<p>আমরা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে ভালোবাসি। ভালোবাসি লাল-সবুজের এই পতাকাকে। কোথাও দেশ আক্রান্ত হলে যেন আমরাই আক্রান্ত হই। আমাদের দেশ থেকে প্রতিবছর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে শিক্ষার্থীরা ছুটে যায় বিভিন্ন দেশে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এসব প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের সঙ্গে লাল-সবুজের পতাকা যখন টিভিপর্দায় ভেসে ওঠে, বুকটা তখন ভরে যায়। দেশের সাফল্যে আমরা যেমন আনন্দিত হই, তেমনি দেশের ওপর শকুনের নজর পড়লেও ভীষণভাবে চিন্তিত হই। গুলশান কিংবা শোলাকিয়ায় হামলা হলে হৃদয়টা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়।</p> <p>যাদের ধর্ম ইসলাম, যারা শেষ নবী (সা.)-এর অনুসারী, দেশ ও জাতির জন্য তাদের আত্মত্যাগ ও বিসর্জনের দৃষ্টান্তে ইতিহাসের পাতা ভরপুর। বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন দেশপ্রেমের মূর্ত প্রতীক। মাতৃভূমিকে কতটা ভালোবাসতে হবে, একজন মুমিনকে তা নবীজি (সা.) শিখিয়েছেন হাতে-কলমে। হিজরতের আগে নিজ মাতৃভূমির যুদ্ধাবস্থা নিরসনের মাধ্যমে এর শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পরম লক্ষ্যে তিনি হিলফুল ফুজুল নামে সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে অন্যায় ও অনাচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ-প্রতিবাদ গড়ে তোলেন। মক্কাবাসীর নির্যাতন ও আল্লাহর হুকুমে মক্কা ছেড়ে মদিনায় পাড়ি জমালেও মক্কার প্রতি তাঁর অনুরাগ কমেনি বিন্দুমাত্রও। মক্কার পবিত্র কাবার ছবিই ছিল তাঁর হৃদয়জুড়ে। মক্কাবাসী যখন তাঁকে মক্কা থেকে অন্যায়ভাবে বের করে দিচ্ছিল, তখনো মক্কার ভালোবাসা তাঁকে চুম্বকের মতো টানত। মক্কার মায়া ছাড়তে পারছিলেন না তিনি। মক্কার প্রতি ভালোবাসায় তাঁর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছিল। মক্কা ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় পেছন ফিরে বারবার মক্কার দিকে তাকাচ্ছিলেন আর বলছিলেন, ‘আল্লাহর কসম! হে মক্কা, নিশ্চয়ই তুমি সবচেয়ে প্রিয় ও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম স্থান। আমাকে যদি এখান থেকে বের করে না দেওয়া হতো, আমি কিছুতেই তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।’ (জামে তিরমিজি : ৫/৭২২)</p> <p>একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্য দীর্ঘদিনের সাধনা শেষে রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পর মদিনাকে নিজের দেশ হিসেবে গণ্য করে মদিনার সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। মদিনার ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব নাগরিককে নিয়ে এর সুরক্ষার জন্য অনেক প্রতিরোধ যুদ্ধ করেছেন। ঐতিহাসিক মদিনার সনদের অন্যতম মৌলিক ধারা ছিল এই যে ‘শত্রু কর্তৃক মদিনা আক্রান্ত হলে এখানকার ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব নাগরিক ঐক্যবদ্ধভাবে তা প্রতিহত করবে।’</p> <p>একটি মুসলিম দেশের মুসলিম নাগরিকদের রাষ্ট্রের প্রতি ধর্মীয় দায়িত্ব হলো, রাষ্ট্রকে ভালোবাসা এবং এর নিরাপত্তা ও শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা। ইসলাম আক্রান্ত হলে যেমন জিহাদ ফরজ, তেমনিভাবে মাতৃভূমি আক্রান্ত হলেও তা রক্ষা করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ। সাহাবায়ে কেরাম যেমন অসত্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিজেদের কোরবান করে দিয়েছিলেন, তেমনি দেশপ্রেম ও স্বাধীনতা রক্ষায়ও ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যারা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবে, দেশের মানুষকে ভালোবাসবে এবং দেশের বিরুদ্ধে, সন্ত্রাসী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সজাগ দৃষ্টি রাখবে, তাদের জন্য মহান আল্লাহর দরবারে অনেক বড় পুরস্কার রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘দুটি চোখ জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না। একটি হলো ওই চোখ, যা আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করে আর আরেকটি হলো যা সীমান্ত পাহারায় বিনিদ্র রজনী যাপন করে।’ (তিরমিজি : ৪/১৭৫) অন্য হাদিসে নবীজি (সা.) বলেন, ‘রাষ্ট্রের স্বাধীনতার অতন্দ্র প্রহরীদের জন্য জান্নাত অবধারিত।’ (আবু দাউদ : ৩/৯)</p> <p>নবীজি (সা.) বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণে মানুষের জান-মালকে আরাফার দিনের মতো পবিত্র বলে ঘোষণা করে তা হারাম করে দেন। নবীজি (সা.) ঘোষণা করেন, ‘হে লোক সকল! জেনে রেখো, তোমাদের পরস্পরের জান-মাল, সম্মানের ওপর হস্তক্ষেপ হারাম করা হলো। আজকের এই পবিত্র দিন, এই পবিত্র মাস (জিলহজ), পবিত্র এই শহর (মক্কা) যেমন পবিত্র ও সম্মানিত, তেমনি এগুলোও (অন্যের জান-মাল, সম্মান) সম্মানিত ও পবিত্র। এখানে উপস্থিত ব্যক্তি অনুপস্থিত ব্যক্তির কাছে আমার এ বাণী যেন পৌঁছে দেয়। (বুখারি : ১/৩৬) যারা নিরপরাধ মানুষের ওপর আক্রমণ করছে, তাদের ধারণা, এভাবে মানুষ হত্যা করলে কোনো ঝক্কি-ঝামেলা ছাড়াই সোজা জান্নাতে যাওয়া যাবে। কখনো না। কোরআনুল কারিম, হাদিসে নবী (সা.) যে কাজটিকে চরমভাবে ঘৃণা করেছেন, সেই (মানুষ হত্যার) কাজটি করে বেহেশতে যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না; বরং জাহান্নামই হবে এই ঘাতকদের ঠিকানা। একজন মুমিনকে হত্যা করা তো দূরের কথা, তাকে গালাগাল করাও নিষিদ্ধ। কোনো মুমিনকে হত্যা করা সরাসরি কুফুরি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোনো মুসলিমকে গালি দেওয়া ফাসেকি আর তাকে হত্যা করা হলো কুফুরি।’ (বুখারি : ১/১৯; মুসলিম : ১/১৮) কোরআনুল কারিম ওই ঘাতকদের জন্য চিরস্থায়ী জাহান্নামের ঘোষণা করেছে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মুমিনকে হত্যা করল, তার শাস্তি চিরস্থায়ী জাহান্নাম। তার প্রতি আল্লাহর গজব ও অভিশাপ। তিনি তার জন্য ভয়ংকর শাস্তি প্রস্তুত করে রাখবেন।’ (সুরা নিসা : ৯৩) যদি কোনো ব্যক্তি সত্যিকারেই মুমিন হয়, তাহলে তার হাতে তো অন্য একজন মুমিন আক্রান্ত হতে পারে না। যদি তার দ্বারা অন্য কোনো মুমিন অনিরাপদ হয়, আক্রান্ত হয়, তাহলে বুঝতে হবে, সে যতই মুমিন দাবি করুক না কেন, প্রকৃতপক্ষে সে মুমিন নয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, প্রকৃত মুমিন তো কেবল সে-ই, যার জবান ও হাতের অনিষ্ট থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ।’ (বুখারি : ১/১১; মুসলিম : ১/৬৫)</p> <p>প্রশ্ন হলো, তাহলে কি কোনো অমুসলিমকে হত্যা করা বৈধ? কখনো না। মুসলিম হোক কিংবা অমুসলিম, কোনো মানুষকে হত্যা করা ইসলামের দৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় অন্যায় ও ঘৃণ্য কাজ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সবচেয়ে বড় কবিরা গুনাহ হলো আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করা এবং অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা।’ (বুখারি : ৫/২২৩০) মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে কোনো মানুষকে হত্যাই ইসলামের দৃষ্টিতে সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করার শামিল। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করল, সে যেন পৃথিবীর সব মানবগোষ্ঠীকেই হত্যা করল।’ (সুরা মায়েদা : ৩২)</p> <p>অমুসলিমদের অন্যায়ভাবে যারা হত্যা করবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন নবীজি (সা.)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমকে হত্যা করল, সে জান্নাতের গন্ধও পাবে না।’ (বুখারি, মিশকাত : ২/২৮৬)</p> <p>চরমপন্থা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে মজবুত অবস্থান নেওয়া শুধু সরকার কিংবা বিশেষ দলের কাজ নয়; বরং রাষ্ট্রে প্রত্যেক নাগরিকের ওপরই তা কর্তব্য। রাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিকরা ঐক্যবদ্ধ হলে যে সব ষড়যন্ত্রই রুখে দিতে পারে, তার উজ্জ্বল একটি দৃষ্টান্ত হলো অতি সম্প্রতি তুরস্কের সেনা অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করে দেওয়া। বিশ্ব দেখেছে যে তারা কোনো নেতার ছবি নিয়ে নয়, বরং তাদের দেশের পতাকা নিয়ে রাজপথে নেমে আসে। দলমতনির্বিশেষে সবাই দেশ রক্ষায় ভেদাভেদ ভুলে একাকার হয়ে যায়। ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল সব শ্রেণির জনতার প্রতিরোধে অভ্যুত্থানচেষ্টা ভেস্তে যাওয়ার পর তুরস্কের পার্লামেন্টে জরুরি অধিবেশন আহ্বান করা হয়েছিল। তুরস্কের পার্লামেন্ট দ্য গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেমব্লির অধিবেশনে সব রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধভাবে অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে। এমনকি বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরাও এই অভ্যুত্থানচেষ্টাকে সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে অভিহিত করেছেন। যেসব বিশিষ্ট নাগরিক ক্ষমতাসীনদের সমালোচনা করতেন সব সময়, তাঁরাও নির্বাচিত সরকারের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রেখে অভ্যুত্থানের সম্ভাবনার পথ বন্ধ করে দেন। (দৈনিক মানবজমিন : ১৮-০৭-২০১৬)</p> <p>কোনো সন্ত্রাসী যদি আমাদের লাল-সবুজের পতাকা কিংবা নিরপরাধ মানুষের ওপর আক্রমণ করে, তাহলে রাষ্ট্রের সব নাগরিকের উচিত ঐক্যবদ্ধভাবে তা প্রতিহত করে দেওয়া। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের কেউ যখন কোনো অন্যায় হতে দেখে, তখনই যেন সে তা হাত দ্বারা প্রতিরোধ করে। আর যদি সে একে প্রতিরোধের ক্ষমতা না রাখে, তাহলে মুখে এর প্রতিবাদ করে। আর এর ক্ষমতাও যদি সে না রাখে তাহলে যেন সে অন্তরে ঘৃণা করে এবং তা প্রতিরোধের চেষ্টা অব্যাহত রাখে। আর শুধু অন্তরের ঘৃণাতেই সীমাবদ্ধ থাকা ইমানের সর্বনিম্ন স্তর।’ (মুসলিম : ১/৬৯)</p> <p>রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর এই হাদিসের ওপর আমল করে স্বাধীনতার পাহারাদার হয়ে বাংলাদেশের সব নাগরিক যদি জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে, তাহলে সব ধরনের চরমপন্থা, সন্ত্রাসী, জঙ্গি কার্যক্রমসহ দেশবিরোধী সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হতে বাধ্য হবে।</p> <p> </p> <p>লেখক : খতিব, বাইতুশ শফিক জামে মসজিদ</p> <p>বোর্ড বাজার (আ. গনি রোড), গাজীপুর</p>