<p>দ্বিতীয় শতাব্দীর শুরুতে ইসলামী আকিদার ক্ষেত্রে যুক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানকে কেন্দ্র করে আবির্ভাব হওয়া একটি দলের নাম মুতাজিলা। এরা ওয়াসিল ইবনে আতার অনুসারী। মুতাজিলা নামটি আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আলেমদের দেওয়া। ‘মুতাজিলা’ শব্দটি এসেছে আরবি ‘ইতিজাল’ শব্দ থেকে। এর অর্থ পৃথক হওয়া। তাদের ‘মুতাজিলা’ বলার কারণ হলো, তারা আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত থেকে পৃথক বা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।</p> <p>আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ শাহরাস্তানি (রহ.) বলেন, এক ব্যক্তি হাসান বসরি (রহ.)-এর কাছে এসে বলেন, হে দ্বিনের ইমাম! আমাদের মধ্যে এমন এক দলের আবির্ভাব হয়েছে, যারা কবিরা গুনাহকে কুফরি মনে করে এবং কবিরা গুনাহকারী ইসলাম থেকে বের হয়ে যায় বলে দাবি করে। আবার অন্য একটি দল কবিরা গুনাহকারীর ক্ষমার প্রত্যাশী। তারা মনে করে, ঈমানদার অবস্থায় গুনাহ করলে ঈমান চলে যায় না। আমরা তাহলে কোন আকিদা পোষণ করব? হাসান (রহ.) এ বিষয়ে ভাবতে লাগলেন। তিনি জবাব দেওয়ার আগে ওয়াসিল ইবনে আতা বলেন, কবিরা গুনাহকারী ব্যক্তি মুমিনও নয়, কাফিরও নয়; বরং তার স্থান হলো ঈমান ও কুফরের মধ্যবর্তী। এ কথা বলে তিনি হাসান বসরি (রহ.)-এর মজলিস থেকে উঠে যান এবং নিজের এই মতবাদ প্রচার করতে শুরু করেন। এরপর হাসান বসরি (রহ.) বলেন, ‘ইতাজাল আন্না ওয়াসিল’ (ওয়াসিল আমাদের থেকে পৃথক হয়ে গেছে)। তখন থেকে ওয়াসিল ও তার অনুসারীদের নাম ‘মুতাজিলা’ হিসেবে প্রসিদ্ধ হয়ে যায়। (আল মিলাল ওয়ান নিহাল, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫২)</p> <p><strong>আবির্ভাব ও আত্মপ্রকাশ :</strong> মুতাজিলাদের আবির্ভাব সম্পর্কে প্রসিদ্ধ দুটি বিবরণ পাওয়া যায়। এক. মুতাজিলাদের আবির্ভাব হাসান ইবনে আলী (রা.)-এর সময়ে। তিনি যখন মুয়াবিয়া (রা.)-এর খেলাফত পরিত্যাগ করেন, তখন কিছু লোক হাসান (রা.) ও মুয়াবিয়া (রা.)সহ সব মানুষ থেকে পৃথক হয়ে যায়। রাজনীতি ছেড়ে তারা শুধু ইলম ও ইবাদতে লিপ্ত থাকে। এবং আকাইদ নিয়ে চিন্তা করতে থাকে। এখান থেকেই ‘ইতিজাল’ মতবাদের সূচনা হয়। (আততানবিহ ওয়াররদ্দি আলা আহলিল আহওয়ায়ি ওয়াল বিদায়ি, পৃষ্ঠা ৪১)</p> <p>দুই. মুতাজিলা মতবাদের প্রবক্তা ওয়াসিল ইবনে আতা (জন্ম : ৮০ হিজরি, মৃত্যু : ১৩১ হিজরি)। তৎকালীন সবচেয়ে স্পর্শকাতর ও আলোচিত বিষয় ছিল—‘কবিরা গুনাহকারী মুমিন, নাকি কাফির।’ এ বিষয়ে ওয়াসিল বিন আতা নতুন অভিমত ব্যক্ত করেন। হাসান বসরি (রহ.)-এর মজলিসে সে বলেন, ‘কবিরা গুনাহকারী মুমিনও নয়, কাফিরও নয়। বরং তাদের স্থান ঈমান ও কুফরের মধ্যবর্তী।’ নির্ভরযোগ্য অভিমত অনুযায়ী, এটিই মুতাজিলা মতবাদের সূচনাকাল। যদিও মুতাজিলাদের দাবি, তাদের মাজহাবের যাত্রা ওয়াসিলের অনেক আগে—আলী ইবনে আবি তালেব (রা.)-এর হাত ধরে। তাঁর কাছ থেকে তাঁর পুত্র মুহাম্মদ ইবনুল হানাফি এ মতবাদ গ্রহণ করেন। তারপর উত্তরাধিকারসূত্রে পান তাঁর পুত্র আবু হাসেম, যিনি ওয়াসিল ইবনে আতার শিক্ষক। তবে তাঁদের এ দাবির পক্ষে কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নেই। (নাশআতুল আসআরিয়া, পৃষ্ঠা ১২১)</p> <p>মূলত ওয়াসিল ইবনে আতার মাধ্যমেই ১০৫ থেকে ১১০ হিজরির মধ্যে মুতাজিলা মতবাদের সূচনা ও প্রসার হয়। মুতাজিলা মতবাদের যাত্রা কোন স্থান থেকে? এ প্রসঙ্গে মুতাজিলারা বলেন, মদিনা থেকেই এ মতবাদ যাত্রা শুরু করে। কেননা তারা মুহাম্মদ ইবনে হানিফা ও আবু হাসেমকে এ মতবাদের প্রবক্তা হিসেবে দাবি করে। আর তাঁরা দুজনই মদিনায় থাকতেন। ওয়াসিল মদিনায় জন্ম গ্রহণ করেন এবং আবু হাসেমের কাছ থেকে এ মতবাদ গ্রহণ করেন। তারপর একে মদিনা থেকে বসরা নিয়ে আসেন। কিন্তু সঠিক কথা হলো, মুতাজিলা মতবাদ বসরা নগরীতে প্রবর্তিত হয়। তাদের এ বক্তব্য মুহাম্মদ ইবনে হানিফার মাধ্যমে আলী ইবনে আবি তালেব (রা.)-এর সঙ্গে মুতাজিলা মতবাদের সম্পর্ক তৈরির অপচেষ্টা মাত্র। (আল মুতাজিলা, পৃষ্ঠা ১২)</p> <p><strong>যেভাবে মুতাজিলাদের উত্থান :</strong> মুতাজিলা মতবাদের উত্থানে বেশ কিছু বিষয় বিশেষ ভূমিকা রাখে। বিষয়গুলো নিম্নে তুলে ধরা হলো—</p> <p><strong>মধ্যপন্থী হওয়ার অভিলাষ :</strong> ওসমান (রা.)-এর শাহাদাতের পর জামালের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধ হয় আলী (রা.) ও মুয়াবিয়া (রা.)-এর মধ্যে। এ সময় মুসলমানদের মধ্যে চরম অনৈক্য দেখা দেয়। মুসলমানরা দলে দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। শাহাদাত লাভ করেন অনেক সাহাবা। একে অন্যকে কাফির বলতে শুরু করেন। বিজ্ঞ আলেমরা যখন দেখলেন, মানুষ অবলীলায় কবিরা গুনাহে লিপ্ত হচ্ছে, একে অন্যকে কারণ ছাড়া হত্যা করছে, তখন তাঁরা নিজ নিজ গবেষণা অনুযায়ী কোরআন-হাদিসভিত্তিক সমাধান বের করায় আত্মনিবেশ করেন। এর ফলে দেখা দেয় তীব্র মতবিরোধ। কবিরা গুনাহকারীর ব্যাপারে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের রায় হলো, তারা মুমিন, কাফের নয়। তবে তারা শাস্তি পাওয়ার যোগ্য। কেননা কবিরা গুনাহকারীর বিশ্বাস অবশিষ্ট থাকে। আর এটাই ঈমানের মূল বিষয়। অন্যদিকে খারেজিদের অভিমত হলো, কবিরা গুনাহকারী কাফির ও চিরস্থায়ী জাহান্নামি। আর মরজিয়া মতবাদের অনুসারীদের বক্তব্য হলো, কবিরা গুনাহকারী মুমিন এবং গুনাহর ব্যাপারে তারা ক্ষমার আশাবাদী। এভাবে বিরোধ ছড়িয়ে পড়ে এবং বসরার মসজিদে মসজিদে এ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। হাসান বসরি (রহ.)-এর মজলিসটি তন্মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিল। হাসান বসরি (রহ.)-এর শিষ্য ওয়াসিল ইবনে আতা চিন্তা করেন যে তিনি এ বিষয়ে সবার চেয়ে উৎকৃষ্ট সমাধান দেবেন! তিনি হাসান বসরির বৈঠকে বলেন, ‘কবিরা গুনাহকারী মুমিন নয়, কাফিরও নয়; বরং তারা ঈমান ও কুফরের মধ্যবর্তী।’ এ মতবাদ প্রকাশের মাধ্যমে উভয় পক্ষকে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল। কারণ আলী (রা.)-এর পক্ষ আলী (রা.)-এর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণকারীদের কাফির বলছিল, অন্যদিকে মুয়াবিয়া (রা.)-এর পক্ষ আলী (রা.)-কে অভিশাপ দিচ্ছিল। এ প্রচেষ্টার মাধ্যমে নিজেদের মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করলে তারা খুব একটা সফল হয়নি। বরং ইসলামী আকিদাপরিপন্থী তাদের নতুন এ মতবাদের জবাব দিতে গিয়ে আরো বেশি মতবিরোধ ছড়িয়ে পড়ে।</p> <p><strong>গ্রিক দর্শনের প্রভাব :</strong> তৎকালীন সিরিয়া, মিসর, ইরাক ও পারস্যে ইহুদি, খ্রিস্টান ও অগ্নিপূজকদের মুসলমানদের একত্রে বসবাসের ফলে ইসলামী আকিদায় ভিন্ন শাস্ত্রের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। সে সময় ব্যাপকভাবে গ্রিক, লাতিন, পারস্য ও ভারতীয় নানা শাস্ত্রীয় গ্রন্থ আরবিতে অনূদিত হয়। একটি দল তখন এসব শাস্ত্র-দর্শনের প্রভাবে কোরআন-হাদিসের চেয়ে শুধু যুক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এরাই মুতাজিলা। ইহুদিদের অনেক আকিদার সঙ্গে মুতাজিলাদের মিল রয়েছে। যেমন—মুতাজিলাদের উল্লেখযোগ্য একটি আকিদা হলো, খালকে কোরআন বা কোরআন সৃষ্ট হওয়ার আকিদা। ইবনুল আসির (রহ.) বর্ণনা করেন, ‘খালকে কোরআন’-এর প্রথম প্রবক্তা হলো লাবিদ ইবনে আসাম। আর সে ছিল ইহুদি। এভাবে অন্য দর্শন ও শাস্ত্রের আশ্রয় নিয়ে তারা নিজেদের মতবাদ প্রতিষ্ঠা করে।</p> <p><strong>আব্বাসীয় শাসকদের প্রত্যক্ষ মদদ :</strong> মুতাজিলাদের আবির্ভাব ঘটে উমাইয়া শাসনামলে। তাদের আগে আত্মপ্রকাশ করা কদরিয়্যা ইত্যাদি দলের চেয়ে তাদের অবস্থান ছিল দুর্বল। তাই তারা নিজেদের অস্তিত্বের জন্য একটি বৃহৎ শক্তি খুঁজতে লাগল। এ সময় উমাইয়াদের পতন হয়। অতঃপর আব্বাসীয় খলিফা আল মামুন মুতাজিলাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। এতে মুতাজিলা মতবাদের ভিত মজবুত হয়। তারা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও আনুকূল্য লাভ করতে শুরু করে। মুতাজিলাদের প্ররোচনায় খলিফা মামুন এই মতবাদকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে ভিন্ন মতাবলম্বী আলেমদের ওপর নির্যাতন, কারাদণ্ড, এমনকি হত্যা করতে শুরু করে। ২১২ হিজরিতে খলিফা মামুন ‘পবিত্র কোরআন আল্লাহর বাণী নয়; বরং তা সৃষ্ট’—মুতাজিলাদের আলোচিত এ আকিদার প্রকাশ্য ঘোষণা দেন। আলেম, মুহাদ্দিস, ফিকাহবিদ ও বিচারকদের প্রতি নির্দেশনা পাঠানো হয়—কেউ ‘খালকে কোরআন’ স্বীকার না করলে তার সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে না। এমন পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে বহু আলেম চুপ হয়ে যান। কিন্তু আরো বহু আলেম সত্য তুলে ধরতে পিছপা হননি। এতে তাঁদের ওপর নেমে আসে অবর্ণনীয় নির্যাতন। ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (রহ.) তাঁদের একজন। রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে নিজেদের মতবাদ প্রতিষ্ঠায় মুতাজিলাদের এটি ছিল সবচেয়ে বৃহত্তম ও নিকৃষ্টতম প্রচেষ্টা।</p> <p><strong>লেখক :</strong> বিশেষ প্রতিনিধি, ডেইলি ইসলাম বিডি ডটকম</p>