<p>কাব বিন মালিক (রা.) নিজের সম্পর্কে বর্ণনা করেন, তাবুক যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করার পর আল্লাহ যখন তাঁকে ক্ষমা করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) ফজরের নামাজের সময় আমাদের ক্ষমা লাভের ঘোষণা দেন। তখন দলে দলে মানুষ আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এবং তওবার জন্য অভিনন্দন জানায়। তারা বলে, ‘আল্লাহর ক্ষমা লাভের জন্য তোমাদের অভিনন্দন।’ অতঃপর আমি মসজিদে প্রবেশ করলাম। রাসুল (সা.) সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর চতুষ্পার্শ্বে মানুষ ছিল। তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ (রা.) আনন্দের সঙ্গে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। আমার সঙ্গে মুসাফা করলেন এবং অভিনন্দন জানালেন। এ ছাড়া মুহাজির বা অন্য কেউ এগিয়ে এলো না। বিষয়টি তালহা পছন্দ করল না। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৪৪১৮)</p> <p>আলোচ্য হাদিস দ্বারা নবী যুুগের মুসলিম সমাজের দুটি অভ্যাস সম্পর্কে জানা যায়। এক. কেউ ভালো কাজ করলে বা দ্বিনি বিষয়ে সাফল্য লাভ করলে তাকে অভিনন্দন জানানো। দুই. কোনো ব্যক্তির সম্মানে দাঁড়িয়ে যাওয়ার সাধারণ রীতি ছিল না।</p> <p> </p> <p><strong>কারো সম্মানে দাঁড়ানোর সাধারণ বিধান</strong></p> <p>হাফিজ ইবনে হাজার আস্কালানি (রহ.)-এর মতে, সম্মানিত ব্যক্তির প্রতি সম্মান জানাতে দাঁড়ানো বৈধ। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) ইকরামা (রা.)-এর আগমনের সময় দাঁড়িয়েছিলেন এবং সাদ বিন মুয়াজ (রা.) এলে সাহাবিদের বলেন, ‘তোমরা তোমাদের নেতার জন্য দাঁড়াও।’ (ফাতহুল বারি : ১১/৪৯)</p> <p>আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) ও খোলাফায়ে রাশেদার যুগে কারো সম্মানে দাঁড়ানোর সাধারণ রীতি ছিল। সাহাবিরা রাসুল (সা.)-কে দেখলেই দাঁড়িয়ে যেতেন না। যেমনটি বর্তমান যুগের কেউ কেউ করে থাকে। আনাস বিন মালিক (রা.) বলেন, সাহাবিদের কাছে রাসুল (সা.)-এর চেয়ে প্রিয় কেউ ছিলেন না। কিন্তু তারা তাঁকে দেখলেই দাঁড়িয়ে যেতেন না। কেননা রাসুল (সা.) বিষয়টি অপছন্দ করেন, তা তাঁরা জানতেন। তবে দূর থেকে (বা দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর) কেউ এলে তাঁর জন্য দাঁড়াতেন। যেমন—নবী (সা.)-এর ব্যাপারে বর্ণিত আছে, তিনি ইকরামা (রা.)-এর জন্য দাঁড়িয়েছিলেন। সাদ বিন মুয়াজ (রা.) এলে আনসারদের বলেন, ‘তোমাদের নেতার জন্য দাঁড়াও। তিনি এসেছিলেন, বনু কুরাইজার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিতে। কেননা তাঁরা তাঁকে বিচারক হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন।’ (মাজমুউল ফাতাওয়া : ১/৩৭৪)</p> <p> </p> <p><strong>কার আগমনে দাঁড়াব, কার আগমনে দাঁড়াব না</strong></p> <p>আবুল ওয়ালিদ বিন রুশদ কারো জন্য দাঁড়ানোর চারটি প্রকার নিরূপণ করেছেন। তা হলো, ১. মাহজুর বা নিষিদ্ধ : যখন কোনো ব্যক্তি প্রত্যাশা করে মানুষ তার জন্য দাঁড়িয়ে থাকুক। এমন ব্যক্তির জন্য দাঁড়ানো নিষিদ্ধ। কেননা তা ব্যক্তির অহংকার ও অহমিকা বাড়িয়ে দেয়।</p> <p>২. মাকরুহ বা অপছন্দনীয় : যে ব্যক্তির মনে অহংকার থাকে না এবং সে প্রত্যাশাও করে না মানুষ তাঁর জন্য দাঁড়িয়ে থাকুক, তবে এই ভয় থাকে যে এতে হয়তো ব্যক্তির মনে অহমিকা তৈরি হবে, এমন ব্যক্তির জন্য দাঁড়িয়ে থাকা অপছন্দনীয়।</p> <p>৩. জায়েজ বা বৈধ : আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোনো নিরহংকার মানুষের উদ্দেশে দাঁড়ানো।</p> <p>৪. মানদুব বা প্রশংসনীয় : সফর থেকে ফিরছে এমন ব্যক্তিকে সালাম ও অভিনন্দন জানাতে, দ্বিনের পথে সাফল্য লাভ করেছে এমন ব্যক্তিকে অভিনন্দন জানাতে অথবা কেউ বিপদগ্রস্ত হলে তাকে সাহায্য ও সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য দাঁড়ানো ইসলামী শরিয়তে মুস্তাহাব বা প্রশংসনীয়। (ফাতহুল বারি : ১১/৫৪)</p> <p> </p> <p><strong>রাসুলুল্লাহ (সা.) যেভাবে দাঁড়ানো অপছন্দ করতেন</strong></p> <p>আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) লাঠির ওপর ভর করে আমাদের কাছে এলেন। আমরা তাঁর জন্য দাঁড়িয়ে গেলাম। তিনি বললেন, তোমরা দাঁড়িয়ো না, যেমন অনারবরা পরস্পরের প্রতি দাঁড়ায়।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৫২৩০)</p> <p>আল্লামা ইবনে কুতাইবা (রহ.) বলেন, ‘এই হাদিসের উদ্দেশ্য হলো, অনারব রাজা-বাদশার দরবারে সাধারণ মানুষ যেভাবে মাথানত করে দাঁড়িয়ে থাকে।’ (বাজলুল মাজহুদ ফি শরহি আবি দাউদ : ২০/১৬৯) অর্থাৎ কোনো মানুষের প্রতি এমনভাবে সম্মান প্রদর্শন করা যাবে না যার সঙ্গে ইবাদতের সাদৃশ্য তৈরি, যাতে মানুষের সাধারণ সম্মান ক্ষুণ্ন হয় এবং ব্যক্তির জন্য অহংকার ও অহমিকা তৈরি হয়।</p> <p> </p> <p><strong>অতিথিবরণে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা </strong></p> <p>আগত ব্যক্তিকে স্বাগত জানাতে দাঁড়িয়ে থাকা ইসলামে অনুমোদিত। তবে এই কাজে কাউকে বাধ্য করা নিন্দনীয়। বিশেষ করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করা অবশ্যই পরিহারযোগ্য। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আগত অতিথির প্রত্যাশা পূরণ করতেই শিক্ষার্থীদের দাঁড় করিয়ে রাখেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা। এমন অতিথির জন্য রাসুল (সা.)-এর হুঁশিয়ারি হলো, ‘যে ব্যক্তি প্রত্যাশা করে মানুষ তার আগমনে (সম্মানার্থে) দাঁড়িয়ে যাক, সে যেন জাহান্নামে তার স্থান তৈরি করল।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৭৫৫)</p> <p> </p> <p><strong>শিক্ষকের সম্মানে শিক্ষার্থীরা দাঁড়াবে?</strong></p> <p>এই বিষয়ে ‘লাজনাতুদ-দায়িমা লিল-ইফতা’-এর ফাতাওয়ার (১/১৭২) নির্যাস হলো, সাহাবিদের সঙ্গে রাসুল (সা.)-এর সম্পর্ক ছাত্র-শিক্ষকসুলভ ছিল। তাঁরা রাসুল (সা.)-এর আগমনে দাঁড়াতেন না। কেননা তাঁরা জানতেন রাসুলুল্লাহ (সা.) বিষয়টি অপছন্দ করেন। ইসলামের সোনালি যুগেও এই প্রথার প্রচলন ছিল না। তাই কোনো শিক্ষক শিক্ষার্থীকে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেবেন না, আর দিলেও তা পালন করা শিক্ষার্থীর জন্য আবশ্যক নয়। তবে ইমাম নববী (রহ.) সম্মানিত ব্যক্তির জন্য দাঁড়ানো বৈধ মনে করতেন। তাই কোনো শিক্ষার্থী স্বেচ্ছায় দাঁড়ালে তা অবৈধ হবে না। (আল-মাদখাল লিল-ইবনিল হাজ : ১/১৫৮-১৯৭)</p> <p> </p> <p>লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (সিসি), বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা।</p> <p> </p>