রাষ্ট্র সংস্কারে সমঝোতায় পৌঁছতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ১৬৬টি প্রস্তাবের একটি তালিকা তৈরি করে। এর ভিত্তিতে দেশের ৩৯টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে গত ফেব্রুয়ারি মাসে লিখিত মতামত আহবান করা হয়। পরে জোট ও দলগুলোর কেউ নির্দিষ্ট ফরমে আবার কেউ আলাদা কাগজে লিখে তাদের মতামত জানায়। ওই মতামতের আলোকে জোট ও দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশন গত ২০ মার্চ প্রথম দফা সংলাপ শুরু করে শেষ করে ১৫ মে।
রাষ্ট্র সংস্কারে সমঝোতার পথসন্ধান
নিখিল ভদ্র

তবে রাজনৈতিক জোট ও দলগুলোর সঙ্গে প্রথম দফা সংলাপে বেশ কিছু প্রস্তাবে ঐকমত্য হলেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবে উভয় পক্ষের পরস্পরবিরোধী মত রয়েছে। আবার কিছু কিছু প্রস্তাবে রাজনৈতিক জোট ও দলগুলো একমত হয়েও নতুন করে শর্ত জুড়ে দিয়েছে।
প্রায় দুই মাস ধরে চলা সংলাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালসহ বেশ কিছু বিষয়ে একমত হলেও জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ ক্রিয়াশীল দলগুলো সংবিধানের মূলনীতি, সাংবিধানিক কাউন্সিল, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব, এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুইবার প্রধানমন্ত্রী, সংসদ ও সরকারের মেয়াদ চার বছর করা, গণপরিষদ নির্বাচন এবং ভোটার ও প্রার্থীর বয়সসহ গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু প্রস্তাব নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেনি। এ পরিস্থিতিতে আগামী সপ্তাহ থেকে আবারও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
সূত্রগুলো জানায়, ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে রাজনৈতিক জোট ও দলগুলো জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের পক্ষে মত দিয়েছে।
সূত্র জানায়, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থীরা দলীয় প্রতীক ব্যবহার করতে পারবেন না, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এই প্রস্তাবে সমর্থন জানিয়েছে বিএনপি। সংবিধানে বহুত্ববাদ নিয়ে সংশোধনীতেও কমিশনের সঙ্গে একমত বিএনপি।
আবার জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সব সংসদীয় কমিটির সভাপতির পদ বিরোধী দলকে দেওয়ার প্রস্তাব করলেও বিএনপি কিছু কমিটির পদ বিরোধী দলকে দেওয়া যেতে পারে বলে জানিয়েছে।
সংবিধানের বেশির ভাগ মৌলিক পরিবর্তনের প্রস্তাবে বিএনপি ও তাদের সমমনা দল এবং বাম দলগুলো বিরোধিতা করেছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রের নাম ও সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তনে আপত্তি জানিয়েছে অধিকাংশ দল।
তবে সংবিধান, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচনব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে যেসব সুপারিশ করা হয়েছিল সেগুলোর অধিকাংশের সঙ্গে এনসিপি একমত হলেও আংশিক একমত হয়েছে জামায়াত।
দেশে ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা এবং বিচার বিভাগ—এই তিনটি বিভাগের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি)’ গঠন করার বিষয়ে কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে একমত নয় বিএনপি, জামায়াত ও বাম জোটসহ অধিকাংশ দল।
ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে একই ব্যক্তি দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না—এমন প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রস্তাবে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, গণ অধিকার পরিষদ ও ইসলামী আন্দোলন একমত। তবে এ সুপারিশের সঙ্গে একমত হয়নি দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি, ১২ দলীয় জোটসহ কয়েকটি দল। তারা চাইছে একই ব্যক্তি টানা দুবারের পর বিরতি দিয়ে আবাবও প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সংসদ সদস্যদের ফ্লোর ক্রসিংয়ের সুযোগ প্রদানের বিষয়ে দলগুলোর নানা মত রয়েছে। প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা চালুর প্রস্তাবেও আপত্তি জানিয়েছে অধিকাংশ দল।
ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে সংবিধানে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানকে এক কাতারে আনার বিষয়ে জামায়াত ও এনসিপি একমত হলেও ভিন্নমত পোষণ করেছে বিএনপি ও তাদের মিত্র দল এবং বাম দলগুলো। এ ছাড়া সংবিধানের মূলনীতি ও রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তনের প্রস্তাবেও একমত হয়নি তারা। সংবিধানে ‘বহুত্ববাদ’ সংযোজনে আপত্তি জানিয়েছে ইসলামী দলগুলো। সংবিধান ইস্যুতে বিএনপি পরবর্তী সংসদে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া যৌক্তিক বলে মত দিয়েছে। তারা মনে করে, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত হলে বেশির ভাগ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
জামায়াতে ইসলামী সংবিধানের মূলনীতিতে ‘আল্লাহর প্রতি অবিচল ঈমান-আস্থা’ পুনঃস্থাপনের প্রস্তাব করেছে। তারা সংবিধানে সাম্য, গণতন্ত্র, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচারের নীতিগুলো বজায় রাখার পক্ষে। আর বাহাত্তর সালের সংবিধানের চার মূলনীতি ও পরবর্তী সময়ে সংশোধনীর মাধ্যমে গৃহীত মূলনীতি বাদ দেওয়ার পক্ষে এনসিপি।
কমিশনের প্রস্তাব ছিল, ‘সংসদের মেয়াদ চার বছর এবং একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও দলীয় প্রধান হতে পারবেন না।’ এই প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হয়নি বিএনপি। তারা সংসদের মেয়াদ বিদ্যমান পাঁচ বছর রাখার পক্ষে অবস্থান নিয়ে বলেছে, একটি দলের প্রধান কে হবেন, তারা ক্ষমতায় গেলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, কে সংসদ নেতা হবেন, এসব ঠিক করার বিষয়টি দলের একান্ত নিজস্ব বিষয়। এসব সংবিধানে ঠিক করে দেওয়া যাবে না। তবে কমিশনের এ প্রস্তাবের সঙ্গে একমত এনসিপিসহ কয়েকটি দল। আর জামায়াত ও বাম দলগুলো সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছরের পক্ষে মত দিয়েছে।
বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন সংসদ সদস্যদের ভোটে। তবে সংবিধান সংস্কার কমিশন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে নতুন পদ্ধতির প্রস্তাব দিয়ে বলেছে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন নির্বাচকমণ্ডলীর (ইলেকটোরাল কলেজ) সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে। আইনসভার উভয় কক্ষের সদস্যদের প্রত্যেকের একটি করে ভোট, জেলা সমন্বয় কাউন্সিল সামষ্টিকভাবে একটি করে ভোট (৬৪টি জেলা সমন্বয় কাউন্সিল থাকলে ৬৪টি ভোট), সিটি করপোরেশন সমন্বয় কাউন্সিল সামষ্টিকভাবে একটি করে ভোট দেবে। কমিশনের এ প্রস্তাবের সঙ্গে এনসিপি একমত হলেও দ্বিমত পোষণ করেছে বিএনপিসহ অধিকাংশ দল।
সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ এবং দলগুলোর প্রাপ্য ভোটের সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনের সুপারিশ করেছে। এ প্রস্তাবের সঙ্গে জামায়াত ও এনসিপি একমত হলেও আংশিক দ্বিমত পোষণ করেছে বিএনপি। তাদের প্রস্তাব—প্রাপ্য ভোটের ভিত্তিতে নয়, নিম্নকক্ষে প্রাপ্ত আসনের সংখ্যানুপাতে উচ্চকক্ষে প্রতিনিধি মনোনয়ন করা। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টিসহ কয়েকটি দলের পক্ষ থেকে সংসদের উভয় কক্ষের জন্য সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত এনসিপিসহ কয়েকটি দল। তবে দ্বিমত পোষণ করেছে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে জানিয়েছেন, বিতর্কিত নিয়োগ যাতে না হয়, সে লক্ষ্যে আপিল বিভাগের দুই থেকে তিনজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতির মধ্য থেকে একজনকে বাছাই করে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাব করছে বিএনপি।
সংবিধান সংশোধনে দুই কক্ষের অনুমোদনের পর গণভোট করার প্রস্তাবেও একমত হয়নি বিএনপি। সংবিধানে মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা নামে আলাদা অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করা এবং নিম্নকক্ষে তরুণদের জন্য ১০ শতাংশ আসনে মনোনয়ন দেওয়া, সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রার্থীর ন্যূনতম বয়স ২১ বছর এবং ১৮ বছরে ভোটার করার প্রস্তাবে এনসিপি একমত হলেও দ্বিমত পোষণ করেছে বিএনপিসহ তাদের মিত্র দলগুলো। সংবিধান সংস্কার কমিশন রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতার অবসানের প্রস্তাব করেছে। তাদের মতে, বর্তমান ব্যবস্থায় সব কিছুই প্রধানমন্ত্রী নিয়ন্ত্রণ করেন এবং তাঁর পরামর্শেই রাষ্ট্রপতি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান নির্বাচন করেন। ফলে রাষ্ট্রপতির কোনো কার্যকর ভূমিকা থাকে না। এ প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হয়নি বিএনপি।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কেউ অভিযুক্ত হলে তাকে নির্বাচনের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করার বিষয়ে কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে এনসিপি একমত হলেও দ্বিমত পোষণ করেছে বিএনপিসহ অধিকাংশ দল। বিএনপির মতে, কাউকে অভিযুক্ত করলেই তাকে দোষী বলা যায় না, আর শুধু অভিযোগের ভিত্তিতে কাউকে অযোগ্য ঘোষণা করা যুক্তিসংগত নয় বলেও দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। শুধু আদালতের রায়ে প্রাথমিকভাবে দোষী সাব্যস্ত হলে তবেই তাকে অযোগ্য ঘোষণা করা উচিত বলে মনে করে বিএনপি।
কমিশন সূত্র জানায়, বিএনপিসহ ক্রিয়াশীল দলগুলো সংবিধান ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে একমত হতে না পারায় চিন্তিত ঐকমত্য কমিশন। কমিশন আশা করেছিল, ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে যে আওয়াজ উঠেছিল, তাতে দলগুলো সংস্কার ইস্যুতে একমত হবে। কিন্তু বড় দলগুলো একমত হতে না পারায় জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংশয় তৈরি হবে। তার পরও কমিশনের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা সংলাপের পাশাপাশি অনলাইনে সাধারণ নাগরিকদের মতামত নেওয়া হবে। সংলাপ ও অনলাইনে পাওয়া মতামতের ভিত্তিতে যেসব বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে, তা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতিতে ‘জুলাই সনদ’ স্বাক্ষরিত হবে।
এসব বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মতানৈক্য থাকলেও তা অপরিবর্তনীয় নয়। সদিচ্ছা থাকলে পরস্পরের প্রস্তাবগুলো খোলা মনে বিশ্লেষণ করে ভিন্নমতের অবসান ঘটিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব।’
তিনি বলেন, ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তেমন একটি সহনশীল ও আলোচনাভিত্তিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। দ্বিতীয় দফা আলোচনার পর যেসব প্রস্তাবে ঐকমত্য হবে সেগুলো নিয়ে একটি জাতীয় সনদ বা জুলাই সনদ প্রণয়ন করা হবে। ওই সনদ বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সব দল স্বাক্ষর করবে। এই প্রক্রিয়া আগামী জুলাইয়ে শেষ হবে বলে আশা করছি।’
সম্পর্কিত খবর

মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক বাণিজ্য উপদেষ্টার
পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কমিশন করা হবে
নিজস্ব প্রতিবেদক

পাকিস্তানের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক বাণিজ্য বাড়াতে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান থেকে যেন আমরা প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে পণ্য আমদানি করতে পারি, সে লক্ষ্যেই এ কমিশন গঠন করা হবে।’
গতকাল বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন উপদেষ্টা।
তিনি জানান, বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বাড়ানোসহ বিভিন্ন খাতে সম্ভাব্য সহযোগিতা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে।
বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা পাকিস্তানকে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড আমদানির ওপর আরোপিত অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক প্রত্যাহারের অনুরোধ করেছি। তারা বিষয়টি বিবেচনায় নেবে বলে জানিয়েছে।
তিনি জানান, পাকিস্তানের সঙ্গে কয়েকটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের প্রস্তুতি চলছে। এর মধ্যে রয়েছে জয়েন্ট ট্রেড কমিশনের পুনর্গঠন, কানেক্টিভিটি বৃদ্ধি এবং বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কমিশন গঠন। যদিও আগে থেকেই জয়েন্ট ট্রেড কমিশন ছিল, তবে কার্যক্রম ছিল সীমিত।
পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ালে ভারতের সঙ্গে বৈরিতা বাড়বে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, ‘আমার দায়িত্ব দেশের বাণিজ্যিক সক্ষমতা বাড়ানো। পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রশ্নে পররাষ্ট্র উপদেষ্টাকে জিজ্ঞেস করুন। এটা আমার কনসার্ন নয়। আমরা দেশের স্বার্থে কাজ করছি।
বাংলাদেশ পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকছে কি না জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা সবার দিকেই ঝুঁকছি—পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত; যেখানে দেশের স্বার্থ আছে, সেখানেই ঝুঁকছি। ভারতের কাছ থেকেও তো আমরা পেঁয়াজ আনছি।’
বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘প্রায় দেড় দশক ধরে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য কার্যত সীমিত ছিল। তারা এখন আগ্রহ দেখাচ্ছে। আমরাও বাণিজ্য বাড়াতে কোনো অসুবিধা দেখছি না। দুই দেশের স্বার্থ সমুন্নত রেখে এগোতে চাই।’
বাণিজ্যসচিব আরো বলেন, ‘পাকিস্তান থেকে আমরা বেশি আমদানি করি, কিন্তু রপ্তানি করি তুলনামূলকভাবে কম। এই ভারসাম্যহীনতা দূর করা দরকার। পাকিস্তানে যেসব পণ্য রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে, সেসব বিষয়ে উপদেষ্টা দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।’
সচিব জানান, খাদ্য, পাথরসহ বেশ কিছু পণ্য প্রতিযোগিতামূলক দামে পাকিস্তান থেকে আমদানি করা সম্ভব। তবে আমদানি বাড়ানোর পাশাপাশি রপ্তানির দিকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ প্রায় ৭৮৭ মিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করেছে। একই সময়ে রপ্তানি করেছে মাত্র ৭৮ মিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য।
বাণিজ্য উপদেষ্টার সঙ্গে এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার ইমরান হায়দার, বাংলাদেশে পাকিস্তান হাইকমিশনের রাজনৈতিক কাউন্সেলর কামরান ধাংগাল, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ প্রতিনিধি জাইন আজিজ এবং বাণিজ্য সহকারী ওয়াকাস ইয়াসিন।

উপদেষ্টা আসিফের প্রেস সেক্রেটারির বিরুদ্ধে টেন্ডারবাজির অভিযোগ
নিজস্ব প্রতিবেদক

অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি মাহফুজ আলমের বিরুদ্ধে টেন্ডারবাজির অভিযোগ উঠেছে। এসংক্রান্ত একটি অডিও ফাঁস করেছেন সাংবাদিক জাওয়াদ নির্ঝর। অডিওতে মাহফুজ আলমকে টেন্ডারের কমিশন নিয়ে এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলতে শোনা যায়। সাংবাদিক জাওয়াদ নির্ঝরের জোর দাবি, কথোপকথনটি অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার প্রেস সেক্রেটারি মাহফুজ আলমের।
ফাঁস হওয়া অডিওতে মাহফুজ আলমকে এক ব্যক্তির সঙ্গে টেন্ডার নিয়ে কথা বলতে শোনা যায়। কথার এক পর্যায়ে ফোনের অন্য প্রান্তে থাকা ব্যক্তি ৩ শতাংশ কমিশন দেওয়ার কথা বলে।
কাজের প্রসেস সম্পর্কে তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি যেটা করছি তা হলো অ্যাডভাইজার মহোদয় সাইন করবেন, ফিফটি পার্সেন্ট দিয়ে দেবে; সিসিজিবি পাস হবে, বাকি ফিফটি পার্সেন্ট দিয়ে দেবে।’ তাঁকে আরো বলতে শোনা যায়, ‘আপনি ওদের বলেন এখন সবই হচ্ছে এই ফরম্যাটে।
কথা ঠিক না থাকলে ফাইল আটকে দেওয়ারও হুমকি দেন মাহফুজ আলম। তিনি বলেন, ‘আমি ফাইল আটকে রাখব এখন। কমিটমেন্ট ঠিক না থাকলে তো এখন দেখছেন। কথা দুই রকম হইলে কিন্তু সমস্যা হয়, বুঝছেন?...আমি আজ ইজিপি করাব, করায়ে কিন্তু আমি নোয়া (চুক্তিপত্র) ঝুলিয়ে রাখব। আপনি কনফার্মেশন দেবেন, এরপর নোয়া। আর দুইটা ১.৫, দুইটা ১ পার্সেন্ট—এগুলো কিন্তু হবে না ভাই; ১.৫ মানে ১.৫, দ্যাটস ইট।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মাহফুজ আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘স্থানীয় সরকার উপদেষ্টাকে হেয় করার জন্য এবং নানাভাবে চাপে ফেলার জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে নানা বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। এটি যারা করছে, তাদেরই কেউ এআই ব্যবহার করে আমার নামেও মিথ্যা গুজব ছড়াচ্ছে।’

গাজায় ইসরায়েলি অভিযান শুরু
পালাচ্ছেন অসহায় ফিলিস্তিনিরা
কালের কণ্ঠ ডেস্ক

ফিলিস্তিনের গাজা শহরটির দখল ও নিয়ন্ত্রণে নেওয়া পরিকল্পিত স্থল অভিযানের প্রাথমিক পদক্ষেপ শুরু হয়েছে। এর পর থেকেই শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে পালাচ্ছেন অসহায় ও ক্ষুধার্ত মানুষ। গাজার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পরিকল্পিত স্থল আক্রমণের অংশ হিসেবে গত বুধবার তীব্র বোমাবর্ষণ ও আর্টিলারি হামলা শুরু করেন ইসরায়েলি সেনারা। এরপর শহরের উপকণ্ঠে ঘাঁটি স্থাপন করেছেন তাঁরা।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফি ডেফরিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা গাজা সিটিতে প্রাথমিক অভিযান এবং আক্রমণের প্রথম ধাপ শুরু করেছি।’ তিনি আরো বলেন, সেনারা এরই মধ্যে জেইতুন ও জাবালিয়া এলাকায় অভিযান চালাচ্ছে। শহরের জেইতুন ও সাবরা পাড়ার শত শত বাসিন্দা শহরের উত্তর-পশ্চিম দিকে সরে গেছে।
এমন পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহবান জানিয়েছেন। তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘এই আক্রমণ অবশ্যম্ভাবীভাবে মৃত্যু ও ধ্বংস ডেকে আনবে।’ ইসরায়েল আন্তর্জাতিক সমালোচনা উপেক্ষা করে পুরো গাজা সিটি দখলের পরিকল্পনায় অটল রয়েছে—এ বার্তাই দিতে চাইছে। গত মঙ্গলবার গাজা সিটি দখলের পরিকল্পনার অনুমোদন দেন ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাত্জ।
প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, তিনি গাজায় শেষ সন্ত্রাসী ঘাঁটিগুলো দখলের সময়সীমা কম করছেন। অন্যদিকে হামাস এক বিবৃতিতে অভিযোগ করেছে, নেতানিয়াহু নিরপরাধ বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে নৃশংস যুদ্ধ চালাচ্ছেন এবং আঞ্চলিক মধ্যস্থতাকারীদের নতুন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবকে উপেক্ষা করছেন।
গাজা সিটি দখলের পরিকল্পনা ইসরায়েল এগিয়ে নিতে থাকায় সেখানকার লাখো বাসিন্দাকে দক্ষিণাঞ্চলে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইসরায়েলের অনেক মিত্র গাজা সিটি দখলের এ পরিকল্পনার নিন্দা জানিয়েছে। গত বুধবার ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ সতর্ক করে বলেছেন, এ পরিকল্পনা ‘দুই জাতির জন্যই বিপর্যয় ডেকে আনবে এবং গোটা অঞ্চলকে স্থায়ী যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেবে।’
আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি বলেছে, নতুন করে বাস্ত্যুচ্যুতি ও সহিংসতা বেড়ে গেলে গাজার ২১ লাখ মানুষের জন্য পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে উঠবে। গত মাসে হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তির পরোক্ষ আলোচনা ভেঙে যাওয়ার পর ইসরায়েল পুরো গাজা উপত্যকা দখলে নেওয়ার ঘোষণা দেয়।
আইডিএফের মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফি ডেফরিন আরো বলেন, জেইতুন এলাকায় দুটি ব্রিগেড ও জাবালিয়ায় আরেকটি ব্রিগেড অভিযান চালাচ্ছে। তার দাবি, জেইতুনে সাম্প্রতিক অভিযানে অস্ত্রভর্তি একটি ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গও শনাক্ত করা হয়েছে।
ডেফরিন বলেন, বেসামরিক মানুষের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে গাজা সিটির বাসিন্দাদের আগে থেকেই নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হবে। এদিকে হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজার সিভিল ডিফেন্স এজেন্সির মুখপাত্র মাহমুদ বাসসাল এএফপিকে বলেছেন, জেইতুন ও সাবরা এলাকার পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়ংকর ও অসহনীয়।
ডেফরিন দাবি করেন, গাজায় এখনো ৫০ জন জিম্মি রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ২০ জন জীবিত বলে ধারণা করা হচ্ছে। অভিযানে তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। তবে জিম্মিদের পরিবারগুলোর আশঙ্কা, স্থল অভিযানে তাঁদের জীবন হুমকিতে পড়তে পারে। সূত্র : বিবিসি, এএফপি

ভিপি প্রার্থী আবিদ
ছাত্রদল গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্যানেল ঘোষণা করেছে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি

বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্রদলই একমাত্র সংগঠন, যারা নিজেদের অভ্যন্তরীণ নেতাকর্মীদের ভোটে প্রার্থী নির্বাচন করেছে। অন্য কোনো সংগঠন এভাবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্যানেল ঘোষণা করেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গণতান্ত্রিক এই প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানাবেন এবং গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে তাঁরা আমাদের পাশে থাকবেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মধুর ক্যান্টিনের সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান এসব কথা বলেন।
সংবাদ সম্মেলনে আবিদুল ইসলাম বলেন, ‘বুধবার ছাত্রদল সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ডাকসু প্যানেল ঘোষণা করেছে। ঢাবি ছাত্রদল ও কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ ভোটাধিকার ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে এই ডাকসু প্যানেল নির্বাচন করা হয়েছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে বুধবার অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে ডাকসু-২০২৫ নির্বাচনে প্রতিনিধিত্বকারী ছাত্রদলের প্যানেল ঘোষণা করা হয়।
তিনি বলেন, ‘অন্য প্যানেলগুলোর ভিপি, জিএস ও এজিএস তাদের মূল সংগঠনের সভাপতি, সেক্রেটারি ও সাংগঠনিক সম্পাদক থেকে এসেছে। আমাদের ঢাবি শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ইচ্ছা করলেই ভিপি ও জিএস পদে দাঁড়াতে পারতেন। কিন্তু তাঁরা বর্তমান পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে জায়গা ছেড়ে দিয়ে জুনিয়রদের সামনে এনেছেন। তাঁরা জুনিয়র শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন।
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা শহীদ আনাসের কবর জিয়ারতের মধ্য দিয়ে ডাকসু নির্বাচনের কার্যক্রম শুরু করেছি। আমরা আজকে (গতকাল) ইশতেহার ঘোষণা করছি না। তবে আমাদের ইশতেহারের বিষয়ে আপনাদের জানিয়ে রাখি, আমরা গেস্টরুম, গণরুম কালচার এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিরতরে শিকড়সহ উপড়ে ফেলব। আমরা শিক্ষার্থীদের আবাসন, নিরাপত্তা ও নিশ্চিন্তে শিক্ষার পরিবেশ তৈরিতে কাজ করব। বিশেষ করে যেসব শিক্ষার্থীকে চার-পাঁচটি প্রাইভেট পড়িয়ে এরপর ঢাকায় থাকার ব্যবস্থা করতে হয়, আমরা তাঁদের বিষয়ে ভালো ব্যবস্থার চেষ্টা করব, যেন তাঁরা একাডেমিক পড়ালেখায় মনোযোগ দিতে পারেন।’