এ ছাড়া বিদ্যমান সংবিধানের ৭ (ক) ও ৭ (খ) ধারা বিলুপ্ত করা, সংসদের উভয় কক্ষে ডেপুটি স্পিকারের একটি পদ বিরোধী দল থেকে দেওয়া, রাষ্ট্রপতির অভিশংসন প্রক্রিয়া, ‘অধস্তন আদালত’ শব্দের পরিবর্তে ‘স্থানীয় আদালত’ ব্যবহার করা, অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্যসংখ্যা ১৪ জনে সীমাবদ্ধ রাখার বিষয়গুলোতে একমত বিএনপি।
আবার জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সব সংসদীয় কমিটির সভাপতির পদ বিরোধী দলকে দেওয়ার প্রস্তাব করলেও বিএনপি কিছু কমিটির পদ বিরোধী দলকে দেওয়া যেতে পারে বলে জানিয়েছে।
সংবিধানের বেশির ভাগ মৌলিক পরিবর্তনের প্রস্তাবে বিএনপি ও তাদের সমমনা দল এবং বাম দলগুলো বিরোধিতা করেছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রের নাম ও সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তনে আপত্তি জানিয়েছে অধিকাংশ দল।
তবে সংবিধান, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচনব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে যেসব সুপারিশ করা হয়েছিল সেগুলোর অধিকাংশের সঙ্গে এনসিপি একমত হলেও আংশিক একমত হয়েছে জামায়াত।
দেশে ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা এবং বিচার বিভাগ—এই তিনটি বিভাগের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি)’ গঠন করার বিষয়ে কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে একমত নয় বিএনপি, জামায়াত ও বাম জোটসহ অধিকাংশ দল।
ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে একই ব্যক্তি দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না—এমন প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রস্তাবে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, গণ অধিকার পরিষদ ও ইসলামী আন্দোলন একমত। তবে এ সুপারিশের সঙ্গে একমত হয়নি দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি, ১২ দলীয় জোটসহ কয়েকটি দল। তারা চাইছে একই ব্যক্তি টানা দুবারের পর বিরতি দিয়ে আবাবও প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সংসদ সদস্যদের ফ্লোর ক্রসিংয়ের সুযোগ প্রদানের বিষয়ে দলগুলোর নানা মত রয়েছে। প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা চালুর প্রস্তাবেও আপত্তি জানিয়েছে অধিকাংশ দল।
ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে সংবিধানে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানকে এক কাতারে আনার বিষয়ে জামায়াত ও এনসিপি একমত হলেও ভিন্নমত পোষণ করেছে বিএনপি ও তাদের মিত্র দল এবং বাম দলগুলো। এ ছাড়া সংবিধানের মূলনীতি ও রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তনের প্রস্তাবেও একমত হয়নি তারা। সংবিধানে ‘বহুত্ববাদ’ সংযোজনে আপত্তি জানিয়েছে ইসলামী দলগুলো। সংবিধান ইস্যুতে বিএনপি পরবর্তী সংসদে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া যৌক্তিক বলে মত দিয়েছে। তারা মনে করে, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত হলে বেশির ভাগ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
জামায়াতে ইসলামী সংবিধানের মূলনীতিতে ‘আল্লাহর প্রতি অবিচল ঈমান-আস্থা’ পুনঃস্থাপনের প্রস্তাব করেছে। তারা সংবিধানে সাম্য, গণতন্ত্র, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচারের নীতিগুলো বজায় রাখার পক্ষে। আর বাহাত্তর সালের সংবিধানের চার মূলনীতি ও পরবর্তী সময়ে সংশোধনীর মাধ্যমে গৃহীত মূলনীতি বাদ দেওয়ার পক্ষে এনসিপি।
কমিশনের প্রস্তাব ছিল, ‘সংসদের মেয়াদ চার বছর এবং একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও দলীয় প্রধান হতে পারবেন না।’ এই প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হয়নি বিএনপি। তারা সংসদের মেয়াদ বিদ্যমান পাঁচ বছর রাখার পক্ষে অবস্থান নিয়ে বলেছে, একটি দলের প্রধান কে হবেন, তারা ক্ষমতায় গেলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, কে সংসদ নেতা হবেন, এসব ঠিক করার বিষয়টি দলের একান্ত নিজস্ব বিষয়। এসব সংবিধানে ঠিক করে দেওয়া যাবে না। তবে কমিশনের এ প্রস্তাবের সঙ্গে একমত এনসিপিসহ কয়েকটি দল। আর জামায়াত ও বাম দলগুলো সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছরের পক্ষে মত দিয়েছে।
বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন সংসদ সদস্যদের ভোটে। তবে সংবিধান সংস্কার কমিশন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে নতুন পদ্ধতির প্রস্তাব দিয়ে বলেছে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন নির্বাচকমণ্ডলীর (ইলেকটোরাল কলেজ) সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে। আইনসভার উভয় কক্ষের সদস্যদের প্রত্যেকের একটি করে ভোট, জেলা সমন্বয় কাউন্সিল সামষ্টিকভাবে একটি করে ভোট (৬৪টি জেলা সমন্বয় কাউন্সিল থাকলে ৬৪টি ভোট), সিটি করপোরেশন সমন্বয় কাউন্সিল সামষ্টিকভাবে একটি করে ভোট দেবে। কমিশনের এ প্রস্তাবের সঙ্গে এনসিপি একমত হলেও দ্বিমত পোষণ করেছে বিএনপিসহ অধিকাংশ দল।
সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ এবং দলগুলোর প্রাপ্য ভোটের সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনের সুপারিশ করেছে। এ প্রস্তাবের সঙ্গে জামায়াত ও এনসিপি একমত হলেও আংশিক দ্বিমত পোষণ করেছে বিএনপি। তাদের প্রস্তাব—প্রাপ্য ভোটের ভিত্তিতে নয়, নিম্নকক্ষে প্রাপ্ত আসনের সংখ্যানুপাতে উচ্চকক্ষে প্রতিনিধি মনোনয়ন করা। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টিসহ কয়েকটি দলের পক্ষ থেকে সংসদের উভয় কক্ষের জন্য সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত এনসিপিসহ কয়েকটি দল। তবে দ্বিমত পোষণ করেছে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে জানিয়েছেন, বিতর্কিত নিয়োগ যাতে না হয়, সে লক্ষ্যে আপিল বিভাগের দুই থেকে তিনজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতির মধ্য থেকে একজনকে বাছাই করে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাব করছে বিএনপি।
সংবিধান সংশোধনে দুই কক্ষের অনুমোদনের পর গণভোট করার প্রস্তাবেও একমত হয়নি বিএনপি। সংবিধানে মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা নামে আলাদা অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করা এবং নিম্নকক্ষে তরুণদের জন্য ১০ শতাংশ আসনে মনোনয়ন দেওয়া, সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রার্থীর ন্যূনতম বয়স ২১ বছর এবং ১৮ বছরে ভোটার করার প্রস্তাবে এনসিপি একমত হলেও দ্বিমত পোষণ করেছে বিএনপিসহ তাদের মিত্র দলগুলো। সংবিধান সংস্কার কমিশন রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতার অবসানের প্রস্তাব করেছে। তাদের মতে, বর্তমান ব্যবস্থায় সব কিছুই প্রধানমন্ত্রী নিয়ন্ত্রণ করেন এবং তাঁর পরামর্শেই রাষ্ট্রপতি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান নির্বাচন করেন। ফলে রাষ্ট্রপতির কোনো কার্যকর ভূমিকা থাকে না। এ প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হয়নি বিএনপি।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কেউ অভিযুক্ত হলে তাকে নির্বাচনের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করার বিষয়ে কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে এনসিপি একমত হলেও দ্বিমত পোষণ করেছে বিএনপিসহ অধিকাংশ দল। বিএনপির মতে, কাউকে অভিযুক্ত করলেই তাকে দোষী বলা যায় না, আর শুধু অভিযোগের ভিত্তিতে কাউকে অযোগ্য ঘোষণা করা যুক্তিসংগত নয় বলেও দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। শুধু আদালতের রায়ে প্রাথমিকভাবে দোষী সাব্যস্ত হলে তবেই তাকে অযোগ্য ঘোষণা করা উচিত বলে মনে করে বিএনপি।
কমিশন সূত্র জানায়, বিএনপিসহ ক্রিয়াশীল দলগুলো সংবিধান ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে একমত হতে না পারায় চিন্তিত ঐকমত্য কমিশন। কমিশন আশা করেছিল, ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে যে আওয়াজ উঠেছিল, তাতে দলগুলো সংস্কার ইস্যুতে একমত হবে। কিন্তু বড় দলগুলো একমত হতে না পারায় জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংশয় তৈরি হবে। তার পরও কমিশনের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা সংলাপের পাশাপাশি অনলাইনে সাধারণ নাগরিকদের মতামত নেওয়া হবে। সংলাপ ও অনলাইনে পাওয়া মতামতের ভিত্তিতে যেসব বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে, তা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতিতে ‘জুলাই সনদ’ স্বাক্ষরিত হবে।
এসব বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মতানৈক্য থাকলেও তা অপরিবর্তনীয় নয়। সদিচ্ছা থাকলে পরস্পরের প্রস্তাবগুলো খোলা মনে বিশ্লেষণ করে ভিন্নমতের অবসান ঘটিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব।’
তিনি বলেন, ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তেমন একটি সহনশীল ও আলোচনাভিত্তিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। দ্বিতীয় দফা আলোচনার পর যেসব প্রস্তাবে ঐকমত্য হবে সেগুলো নিয়ে একটি জাতীয় সনদ বা জুলাই সনদ প্রণয়ন করা হবে। ওই সনদ বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সব দল স্বাক্ষর করবে। এই প্রক্রিয়া আগামী জুলাইয়ে শেষ হবে বলে আশা করছি।’