<p>কোরআন ও হাদিসে মানব ভ্রূণের বৃদ্ধিপ্রক্রিয়া সময়কালীন বিভিন্ন স্তরকে অত্যন্ত অর্থবহ নামে ও ভাগে বিন্যাস করা হয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞানের পরিভাষায় মাতৃগর্ভে সন্তান গঠনের চক্র সাধারণত সর্বনিম্ন ২১০ দিন ও সর্বোচ্চ ২৮০ দিন পর্যন্ত বিবর্তিত হতে থাকে। যা প্রতি ৪০ দিন অন্তর  ভিন্ন একটি অবয়বে চক্রাকারে পরিবর্তন হতে থাকে। আর এর প্রতিটি স্তর অনেক বিস্তৃত অর্থ নির্দেশ করে থাকে। কোরআন নাজিলের ১৪০০ বছর পর আধুনিক বিজ্ঞান শরীরতত্ত্ব নিয়ে বিভিন্ন অভিমত দিয়েছে। আশ্চর্য হলো, উভয়ের মধ্যে পর্যাপ্ত মেলবন্ধন রয়েছে।</p> <p>রাসুলুল্লাহ (সা.) মাতৃগর্ভে মানবশিশু জন্মের স্তর সম্পর্কে বলেছেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকের সৃষ্টির উপাদান আপন মাতৃগর্ভে বীর্যের আকারে ৪০ দিন, জমাট বাঁধা রক্তে পরিণত হয়ে ৪০ দিন, গোশত আকারে ৪০ দিন। এরপর আল্লাহ একজন ফেরেশতাকে পাঠান এবং চারটি বিষয়ে আদেশ দেন যে, তার (শিশুর) আমল, রিজিক, আয়ুকাল ও ভালো না মন্দ সব লিপিবদ্ধ কর। অতঃপর তার মধ্যে রুহ ফুঁকে দেওয়া হয়।’ (বুখারি, হাদিস : ২৯৬৮)</p> <p>আধুনিক বিজ্ঞানের তথ্যমতে, নারী-পুরুষের মিলনের সময় নারীর ডিম্বনালিতে পুরুষের নিক্ষিপ্ত বীর্যের একটি শুক্রাণু প্রবেশ করে। আর এই শুক্রাণুটি দেখতে ঠিক মাথা মোটা জোঁকের মতো। জোঁক যেমন মানুষের রক্ত চুষে খায়, ঠিক তেমন এই শুক্রাণুটিও নারী ডিম্বাণুতে প্রবেশ করে মায়ের রক্তে থাকা প্রোটিন চুষে বেড়ে ওঠে। আর এই সময়ে মাতৃ ডিম্বাশয়ে নতুন করে আর কোনো ডিম্বাণু প্রস্তুত হয় না।</p> <p>মহান আল্লাহ মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে ঘোষণা করেন, ‘‘আর অবশ্যই আমরা মানুষকে সৃষ্টি করেছি মাটির উপাদান থেকে তারপর আমরা তাকে শুক্রবিন্দুরূপে স্থাপন করি এক নিরাপদ ভাণ্ডারে। পরে আমরা শুক্রবিন্দুকে পরিণত করি ‘আলাকা’তে, অতঃপর ‘আলাকা’কে পরিণত করি গোশতপিণ্ডে, অতঃপর গোশতপিণ্ডকে পরিণত করি অস্থিতে; অতঃপর অস্থিকে ঢেকে দিই গোশত দিয়ে; তারপর তাকে গড়ে তুলি অন্য এক সৃষ্টিরূপে। অতএব, (দেখে নিন) সর্বোত্তম স্রষ্টা আল্লাহ কত বরকতময়।’’ (সুরা মুমিনুন, আয়াত : ১২-১৪)</p> <p>আলোচ্য আয়াতসমূহে মানব সৃষ্টির সাতটি স্তর উল্লেখ করা হয়েছে। সর্বপ্রথম স্তর মৃত্তিকার সারাংশ, দ্বিতীয় স্তর বীর্য, তৃতীয় স্তর জমাট রক্ত, চতুর্থ স্তর মাংসপিণ্ড, পঞ্চম স্তর অস্থি-পিঞ্জর, ষষ্ঠ স্তর অস্থিকে মাংস দ্বারা আবৃতকরণ ও সপ্তম সৃষ্টিটির পূর্ণত্ব, অর্থাৎ তাতে রুহ সঞ্চারকরণ। আল্লাহ তাআলা কোরআনে এ শেষোক্ত স্তরকে এক বিশেষ ও স্বতন্ত্র ভঙ্গিতে বর্ণনা করে বলেছেন, ‘তারপর আমরা তাকে এক বিশেষ ধরনের সৃষ্টি দান করেছি।’ এই বিশেষ বর্ণনার কারণ এই যে প্রথমোক্ত ছয় স্তরে সে পূর্ণত্ব লাভ করেনি। শেষ স্তরে এসে সে সম্পূর্ণ এক মানুষে পরিণত হয়েছে। এ কথাই বিভিন্ন তাফসিরকারক বলেছেন। তাঁরা বলেন, এ স্তরে এসে তার মধ্যে আল্লাহ তাআলা ‘রুহ সঞ্চার’ করেছেন। (ইবনে কাসির)</p> <p>কোনো কোনো মুফাসসির বলেন, ‘তারপর আমরা তাকে এক বিশেষ ধরনের সৃষ্টি দান করেছি।’ এর অর্থ তাকে এক স্তর থেকে অন্য স্তরে নিয়ে গেছি। প্রথমে শিশু, তারপর ছোট, তারপর কৈশোর, তারপর যুবক, তারপর পূর্ণবয়স্ক, তারপর বৃদ্ধ, তারপর অতি বয়স্ক। বস্তুত দুটি অর্থের মধ্যে বিরোধ নেই। কারণ, রুহ ফুঁকে দেওয়ার পর এসবই সংঘটিত হয়।</p> <p>সহিহ বুখারির এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘আল্লাহ মাতৃগর্ভে একজন ফেরেশতা মোতায়েন করেন। ফেরেশতা বলেন, হে রব! এখনো তো ভ্রূণ মাত্র। হে রব! এখন জমাট বাঁধা রক্তপিণ্ডে পরিণত হয়েছে। হে রব! এবার গোশতের টুকরায় পরিণত হয়েছে। আল্লাহ যদি তাকে সৃষ্টি করতে চান, তখন ফেরেশতা বলেন, হে আমার রব! (সন্তানটি) ছেলে না মেয়ে হবে, পাপী না নেককার, রিজিক কী পরিমাণ ও আয়ুকাল কত হবে? অতএব এভাবে তার তাকদির মাতৃগর্ভেই লিপিবদ্ধ করে দেওয়া হয়।’ (বুখারি, হাদিস : ৩০৮৭)</p> <p>মহান আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেন, ‘তোমাদের সৃষ্টি করেছি তোমাদের মাতৃগর্ভে পর্যায়ক্রমে একের পর এক ত্রিবিধ অন্ধকারে।’ (সুরা জুমার, আয়াত : ৬)</p> <p>পবিত্র কোরআনে ঘোষিত এ ত্রিবিধ অন্ধকার সম্পর্কে আধুনিক বিজ্ঞান বলে, এর একটি হচ্ছে জরায়ু, আরেকটি হচ্ছে গর্ভফুল, আর অপরটি হচ্ছে মায়ের পেট। জরায়ুতে রক্তপিণ্ড তৈরি হয়। তারপর গর্ভফুল মায়ের শরীরের রক্ত থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করে ভ্রূণ বৃদ্ধি ও মায়ের ফুসফুসের মাধ্যমে প্রবেশ করা জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হওয়া থেকে ভ্রূণকে রক্ষা করে থাকে। </p> <p>এভাবেই মহান রবের অপার মহিমায় একটি শিশু মায়ের জরায়ুতে বেড়ে উঠতে থাকে। আর ১২০ দিন অতিবাহিত হলেই তাতে রুহ সঞ্চারণ করে দেওয়া হয়। ফলে সে নড়াচড়া শুরু করে। আঙুল চুষতে শুরু করে। অতঃপর সে যখন পরিপূর্ণ রূপ লাভ করে তখন তাকে মায়ের পেট থেকে বাহিরে ঠেলে দেওয়া হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘শুক্রবিন্দু থেকে, তিনি তাকে সৃষ্টি করেন, পরে তার পরিমিত বিকাশ সাধন করেন, তারপর তার জন্য পথ সহজ করে দেন।’ (সুরা আবাসা : আয়াত ১৯-২০)</p> <p>অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা স্বীয় ক্ষমতাবলে মাতৃগর্ভে মানুষকে সৃষ্টি করেন। তারপর তিনিই তার অপার শক্তির মাধ্যমে মাতৃগর্ভ থেকে জীবিত ও পূর্ণাঙ্গ মানুষের বাইরে আসার পথ সহজ করে দেন। ফলে দেহ সহি-সালামতে বাইরে চলে আসে এবং মায়েরও এতে তেমন কোনো দৈহিক ক্ষতি হয় না। (তাফসিরে ইবন কাসির)</p> <p>অন্যদিকে  চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, সন্তান যখন ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় হয় তখন Overy-Placenta থেকে এক ধরনের গ্রন্থিরস নির্গত হয়। যা প্রসব পথ পিচ্ছিল ও জরায়ুর মুখ ঢিলা করে দেয়।</p> <p>মহান আল্লাহ কত সুনিপুণ আকৃতি ও মনোরম কাঠামোতে আমাদের সৃষ্টি করেছেন! সব প্রশংসা তাঁরই। তিনি আমাদের তাঁর গোলামি করার তাওফিক দান করুন। আমিন।</p> <p> </p>