সেদিন সন্ধ্যায় মগবাজারে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সামনে দাঁড়িয়ে কি যেন বিষয় নিয়ে শফিক আল মামুন ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলছিলাম। সম্ভবত ভারত-পাকিস্তানের সম্ভাব্য যুদ্ধ প্রসঙ্গ। গরম গরম কথাবার্তা। আর তখন শুধু মগবাজারের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সামনেই নয়, মিডিয়া গলি, মৌচাকের বাংলা টেলিভিশনের গলি, বেইলি রোড, কাঁটাবনের ঢাল এলাকায় যেসব জটলা হয়, আড্ডা হয়, সেগুলোতে তখন হট টপিক ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ।
বাংলা চলচ্চিত্র ও প্রয়োজনীয় রক্তের গ্রুপ
- মাহতাব হোসেন
notdefined

আমি আসলে বুঝতে পারছিলাম না, এই বিষয়ে আমার মত কী! আমাদের সঙ্গেই ছিল ছোট ভাই নাহিয়ান ইমন। আমি ওর দিকে তাকালাম—
কী ইমন, তোমার কি মনে হয় যুদ্ধ লেগে যাবে?
কিসের যুদ্ধ ভাই, এখন আবার কিসের যুদ্ধ... সিরিয়া?
বুঝলাম, ওর সঙ্গে আলোচনা করে লাভ নেই। ওর কান অন্যদিকে।
ফোন বের করার সময় ওকে ঘিরে ধরলাম আমরা। এরই মধ্যে আমাদের আড্ডায় অনিন্দ্য মামুন এসে পড়েছে।
অনিন্দ্য মামুন সমর্থন দিল। ওপাশ থেকে নিরব ভাই বললেন, ‘ইমন জরুরি এক ব্যাগ রক্ত লাগবে...ইউনাইটেড হসপিটাল...রক্তের গ্রুপ...’
নিরব ভাইয়ের কণ্ঠে এক প্রকার আতঙ্ক। সাধারণত চিত্রনায়করা সহজে বিচলিত হন না। কিন্তু নিরব ভাইকে কিছুটা বিচলিতই মনে হলো। নাহিয়ান ইমন কথা না বলতে দিয়ে নিরব ভাইকে প্রায় থামিয়ে দিল।
ভাই, আর বলতে হবে না, আপনি প্লিজ! কথা বইলেন না। আমি এক্ষুণি রক্ত নিয়ে আসছি।
আমরা প্রায় চুপসে গেলাম। ইমন বলল, ‘ভাই বাইক স্টার্ট দেন।’
কেন?
আরে শুনলেন না, নিরব ভাইয়ের জরুরি রক্ত লাগবে।
তা বুঝলাম; কিন্তু কই থেকে রক্ত ম্যানেজ করবা? তা ছাড়া কোন গ্রুপের রক্ত আর ঘটনাই বা কী?
আরে আপনি বাইক স্টার্ট দেন। আমি জানি সব। রক্ত কই পাওয়া যাবে দেখছি।
এদিকে দুই মামুন মিলে আমাকে প্রায় জোর করে বাইক স্টার্ট করাল। বলল, ওরা দুজন কোথায় যেন যাবে, এই মুহূর্তে আমার নাহিয়ান ইমনের সঙ্গে যাওয়া জরুরি। এখানে বলে রাখা ভালো, আমরা সবাই গণমাধ্যমে কাজ করি। স্বাভাবিকভাবেই নায়ক, নায়িকা, ভিলেন—সবার সঙ্গে পরিচয়টা বেশ ভালো। আমি বাইক স্টার্ট করে বললাম, ‘কই যাব ইমন?’
আপনি মোহাম্মদপুর যান।
কোন রোড?
আরে ওইটা কোন রোড, ওই যে রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের পাশ দিয়ে ঢুকে গেছে।
ও আচ্ছা, বলতে হবে না, বুঝছি।
মগবাজার থেকে বের হয়ে রাস্তা সংক্ষিপ্ত করে তেজগাঁওয়ের ভেতর দিয়ে ওভারপাস অতিক্রম করে ঠেকলাম বিজয় সরণি মোড়ে। জ্যামে থাকতে থাকতে অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছিলাম। ইমন বাইকের পেছন থেকে বলে উঠল—
ভাই, ঢাকার দুঃখ কী জানেন?
না তো।
ঢাকার দুঃখ বিজয় সরণি।
উপায় নেই, সেই দুঃখময় সময়েও হাসতে হলো।
ঘটনা সত্য। এই বিজয় সরণি আসলেই ঢাকার দুঃখ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা-ই হোক, কতক্ষণ বাদে জ্যাম ছুটল জানি না। বাইক টেনে দ্রুত চন্দ্রিমা উদ্যানের ভেতর দিয়ে চলে এলাম আওরঙ্গজেব রোডে। রেড ক্রিসেন্ট ব্লাড ব্যাংকে চলে গেল নাহিয়ান ইমন। ফিরে এলো মুখ কালো করে।
কী হলো।
ভাই, এইখানে নাকি রক্ত নাই। আর এইভাবে নাকি...আচ্ছা আপনি শ্যামলী চলেন। ওখানে এক পরিচিত হাসপাতাল আছে।
কিছুই বললাম না। বাইক ঘুরিয়ে কলেজগেট পেরিয়ে ছুটলাম শ্যামলীর দিকে। শিশুমেলার বিপরীতে আমাকে অপেক্ষা করতে বলে ইমন কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেল। এলো মিনিট বিশেক পরে। হাতে কাগজে মোড়ানো একটা ব্যাগ। বাইকে উঠেই বলল, ‘ভাই স্টার্ট দেন, একেবারে গুলশান দুই, ইউনাইটেড হাসপাতাল।’
আমরা যখন ইউনাইটেডের গেটে পৌঁছলাম, তখন রাত সাড়ে ৯টা। বাইকটা দ্রুত পার্ক করে ফেললাম। ইমন বলল, ‘ভাই, নিরব ভাইকে একটা ফোন দিয়ে জেনে নেন বেড নম্বর কত। আমার ফোন বন্ধ হয়ে গেছে।’
নিরব ভাইকে ফোন দিলাম। উনি জানালেন অ্যাড্রেস। নাহিয়ান ইমন পারলে প্রায় দৌড়েই চলে যায়। আমি ওকে ধীরেসুস্থে নিয়ে গেলাম। কেবিনের মতো কক্ষের একটা বেডে নিরব ভাই হেলান দিয়ে বসে আছেন। আমাদের দেখে এগিয়ে এলেন। ইমন প্রায় হাঁপিয়ে পেপারে মোড়ানো বস্তুটা নিরব ভাইয়ের হাতে দিল...
এই যে ভাই, নিয়ে আসছি আপনার ও নেগেটিভ...
ও নেগেটিভ মানে? তোমারে কে কইছে ও নেগেটিভ রক্ত আনতে?
ভাই, নায়কদের তো ও নেগেটিভ রক্তই লাগে, ছোটবেলা থেকে তো এইটাই দেখে আসছি। সেদিনও বলাকায় একটা নতুন সিনেমা দেখলাম, সেখানেও...!
নিরব ভাই হেসে ফেললেন, ‘আরে ছেলে, আমার কাজিনের রক্তস্বল্পতা, এক ব্যাগ বি পজেটিভ লাগত। তুমি কথা না শুইনাই...। আমার নিজের ও পজেটিভ গ্রুপ।
দেখলাম, পাশের বেডে নিরব ভাইয়ের কাজিন শুয়ে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসছে। আমি বললাম, ‘ভাই, ইমন তো ছোট, হয়তো পাকনামি একটু বেশি করে। কিন্তু আপনাদের সিনেমার গল্পগুলো পাল্টান না কেন? বাংলা সিনেমায় কি ও নেগেটিভ গ্রুপ ছাড়া রক্তের প্রয়োজনই হয় না?’
‘দেখি, রফিক সিকদারকে (চিত্রপরিচালক) বলি, পরের সিনেমায় রক্ত লাগলে যেন চিত্রনাট্যে পজিটিভ গ্রুপের কথা লেখে।’
সম্পর্কিত খবর