খাঁটি ফলের রস।’
এক গ্লাস জুস হাতে নিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ ইশারায় বোঝাতে চাইলাম, ‘আপনিই কী সেই ফলওয়ালা?’
সে আমাকে মোটেও পাত্তা না দিয়ে গামছাটা দিয়ে কয়েকবার বাড়ি দিল ভ্যানে। বাড়ি কী আমার উদ্দেশ্যে দিল নাকি মাছি তাড়ানোর জন্য, কে জানে? আমিও আর কথা না বাড়িয়ে ঢকঢক করে গলায় ঢেলে জুসের দাম দিয়ে চলে এলাম। যদিও খটকা লাগছিল, এই লোকই সেই লোক। তার পরও কিছু বললাম না। এমন তো হতেই পারে, পারে না?
এ পর্যন্ত ভালোই ছিল। মহা খটকাটা লাগল তার পরের সপ্তাহে। সেই লোককে আবার দেখলাম। এবার কাঁচা বাজারের একটু সামনে। একই চেহারা, একই বেশভূষা কিন্তু এবার সে ভ্যানে কাঁচের গ্লাস, বাটি, প্লেট বিক্রি করছে।
ছুটির দিনে বাজারের ব্যাগ হাতে বাজার করতে যাচ্ছিলাম। লোকটাকে দেখে এত অবাক হলাম যে কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা লোকটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। কেন জানি মনে হলো, লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। আমি কিছু বলার আগেই সে একই গলায় বলতে লাগল, ‘নেন ভাই নেন। বাজারের চেয়ে সস্তা দামে দিতাছি গ্লাস। আর মাত্র দুই হালি বাকি, আর মাত্র দুই হালি।’
আমি কিছু বলার আগেই আরো কিছু মানুষ এসে গ্লাসের দাম করা শুরু করে দেওয়ায় আর কথা বাড়ালাম না। বাজার শেষে যখন ফিরছিলাম, দেখি সেই ভ্যানের ফেরিওয়ালা এখনো ডাকছে, ‘আর মাত্র দুই হালি, আর মাত্র দুই হালি।’
আমি সামনে আসতেই সে চাপা গলায় ফিসফিস করে ডাকল।
—শুধুমাত্র আপনার জন্য একটা অফার আছে।
—ভ্রু কুঁচকে বললাম, কী অফার?
—আপনি নিলে এক হালির দামে দুই হালিই দিয়া দিমু।
—আমার জন্য এত খাতির কেন, শুনি? আচ্ছা কিনতে পারি, এক শর্তে।
—লোকটি হেসে বলল, হাফ দামে জিনিস দিমু আমি, আর শর্ত দেবেন আপনে?
—আগে বলো, তুমি কে?
—লোকটি হেসে বলল, আগে তো কেনেন।
দাম শোধ করার পরে সে গ্লাসগুলো প্যাকেট করতে করতেই কাকে যেন ডাক দিল। একটু ভয়ে ভয়ে চারপাশে তাকালাম। কোন গ্যাংট্যাং না তো আবার? মারধর দিয়ে টাকা কেড়ে না নিলেই হয়। আমাকে অবাক করে দিয়ে ভ্যানওয়ালা সেই তৃতীয় ব্যক্তির হাতে ভ্যান তুলে দিয়ে বলল, ‘এই নে তোর ভ্যান। এক মাসের আগেই ফেরত দিলাম।’
এবার আমার ফলওয়ালা ওরফে জুসওয়ালা ওরফে গ্লাসওয়ালা লোকটা হাঁটা শুরু করতেই পথ আটকে দাঁড়ালাম।
—কী ব্যাপার, আমাকে কিছু না বলেই হাঁটা দিচ্ছ যে?
—বিক্রি শেষ, বাড়ি যামু না?
—অবশ্যই যাবে। তার আগে বলো, কে তুমি?
—কে আবার, আমি মাল বেচি, বিক্রেতা।
—তা তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু একেক সপ্তাহে একেক জিনিস বিক্রি করো, এমন বিক্রেতা তো জীবনেও দেখিনি।
—সত্যি কথা কইতে কী, আপনার মতো এমুন ভালো ক্রেতাও আমি জীবনে দেখি নাই।
—তার মানে?
—দেখতেই তো পাইলেন, একটা লোকের কাছ থেইক্কা ভ্যান ভাড়া করছিলাম, এক মাসের লাইগা। সেই ভ্যানে মাসখানেক আগে ফলের ব্যবসা শুরু করলাম। কিন্তু ভাগ্য এত খারাপ, আপনার মতো দুই-একজন কাস্টমার ছাড়া কারো কাছেই ফল বিক্রি করতে পারলাম না। সপ্তাহখানেক পর দেখি, সব ফল গেছে নষ্ট হইয়া। কী করি, কী করি ভাবতে ভাবতে কিছু গ্লাস কিইন্যা ফলগুলানরে জুস বানাইয়া ফেললাম। সেই জুস বেচা শেষ হইল, বাকি থাকল গ্লাসগুলান। আপনি শেষ দুই হালি গ্লাস কেনার পর আর কী কিছু বাকি থাকল? তয় আবারও স্বীকার করি, আপনার মতো খরিদদারগো লাইগাই এখনো বাইচ্যা আছি।
লোকটা চলে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পরেও হাঁ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সস্তায় কেনা গ্লাসগুলোর ভারে হাত ব্যথা শুরু হতেই বাসার দিকে পা বাড়ালাম।