প্রশ্ন : বিদ্যমান অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যিক পরিস্থিতিকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
উত্তর : ১৫ বছর ধরে ব্যাংকিং খাতে একটা অস্থিরতা ছিল। অর্থনীতিও একটা সমস্যার মধ্যে ছিল। যদিও আগের সরকার বলত যে তারা বেশ উন্নতি করেছে। মেগা প্রকল্প করেছে ইত্যাদি।
প্রশ্ন : বিদ্যমান অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যিক পরিস্থিতিকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
উত্তর : ১৫ বছর ধরে ব্যাংকিং খাতে একটা অস্থিরতা ছিল। অর্থনীতিও একটা সমস্যার মধ্যে ছিল। যদিও আগের সরকার বলত যে তারা বেশ উন্নতি করেছে। মেগা প্রকল্প করেছে ইত্যাদি।
খেলাপি ঋণ হয়েছে মূলত রাজনৈতিকীকরণের কারণে। বিশেষ করে পর্ষদ, পরিচালক, ম্যানেজমেন্ট, কাস্টমার এদের একটা যোগসাজশের মাধ্যমে ঋণ কেলেঙ্কারিটা হয়েছে। সবাই মিলেমিশেই এটা করেছে। যোগ্য গ্রাহক নির্বাচন করা হয়নি। একজন যোগ্য গ্রাহক নির্বাচন করতে যেসব পদ্ধতি অবলম্বন করা দরকার, সেটা করা হয়নি।
জুলাই বিপ্লবের পর একটি অন্তর্বর্তী সরকার এসেছে। তারা আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ধসটা বন্ধ হয়েছে। এখন আস্তে আস্তে এটাকে আরো ভালো অবস্থায় নিতে হবে। সেটা এখনো হয়ে ওঠেনি। এর জন্য কিছু করার আছে। রেগুলেটররা আছেন, তাঁদের ভূমিকা আছে। এক কথায় বলতে গেলে করপোরেট সুশাসন প্রত্যেকটা পর্যায়ে বাড়াতে হবে। করপোরেট গভর্ন্যান্স হলো সততা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা। আমি আরেকটা পিলার যোগ করতে চাই—সদিচ্ছা। সদিচ্ছা না থাকলে কিছুই হবে না। অর্থাৎ সদিচ্ছা, সততা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকতে হবে সব স্তরে। এভাবে যদি আমরা প্রতিটা স্তরে কাজ করি, তাহলে দেশের জন্য, দশের জন্য কাজ করতে আর দুশ্চিন্তা লাগবে না।
প্রশ্ন : খেলাপি ঋণ বাড়ার পেছনে নীতির দুর্বলতা রয়েছে কি না?
উত্তর : খেলাপিটা বেড়ে গেছে। কেননা, অনেকে টাকা বাইরে নিয়েছে গেছে। কেউ কেউ জেলে আছে, বিচার হবে। কেউ বলছে ৫০ হাজার কোটি, কেউ বলছে লাখ লাখ কোটি টাকা নিয়ে গেছে। টাকার পরিমাণ আমি জানি না। তবে এগুলো কিন্তু সত্যি। এ টাকাটা তারা বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় বিনিয়োগ করেছে। খেলাপি ঋণ বাড়ার এটা হচ্ছে প্রধান কারণ। এ ছাড়া এখানে যে শীর্ষ দশ ব্যাবসায়িক গ্রুপ রয়েছে, তারাও জুলাই বিপ্লবের পর খেলাপি হয়ে গেছে। তারা হয়তো ব্যবসা করতে পারেনি। আমি আমার ব্যাংকের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তাদের সঙ্গে কথা বলছি, বসছি। তারাও সাড়া দিচ্ছে। এই গ্রুপগুলো যদি একটু সাপোর্ট পায়; তাদের সক্ষমতা আছে, তারা খেলাপি ঋণকে নিয়মিত করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের যত সার্কুলার আছে, এগুলো পর্যালোচনা করে যদি রিশিডিলিং করে দেওয়া হয় এবং মিনিমাম ডাউন পেমেন্ট দিয়ে তাদের নিয়মিত করার সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে কিন্তু বেঁচে যাবে। আগে ক্লাসিফায়েডের ক্ষেত্রে ছয় মাসের কথা বলা হতো। এখন বলা হচ্ছে তিন মাস। এটাকে আমি খারাপ বলব না। এর মাধ্যমে খেলাপির প্রকৃত চিত্রটা জানা যাবে। তার পরে পদক্ষেপ নেওয়া যাবে যে কিভাবে আগানো হবে। তবে আইএমএফের কথায় তো সব হবে না। আমি যখন অগ্রণী ব্যাংকের এমডি ছিলাম, তখন আমি নানা উপায়ে খেলাপি ঋণ কমিয়ে এনেছি। আমি যখন ছেড়ে যাই, তখন ব্যাংকের সব ইন্ডিকেটর পজিটিভ ছিল। চার শর মতো লোকসানি শাখাকে আমি ৭০টিতে নামিয়ে এনেছিলাম। এগুলো সবই ছিল আমার পজিটিভ স্টেপ। সবাইকে নিয়েই আমি কাজটা করেছি। এখন যখন আমি আবার ব্যাংকটিতে ঢুকেছি, এখন দেখি সবই নেগেটিভ।
প্রশ্ন : পাচারের টাকা ফেরানোর পদক্ষেপ কি যথেষ্ট?
উত্তর : অবৈধ উপায়ে যেসব টাকা চলে গিয়েছে, সেটা আমাদের প্রুফ করে নিয়ে আসতে হবে। কিছু হুন্ডিতে, কিছু পকেটে, আর কিছু গেছে সুটকেসে করে। এটা যদি জানা যায় যে কোন দেশে গেছে এবং তাদের সঙ্গে যদি আমাদের এগ্রিমেন্ট থাকে, তাহলে কিন্তু টাকা ফেরানো সম্ভব। তবে সময় লাগবে। কিন্তু আমি বলতে পারব না যে এক বছরের মধ্যে হবে। বেশ কয়েক বছর সময় লাগতে পারে। যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকাটা যে চুরি হলো সেটা শ্রীলঙ্কাতে যখন গেল, সেটা ধরতে পারায় ফেরত আনা গেছে; কিন্তু যেটা ফিলিপাইনে ক্যাসিনোতে গেল, সেটা কিন্তু ফেরানো যায়নি। এখন মামলা হয়েছে। এরপর দেখা যাক কী হয়। আমি আশাবাদী। আমি বিশ্বাস করি সময় লাগলেও পাচারের টাকা ফিরিয়ে আনা যাবে, যদি ঠিকমতো হ্যান্ডেল করা যায়।
প্রশ্ন : আস্থাহীনতায় বিনিয়োগ হচ্ছে না। আস্থা ফেরানো যায় কিভাবে?
উত্তর : এটা তো নির্বাচিত সরকার না। অন্তর্বর্তী সরকার। ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সরকার গঠিত হয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত না নির্বাচিত সরকার আসবে, ততক্ষণ পর্যন্ত পলিসিগত অনেক দুর্বলতা থেকে যাবে। এখন সরকার প্রশাসনিক আদেশের মাধ্যমে কাজ করছে। নির্বাচিত সরকার এলে এই আদেশগুলো সংসদে আইন আকারে পাস হবে। যেকোনো দেশে এ রকম অন্তর্বর্তী সরকারের সময় এফডিআই কম আসে। ভালো খবর হলো, এ সময় কিন্তু আমাদের যারা প্রবাসী আছেন, তাঁরা বেশি হারে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। এর ফলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বেড়ে গেছে। এখানে কিন্তু এফডিআইয়ের অবদান কম। বড় ভূমিকা রেখেছে রেমিট্যান্স। আর রপ্তানি আয়ের কিছু টাকা আটকে ছিল সেটার একটা অংশ আসা শুরু হয়ে গেছে। এটাও ফরেন কারেন্সিকে হেল্প করছে। আমি মনে করি এটা একটা ইতিবাচক দিক। এফডিআই এর ক্ষেত্রেও টাইম লাগবে। হঠাৎ করে তো আর সব হয়ে যাবে না।
আমি বিশ্বাস করি, এখন সরকার যা করছে, তারা সঠিক পথেই আছে। তারা সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ নিচ্ছে। আমি বলব যে লু-ফলসগুলো ছিল বা গর্ত ছিল সেগুলো বন্ধ হয়েছে। এখন অর্থনীতিটা একটা স্টেবল কন্ডিশনের মধ্যে আছে। এটাকে আস্তে আস্তে সামনের দিকে ওপরে ওঠাতে হবে। তাহলে আমরা ভালো করব।
প্রশ্ন : বিনিয়োগ সম্মেলনের সময় মব ভায়োলেন্স হলো। অনেক বিদেশি প্রতিষ্ঠানে হামলা হলো। এগুলো কিভাবে বন্ধ করা যায়?
উত্তর : আমি মনে করি যাঁরা বিনিয়োগকারী, তাঁরা ছোটখাটো ইন্সিডেন্টের ব্যাপারটা অত চিন্তা করেন না। তাঁরা দেখেন যে পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত সুবিধা আছে কি না, সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন, শ্রমিকের সহজলভ্যতা কেমন। মূলত এসবের ওপরে তাঁরা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেন। এ রকম অনেক ফ্যাক্টর আছে। কস্টিং কেমন হতে পারে, লাভ কেমন হতে পারে, সেটা স্থানান্তর করার আইন-কানুন কতটা সহজলভ্য—এগুলোর ওপর তারা বেশি জোর দিয়ে থাকেন। যে বিনিয়োগ সম্মেলনটা হলো আমি মনে করি, এটা খুবই সফল হয়েছে এবং এ জন্য বিডা ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। এখানে যে ছোটখাটো ইনসিডেন্টগুলা হয়েছে, এটা আসলে হয়েছে মূলত ফিলিস্তিনের গাজা ইসুতে। আমরা মুসলিম হিসেবে যখন এ রকম দুঃখজনক ঘটনা দেখি তখন সত্যিই তা আমাদের বুকে লাগে।
সম্পর্কিত খবর
রাজধানীতে ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’র ব্যানারে আয়োজিত বিক্ষোভ মিছিলে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কর্মীদের অংশগ্রহণের অভিযোগ উঠেছে। গত রবিবার দুপুরে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব এলাকায় শুরু হওয়া বিক্ষোভ মিছিল শাহবাগ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মিটফোর্ড হাসপাতালে গিয়ে শেষ হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, দুপুর ১টার দিকে ধানমণ্ডির আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীরা সায়েন্স ল্যাবে উপস্থিত হয়ে ১০ মিনিট অবস্থান করেন। এরপর তাঁরা মিছিল নিয়ে শাহবাগ হয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালে যান।
এ সময় হাসপাতাল ও আশপাশে থাকা বিএনপির ব্যানার ছিঁড়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায় কয়েকজনকে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ছবিসংবলিত ব্যানার পদদলিত করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার পর অনেকেই সাধারণ শিক্ষার্থীর ছদ্মবেশে রাজপথে সক্রিয় হচ্ছে। কেউ কেউ আবার বিএনপির প্ল্যাটফর্মে ঢুকে অস্থিতিশীলতা তৈরি করছে।
রাজনৈতিক পরিচয় : সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিক্ষোভের বেশ কিছু ছবি ছড়িয়ে পড়েছে। বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেওয়া ‘আইডিয়াল কলেজ শিক্ষার্থী’ ইয়ামিনকে তাঁর সহপাঠীরা নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে চিহ্নিত করেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি মাদারীপুর জেলায়। আগেও তাঁকে ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষে নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে।
নেপথ্যে রাজনৈতিক হিসাব : রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. দিলারা চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এটি রাজনৈতিক দলগুলোর ভিত নষ্ট করার একটি অপচেষ্টা। এর ফলে আবারও ১/১১-এর মতো সংকট সৃষ্টি হতে পারে। রাজনৈতিক দলে বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ বাড়ছে। সোহাগ, যিনি আগে হাজি সেলিমের সঙ্গে ছিলেন, এখন বিএনপির কর্মী। বিএনপি যদি নিজেকে রক্ষা করতে চায়, তাহলে শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে।’
এ বিষয়ে জানতে কোতোয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ ইয়াসিন শিকদারের মোবাইলে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
জানতে চাইলে ডিএমপি উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ওই মিছিলে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের উপস্থিতির বিষয়টি আমাদের জানা নেই। তবে নিষিদ্ধ যেকোনো দলের কার্যক্রম রুখে দিতে পুলিশ সব সময় প্রস্তুত রয়েছে। এর আগেও রাজধানীতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে যারা ঝটিকা মিছিল করেছে, তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। এই বিষয়টিও আমরা খতিয়ে দেখব।’
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহীম খলীল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যারা গুপ্ত রাজনীতি করে এবং বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করতে চায় তারা জল ঘোলা করতে এমন কর্মকাণ্ড করছে। তারা স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারমান তারেক রহমানকে নিয়ে কটূক্তিমূলক ভিডিও করেছে। তাদের ব্যানার পদদলিত করে আগুন জ্বালিয়েছে। যারা স্বৈরাচারের আমলে তাদের লুঙ্গির নিচে ছিল, তারাই এখন ঘোলা জলে মাছ শিকার করা চেষ্টা করছে। জনগণের কাছে তাদের অবস্থান না থাকার কারণে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পেছনে থেকে গুপ্ত হামলা করার চেষ্টা করছে।’
তিনি বলেন, “পুলিশের তদন্তে এসেছে ‘ব্যাবসায়িক দ্বন্দ্ব’ থেকে সোহাগ হত্যাকাণ্ড। এর পরও আমরা বিএনপির পক্ষ থেকে শোক জানিয়েছি, এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছি। একই সঙ্গে দোষীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার জোর দাবিও জানিয়েছি।”
গত ১০ মাসে (২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত) দেশে তিন হাজার ৫৫৪ জন খুনের ঘটনা ঘটেছে। একই সময়ে ডাকাতি হয়েছে ৬১০টি, দস্যুতা এক হাজার ৫২৬টি, দাঙ্গা ৯৭টি, ধর্ষণ চার হাজার ১০৫টি, এসিড নিক্ষেপ পাঁচটি, নারী ও শিশু নির্যাতন ১২ হাজার ৭২৬টি, অপহরণ ৮১৯টি, সিঁধেল চুরি দুই হাজার ৩০৪টি, চুরি সাত হাজার ৩১০টি এবং এই সময়ে রুজুকৃত মামলার সংখ্যা এক লাখ ৪৪ হাজার ৯৫৫টি।
গতকাল সোমবার প্রধান উপদেষ্টার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে প্রকাশিত ১০ মাসের অপরাধ পরিসংখ্যানে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী এসব পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়েছে।
অপরাধ পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে দেশে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে ৩৬৭টি, খুন হয়েছে এক হাজার ৯৩৩টি এবং ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে দুই হাজার ৭৪৪টি। এ সময় নারী নির্যাতন ছয় হাজার ১৪৪টি এবং শিশু নির্যাতনের দুই হাজার ১৫৯টি ঘটনা ঘটেছে।
এর আগের বছর ২০২৪ সালে ডাকাতি হয়েছিল ৪৯০টি, খুন চার হাজার ১১৪টি, ধর্ষণ চার হাজার ৩৯৪টি, নারী নির্যাতন ১০ হাজার ১৯৮টি এবং শিশু নির্যাতন দুই হাজার ৯৬৪টি।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, চলতি বছর দেশে অপরাধের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত এমন খবরে জনমনে আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত সরকারি অপরাধ পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি বছর বড় ধরনের অপরাধের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে—এমন দাবি সঠিক নয়। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ মাসে বড় ধরনের অপরাধের প্রবণতা স্থিতিশীল রয়েছে।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, পরিসংখ্যানে বড় ধরনের অপরাধের দ্রুত বাড়ার কোনো লক্ষণ নেই। বাস্তবে বেশির ভাগ গুরুতর অপরাধের হার কমছে বা একই পর্যায়ে রয়েছে।
প্রেস উইং নাগরিকদের প্রতি সতর্ক থাকার আহবান জানিয়ে বলেছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ওপর আস্থা রাখতে হবে। কারণ অপরাধের হার মোটামুটি স্থিতিশীল, যাতে বোঝা যায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে।
ময়মনসিংহের ভালুকায় দুই সন্তানসহ মাকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। সিরাজগঞ্জে শিশুকে হত্যা করে ঘরে লুকিয়ে রেখেছে সত্মা। এ নিয়ে দেশের পাঁচ জেলায় সাতজনকে খুন করা হয়েছে। আর তিন জেলা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে চারজনের লাশ।
ভালুকা (ময়মনসিংহ) : পৌর এলাকার পনাশাইল রোডে এক ভাড়া বাসায় মা ও দুই সন্তানকে হত্যা করা হয়। নিহতরা হলো নেত্রকোনার কেন্দুয়ার রফিকুল ইসলামের স্ত্রী ময়না বেগম (২৫), মেয়ে রাইসা (৭) ও ছেলে নীরব (২)।
স্থানীয় ও থানা সূত্রে জানা যায়, রফিকুল ইসলাম এখানে ভাড়া থেকে ভালুকায় একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। রবিবার রাত ৮টার সময় তিনি কর্মস্থলে যান এবং গতকাল সকালে ফিরে বাসার বারান্দার দরজা তালাবদ্ধ দেখেন।
রফিকুলের ভাই নজরুল ইসলাম একই বাসায় পাশাপাশি কক্ষে থাকেন। নিজ এলাকার একটি হত্যা মামলায় জামিনে থাকা আসামি নজরুল ভালুকায় অটো চালাতেন। ঘটনার পর থেকে তিনি নিরুদ্দেশ, তাঁর মোবাইল ফোনটিও বন্ধ।
সিরাজগঞ্জ : কামারখন্দ উপজেলায় সাত বছর বয়সী এক কন্যাশিশুকে হত্যার পর বস্তাবন্দি করে ঘরে লুকিয়ে রেখে এক সত্মা পালিয়ে যান। রবিবার রাত ১০টার দিকে শিশুটির মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরে ওই রাতেই সত্মাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
নিহত শিশু হাজেরা খাতুন উপজেলার কুটিরচর এলাকার হারুনার রশিদের মেয়ে। শিশুটির দাদি মনোয়ারা খাতুন জানান, রবিবার দুপুরে শিশু হাজেরা স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পর থেকে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।
এদিকে সিরাজগঞ্জ সদর ও তাড়াশ উপজেলা থেকে গতকাল সকালে দুই যুবকের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। সদরে উদ্ধার হওয়া আনুমানিক ৩৫ বছর বয়সী যুবকের পরিচয় পাওয়া যায়নি। সদর থানার এসআই শফিউল আলম জানান, তাঁর মাথা ও পায়ে আঘাতের চিহ্ন আছে।
অন্যদিকে তাড়াশে নিহত সেলুনকর্মী শান্ত (২০) ঈশ্বরপুর গ্রামের শরিফুল ইসলামের ছেলে। তাড়াশ থানার ওসি জিয়াউর রহমান জানান, সকালে নিজ ঘর থেকে শান্তর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
বারহাট্টা থানার ওসি কামরুল হাসান জানান, আহাদুলের সঙ্গে প্রতিবেশী মনহর আলী ও তাঁর চার ছেলে আলমগীর, অনিক, নির্ঝর ও বাবুর জমিসংক্রান্ত বিরোধ ছিল। তার জেরেই ওরা ঢাকা থেকে এসে হত্যাকাণ্ড ঘটায়।
চট্টগ্রাম : পতেঙ্গা থানার কাটগড় এলাকায় পারিবারিক কলহের জেরে ছুরিকাঘাতে ফেরদৌসী আক্তার নামের এক নারী খুন হয়েছেন। রবিবার রাত ১টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।
নিহত ফেরদৌসী এলাকার লোকমান হোসেনের স্ত্রী। নিহতের স্বজন ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, পারিবারিক কলহের জেরে ফেরদৌসীর দেবর তাঁর ঘাড়, পিঠ ও পেটে ছুরিকাঘাত করে।
নিহতের ভাই মামুন খান বলেন, ‘বিয়ের পর থেকে আমার বোনকে তাঁর স্বামী, শাশুড়ি পরিবারের লোকেরা নির্যাতন করে আসছিল। আমরা একটি সিসিটিভির ফুটেজে দেখেছি, লোকমানের বড় ভাই সোলেমান ও ছোট ভাই রনির হাতে ছুরি। আমরা খুনিদের বিচার চাই।’
ঘটনার পর ফেরদৌসীর স্বামী লোকমানকে পুলিশ হেফাজতে নিয়েছে। শ্বশুরবাড়ির বাকি লোকজন পলাতক।
বারহাট্টা (নেত্রকোনা) : জমিসংক্রান্ত বিরোধে আহাদুল মিয়া (২৬) নামের এক যুবককে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। গতকাল দুপুরে তাঁর লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য নেত্রকোনা হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে।
এর আগে রবিবার রাতে উপজেলার বাউশী ইউনিয়নের শাসনউড়া গ্রামে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। আহাদুল মিয়া ওই গ্রামের সিদ্দিক মিয়ার ছেলে।
নরসিংদী : এক মাদক কারবারির বাড়ি থেকে সাজিদ হোসেন (২২) নামে এক তরুণের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। গতকাল সকালে সদর উপজেলার শিলমান্দী ইউনিয়নের বাগহাটা টেকপাড়া গ্রামে দুলালের বাড়ি থেকে লাশটি উদ্ধার করা হয়।
পুলিশ বলছে, নিহত যুবকের বিরুদ্ধে একাধিক মাদক মামলা রয়েছে। আবার যার বাড়ি থেকে মরদেহটি উদ্ধার করা হয়েছে তারাও চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। তবে নিহতর পরিবারের অভিযোগ, মাদক ব্যবসায়ী দুলালের বাড়িতে নির্যাতন করে সাজিদকে হত্যা করা হয়েছে।
পাবনা : পুকুরে ভাসমান অবস্থায় এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। গতকাল সকালে শহরের লাইব্রেরি বাজার এলাকার কলাবাগান কলোনির মিঠুর পুকুর থেকে এ মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নিহত যুবকের নাম-পরিচয় জানা যায়নি। তবে আনুমানিক বয়স হবে ৪০ বছর।
গাজীপুর : নিখোঁজের ছয় দিন পর এক শিশুর বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। গতকাল বিকেলে মহানগরীর ধীরাশ্রম এলাকা থেকে লাশটি উদ্ধার করা হয়। নিহত নাবিলা কানিজ সাবা ধীরাশ্রমের দাখিনখান এলাকার নাসির মিয়ার মেয়ে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত বুধবার শিশুটি বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়। অনেক খোঁজাখুঁজি করে সন্ধান না পেয়ে রাতে শিশুটির মা খাদিজা বেগম সদর থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। গতকাল বাড়ির পাশে ঝোপের ভেতর থেকে দুর্গন্ধ বের হতে থাকলে স্থানীয়রা বস্তাটির সন্ধান পায়। বস্তা খুলে সাবার গলিত লাশ পাওয়া যায়।
যাত্রা শুরুর মাত্র সাত মাসের মধ্যেই কর ফাঁকিবাজদের আতঙ্ক হয়ে উঠেছে আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিট। এ সময় ১৮৩ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এক হাজার ৮৭৪ কোটি টাকার কর ফাঁকি উদঘাটন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে আদায় হয়েছে ১১৭ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। বাকি টাকা আদায়ের প্রচেষ্টাও চলছে বলে জানা গেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্র জানায়, এক হাজার ৭৮৮টি বিভিন্ন শ্রেণির ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কর ফাঁকি ও অর্থপাচার মামলা তদন্ত করছে আয়কর গোয়েন্দা। এঁদের মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, খেলোয়াড়, অভিনেতা-অভিনেত্রী, ডাক্তার, আইনজীবী, প্রকৌশলী, শিক্ষক, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ সব পর্যায়ের দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি রয়েছেন। এনবিআরের অধীন ৪১টি কর অঞ্চল ও দেশের ৬৪ জেলার করদাতারাও এ কার্যক্রমের আওতায় রয়েছেন।
এয়ার টিকিট সিন্ডিকেট, পরিবহন ব্যবসায়ী, শেয়ারবাজার, আমদানি ও মজুদকারী, চালান জালিয়াতকারী, জুয়াড়ি, ক্ষমতার অপব্যবহারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির পাশাপাশি কমেছে জনদুর্ভোগ।
আয়কর গোয়েন্দার প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ২০২৪ সালের ১৮ জানুয়ারি। তবে কর্মচারী নিয়োগ ও ভাড়া অফিসে স্থানান্তরের পর মূল কার্যক্রম চালু হয়েছিল ২০২৪ সালের ১ ডিসেম্বর।
কর প্রশাসনে দক্ষ গোয়েন্দা গঠন, কর ফাঁকি, অর্থপাচার, বিভিন্ন আর্থিক অপরাধ শনাক্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া, রাজস্ব পুনরুদ্ধার করা, স্বচ্ছতা-জবাবদিহি, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, কর ফাঁকির তদন্তে অর্থের উৎস যাচাই করা ও দায়িত্বশীল অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে যৌথ কার্যক্রম পরিচালনার উদ্দেশ্যে এই বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
জানা গেছে, বিশেষায়িত এই গোয়েন্দা ইউনিট অল্প সময়ের ব্যবধানে সফলতা দেখালেও তার নেই প্রয়োজনীয় জনবল ও স্থায়ী অফিস ভবন। শুরুতে এনবিআর ভবনে অস্থায়ী কার্যালয় থাকলেও পরে ভাড়া করা অফিসে যাবতীয় কাজ করছে রাজস্ব ফাঁকি ঠেকিয়ে দেওয়া প্রতিষ্ঠানটি।
জানতে চাইলে আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিটের কমিশনার মো. আবদুর রকিব কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আয়কর গোয়েন্দা অল্প সময় ধরে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এই ইউনিটের সদস্যসংখ্যা কম হলেও তাঁরা মেধাবী ও পরিশ্রমী। তাঁদের কাজের প্রতি একাগ্রতা থাকায় আমরা সামগ্রিকভাবে ভালো করতে পারছি। তবে জনবল সংকট, প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সাপোর্ট পেলে এই ইউনিট দেশের জন্য আরো অনেক কিছু করতে পারবে। আমরা চাই দেশে একটি নতুন কর সংস্কৃতি। যেখানে কেউ কর ফাঁকি দিতে পারবেন না।’
জানা গেছে, ভবিষ্যতে এই ইউনিটের জন্য ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব স্থাপনের চিন্তা করা হচ্ছে। কর ফাঁকি-অর্থপাচার রোধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক, প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতা বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে। এ ছাড়া কর ফাঁকিবাজদের ডেটাবেইস তৈরি, নিয়মিত তল্লাশি-জব্দকরণ অভিযান পরিচালনা, কর নেটের বাইরে থাকা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কাজও করবে এই ইউনিট।