেন জেলার স্বনামধন্য ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড়।
জেলার মহিলা ক্রীড়াঙ্গনের চিত্রটা বেশ ভালো। জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থার আলাদা মাঠ রয়েছে। রয়েছে নিজস্ব কার্যালয়। খেলাধুলার চর্চাও নিয়মিত। ২০১০ সালে অ্যাথলেটিকসে বিভাগীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ময়মনসিংহ। ২০১৩ সালে জোনাল অঞ্চলের কাবাডিতে তারা চ্যাম্পিয়ন আর ভলিবলে হয়েছিল রানার্সআপ। একটা সুইমিংপুল থাকলেও জাতীয়ভাবে সাফল্য পাওয়া কোনো সাঁতারু উঠে না আসাও ব্যর্থতা ময়মনসিংহের।
সম্পর্কিত খবর