জীবনের সব প্রথম ব্যাপারই সব সময়ের জন্য বিশেষ কিছু। এই যেমন স্যারের হাতে প্রথম থাপ্পড় খাওয়া, প্রথম গাছ থেকে ফল চুরি করা, প্রথম প্রেম আরো অনেক কিছু। ঠিক সে রকমভাবেই প্রথম ফ্লাইটে চড়াও বিশেষ কিছু। এই কয়দিন আগে ঢাকা যাচ্ছিলাম একটি জরুরি কাজে।
উড়োজাহাজ
- মো. সাখাওয়াত হোসেন
অন্যান্য

তারা বলল, ‘আমরা আপনাকে প্লেনে আসা-যাওয়ার সুযোগ করে দিলে?’
আমি লজ্জার মাথা-মুণ্ডু চিবিয়ে বলে ফেললাম, ‘তাহলে ঠিক আছে।’
কিছু কাগজপত্র ছাড়া সঙ্গে কিছু ছিল না। কিন্তু এয়ারপোর্টে গিয়ে দেখলাম, পশ্চিম রণাঙ্গন।
আমি বললাম, ‘তিল।’
আমার পেছনে দাঁড়ানো ভদ্রলোক হেসে ফেলল।
ইশারায় আমার বুকপকেটের কলম দেখাল। আমি কলমটি বের করে দিতেই টিপ দিয়ে নিব বের করে দেখল। কী জানি ওরা ভেবেছিল! মনে হয় গুলিটুলি বের হবে।
আমি হেসে বললাম, ‘চাচা, সবাই তো চোর। কেউ টাকা চুরি করে, কেউ লেখা চুরি করে, কেউ মন চুরি করে।’
চাচা তাঁর পান খাওয়া লাল দাঁতগুলো বের করে বললেন, ‘এই যে একটা ভালো কথা কইছ।’
হঠাত্ দেখি খুব দৌড়াদৌড়ি হচ্ছে। ব্যাপার কী, জিজ্ঞেস করতেই মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। এয়ারপোর্টে কোথায় জানি বোম দেখা গেছে। সব ফ্লাইট কিছুক্ষণের জন্য স্থগিত।
‘আলেয়ার মা বলছিল আইজকা বাহির না হইতে।’ পাশের চাচা গজগজ করতে লাগলেন।
‘ক্যান চাচা?’
‘আরে, বাইর হওয়ার সময় পথে পাশের বাসার কালো বিড়াল পড়ছিল।’
‘এগুলা কুসংস্কার চাচা!’
‘বুমটা ফুটলে বুঝবা কুসংস্কার কারে বলে।’
দুই তরুণী দেখলাম, ‘ওহ গড! ওহ গড! এখন কী হবে!’ এসব বলে মোবাইল বের করে সেলফি তুলে ফেলেছে।
‘ভাবসাব দেখছ? এদের লাইগাই আইজকা বুমটা ফুটবে!’
আমি বিড়বিড় করলাম, ‘বোম ফুটুক আর না-ই ফুটুক, এখন বসন্ত!’
পুলিশ, সিকিউরিটি গিজগিজ করছে। বোমসদৃশ বস্তুটা আমিও দূর থেকে দেখলাম। লাল টেপে মোড়া কিছু একটা। ওই জায়গাটা ঘিরে রাখা হয়েছে। বোম ডিজপোজাল টিম আসছে মনে হয়। ঢাকায় আমার যেখানে যাওয়ার কথা তারা এসএমএস করে জিজ্ঞেস করেছে, আর কতক্ষণ লাগবে?
আমি রিপ্লাই দিয়েছি, ‘বোমটা ফাটলেই চলে আসব!’
এরপর থেকে এরা কল করে যাচ্ছে, আমি রিসিভ করছি না।
একটু পরেই বোম ডিজপোজাল টিম এসেই সবাইকে সরিয়ে দিল। পিনপতন নীরবতা। এর মধ্যে কোথা থেকে এক পিচ্চি দৌড়ে এসে পুলিশদের ফাঁক গলে আরেকটু হলেই রেড মার্ক করা জায়গায় ঢুকে পড়েছিল। সবাই হৈ হৈ করে উঠল। সে কান্না করেই যাচ্ছে, ‘ওই তো আমার বল!’
একটু পরেই তার লাল টেপ মোড়ানো টেনিস বলটা উদ্ধার হলো। যেটা এতক্ষণ বোম ভাবা হচ্ছিল। এই দেখে চাচা বললেন, ‘আলেয়ার মা ঠিকই কয়, আইজকালকার বাচ্চাকাচ্চা সাক্ষাত্ বান্দর। তুই বলের ওপরে আবার টেপ ক্যান পেঁচাইছস আমারে ক।’
‘চাচা এটারে বলে টেপ টেনিস বল, আমরা আগে খেলতাম।’
আমি বুঝিয়ে দিতেই চাচা আমাকে আগাগোড়া দেখতে লাগলেন। বানরের লেজ দেখা যাচ্ছে নাকি সেটাই দেখছে বোধ হয়।
এরপর প্লেনে উঠে দেখি আমার সিট চাচার পাশেই পড়েছে।
আমি মনে মনে দুবার বললাম, ‘কাম সারছে!’
সিটে বসেই চাচা বললেন, ‘দেখো তো জানালাটা খোলা যায় নাকি বাবা!’
‘চাচা, জানালা খোলা যায় না প্লেনে।’
‘কও কী! এত টাকা দিয়া উঠলাম। জানালা বন্ধ থাকব?’
সেই পিচ্চি ছেলেটাকে প্লেনে দেখা গেল। আরো কয়েকটি বাচ্চা আছে।
‘প্লেনে এদের খেলাধুলার কোনো ব্যবস্থা নাই?’ চাচা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে আরেকটা ফেলে দিলাম। এরপর এয়ার হোস্টেস এসে কিছু লাগবে নাকি জিজ্ঞেস করতেই চাচা হেসে বললেন, ‘না মা, লাগবে না। আমার এটা আছে।’ এই বলে চাচা পকেট থেকে একটি লাল জিনিস বের করতেই পেছন থেকে সেই সেলফি তোলা তরুণী আবার, ‘ও মাই গড!’ বলে উঠল।
চাচা পেছনে ফিরে হেসে বললেন, ‘ডরাও ক্যান মা, এটা তো আনার ফল। খাইবা নি?’
‘নিরাপত্তার ফাঁক গলে লাল টেনিস বল, লাল আনার ঢুকে যাচ্ছে। কী যে হবে’—মনে মনে এই ভেবে আমি আকাশের সাদা মেঘের ভেলা দেখতে লাগলাম। প্রথম ফ্লাইট প্রায় স্মরণীয় হওয়ার পথে।
সম্পর্কিত খবর