চাহিদা বাড়লেও দিনে দিনে কমছে গ্যাসের সরবরাহ। দুই বছর আগেও জাতীয় গ্রিডে দিনে গ্যাস সরবরাহ করা হতো প্রায় তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমানে দৈনিক গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে দুই হাজার ৬৯৮ মিলিয়ন ঘনফুট। গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহে ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় শিল্প-কারখানার উৎপাদন কমছে।
গ্যাসসংকটে শিল্প উৎপাদনে ধস
সজীব আহমেদ

উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, গ্যাসসংকটে শিল্প খাতে বিপর্যয় নেমেছে। কয়েক শ কারখানা বন্ধ হয়েছে। রপ্তানি আয়ও কমেছে। বিনিয়োগ থমকে আছে।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা প্রায় চার হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট। গতকাল রবিবার গ্যাস সরবরাহ করা হয় দুই হাজার ৬৯৮ মিলিয়ন ঘনফুট। ঘাটতি ছিল প্রায় দেড় হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। মোট দুই হাজার ৬৯৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের মধ্যে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে এক হাজার ৮৪২ মিলিয়ন ঘনফুট ও আমদানীকৃত তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) থেকে ৮৫৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, সাভার, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদীর শিল্প-কারখানাগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস না পাওয়ায় উৎপাদন প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। গ্যাসের চাপ কম থাকায় এসব এলাকার শিল্প-কারখানা কখনো চলছে, কখনো বন্ধ থাকছে। গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনের নিজস্ব ব্যবস্থা থাকলেও গ্যাসের সংকটে শিল্প-কারখানাগুলো সেগুলোও চালাতে পারছে না। অনেকে বাধ্য হয়ে বিকল্প জ্বালানি এলপিজি ব্যবহার করছেন। এতে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বড় ক্ষতির মুখে পড়ছেন শিল্পোদ্যোক্তারা। বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমইএ) সভাপতি মইনুল ইসলাম বলেন, ‘সিরামিক খাতসহ শিল্পে গ্যাসসংকট বাড়ছে। সিরামিক খাতের প্রধান জ্বালানি গ্যাস। দীর্ঘদিন ধরে চলা গ্যাসসংকটে সিরামিক খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এরই মধ্যে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে গ্যাসের স্বল্প চাপের কারণে গাজীপুর ও নরসিংদী অঞ্চলের কারখানাগুলোর ৫০ শতাংশ উৎপাদন কমে গেছে। তবে গ্যাসের চরম সংকট বিরাজ করছে সাভার ও ধামরাই অঞ্চলের কারখানাগুলোতেও। এসব এলাকার সিরামিক কারখানার উৎপাদন প্রায় ৭৫ শতাংশই কমে গেছে।’
দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন ডিভিশন) প্রকৌশলী কাজী মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা চাহিদামতো গ্যাস পাচ্ছি না। বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে এখন বিদ্যুৎকেন্দ্রে বাড়তি গ্যাস সরবরাহ দিতে হচ্ছে। এতে শিল্পে ও আবাসিকে কিছুটা প্রভাব পড়েছে। আশা করছি আগামী মাসের শুরুতে এলএনজির সরবরাহ কিছুটা বাড়বে, তখন গ্যাসের সংকট কিছুটা কাটবে।’
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানিয়েছেন, আমাদের গ্যাসের উৎপাদন কমে যাচ্ছে, আবার এলএনজি আনতে যে আর্থিক সামর্থ্য প্রয়োজন, তাও কম। তাই চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস দেওয়া যাচ্ছে না।
গাজীপুরে গ্যাসের চাপ তিন ভাগের এক ভাগে নেমেছে : গাজীপুর থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক শরীফ আহমেদ শামীম ও কালিয়াকৈর প্রতিনিধি মাহবুব হাসান মেহেদী গত কয়েক দিন অনুসন্ধান চালিয়ে দেখেছেন, গাজীপুর ও কালিয়াকৈরের শিল্প-কারখানাগুলোয় গ্যাসের সংকট তীব্রতর। গাজীপুর মহানগরীর জরুনে কেয়া গ্রুপের ছয় কারখানায় ঘণ্টায় গ্যাসের চাহিদা আড়াই লাখ ঘন ফুট। তবে গ্যাস মিলছে মাত্র দেড় লাখ ঘনফুটেরও কম। বিকল্প উপায়ে উৎপাদন চালু রাখতে বাড়তি অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। কেয়া গ্রুপের কমপ্লায়েন্স ম্যানেজার সাবিনা ইয়াসমিন জানান, তাদের অনুমোদিত চাপ ৫০ পিএসআই। পিক আওয়ারে (দুপুরে) গ্যাসের চাপ ৫-৭ পিএসআইয়ে নেমে যায়। চাপ কমে গেলে সব মেশিন চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। গ্যাস না পেয়ে বারবার কিছু মেশিন বন্ধ রাখতে হয়। না হলে ডিজেল বা পল্লীবিদ্যুৎ দিয়ে তা চালাতে হচ্ছে। তাতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ভর্তুকি দিয়ে কাঁচামাল সংগ্রহ ও বেতন-ভাতা দিতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানকে। গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার সাদমা ফ্যাশন ওয়্যার কারখানায় গ্যাসের অনুমোদিত চাপ ১৫ পিএসআই। সম্পূর্ণ রপ্তানিমুখী কারখানাটি চালু রাখতে দরকার কমপক্ষে ১০ পিএসআই গ্যাস। সপ্তাহ ধরে মিলছে এক থেকে দুই পিএসআই। প্রতিষ্ঠানটির দৈনিক উৎপাদন ৬০ থেকে কমে ১০ টনে নেমেছে। গাজীপুরের লক্ষ্মীপুরা, বোর্ডবাজার, ভোগড়া, টঙ্গী, বাংলাবাজার, কোনাবাড়ী, জরুন, কাশিমপুর চন্দ্রা, মৌচাক ও কালিয়াকৈরে গ্যসসংকট তীব্রতর। গ্যাসের অভাবে এসব এলাকার বহু কারখানায় উৎপাদন বন্ধের উপক্রম হয়েছে।
কিছুদিন আগেও গ্যাসের যে চাপ ছিল, তা দিয়ে কোনোভাবে কারখানা চালিয়ে নেওয়া যেত। সপ্তাহ ধরে অবস্থা শোচনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। কারখানার মালিকরা জানান, গ্যাসের চাপ তিন ভাগের এক ভাগে নেমেছে। রাতে ৬-৭ পিএসআই পাওয়া গেলেও দিনেরবেলা এই চাপ ২-৩ পিএসআইয়ে নেমে আসে।
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানির অপারেশন বিভাগের উপব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. রিদওয়ানুজ্জামান বলেন, গাজীপুরে গ্যাসের চাহিদা ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট। সরবরাহ হচ্ছে ৩৬০ মিলিয়ন ঘনফুট। সরবরাহ কম থাকায় কোনো কোনো এলাকায় গ্যাসের চাপ কম রয়েছে। কর্তৃপক্ষ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালাচ্ছে।
চট্টগ্রামে বন্ধ বহু কারখানা : চট্টগ্রাম থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক মুহাম্মদ আবু তৈয়ব জানান, চট্টগ্রামের আনোয়ারার সাদ মুসা শিল্প পার্কে বিনিয়োগ করবে ৩২টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ৯টি উৎপাদনে গেছে। ২৩টি এখনো উৎপাদন শুরুই করতে পারেনি। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির নতুন সিদ্ধান্তে তাদের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) উৎপাদন বিভাগের প্রধান উত্তর চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ১৮ দিন ধরে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। ফলে সার উৎপাদনও বন্ধ আছে। কাফকোতে গ্যাস সরবরাহ থাকায় সেটিতে সার উৎপাদন হচ্ছে। সিইউএফএলে প্রতিদিন গড়ে ৪৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দরকার হয়। এক দিন বন্ধ থাকলে কারখানাটিতে গড়ে তিন কোটি টাকার ইউরিয়া সার উৎপাদন বন্ধ থাকে।
চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানি লিমিটেড সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে চট্টগ্রামে প্রতিদিন বাণিজ্যিক, শিল্প-কারখানা, চা এস্টেট, ক্যাপটিভ পাওয়ার, সার উৎপাদন, বাসাবাড়ি, বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস সরবরাহ করছে ২৩০-২৩৩ মিলিয়ন ঘনফুট। তবে চট্টগ্রামে গ্যাসের প্রয়োজন হয় ২৬০-২৬৫ মিলিয়ন ঘনফুটের। এখন গড়ে ৩০-৩৩ মিলিয়ন ঘনফুটের ঘাটতি থাকছে।
সাভার-আশুলিয়ায় উৎপাদন ব্যাহত : সাভার (ঢাকা) প্রতিনিধি ওমর ফারুক জানান, সাভার-আশুলিয়ায় গ্যাসসংকটের দরুন তৈরি পোশাকসহ অন্য কারখানাগুলোয় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বিকল্প জ্বালানি হিসেবে মালিকরা বেশি দামে এলপিজি গ্যাস ও ডিজেল কিনে সংকট নিরসনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। দ্রুত সংকট নিরসন করা না গেলে শিল্প মুখ থুবড়ে পড়বে বলে আশঙ্কা কারখানার মালিকদের।
সাভার-আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে প্রায় দেড় হাজার শিল্প-কারখানা রয়েছে। কারখানাগুলোতে জেনারেটর বা বয়লার চালাতে ১৫ পিএসআই (প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে গ্যাসের চাপের ইউনিট) চাপের গ্যাস দরকার। তা এখন অর্ধেকের নিচে। ফলে সাভার-আশুলিয়ার শিল্প-কারখানা কখনো চলছে, কখনো বন্ধ থাকছে। তিতাসের ফ্লো কন্ট্রোল অ্যান্ড লোড ডেসপাচ বিভাগের উপ-মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. মাহমুদুর রহমান ভূইয়া বলেন, সাভার-আশুলিয়া মিলে আমরা প্রতিদিন ৮০-৯০ এনসিএফডি গ্যাস সরবরাহ করছি। কিন্তু আমাদের চাহিদা এর কয়েক গুণ। আমাদের যে লাইন আছে, তার ডিজাইন ৫০ পিএসআই। কিন্তু গ্যাসের চাপ না থাকায় আমরা পর্যাপ্ত গ্যাস দিতে পারছি না।
সাভারের পাকিজা গ্রুপের ম্যানেজার (অ্যাডমিন) মো. মোস্তাকিম বলেন, গ্যাসসংকটে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। বিকল্প হিসেবে ডিজেল এবং এলপিজি ব্যবহার করা হচ্ছে। সাভারের আল মুসলিম গ্রুপের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘চাপ কম। কারখানায় বা বার গ্যাসসংকট দেখা দিচ্ছে। প্রতিযোগিতার বাজারে আমাদের কারখানায় উৎপাদন চালিয়ে যেতে বেশ বেগ পেতে হয়।
কেরানীগঞ্জে দিনে এলপি গ্যাসে চালাতে হচ্ছে : কেরানীগঞ্জ প্রতিনিধি আলতাফ হোসেন মিন্টু জানান, গ্যাসসংকটে ঢাকার কেরানীগঞ্জে ৩০টি শিল্প-কারখানার মধ্যে বেশির ভাগেই উৎপাদন কম হচ্ছে। বেশ কিছু কারখানায় দিনে গ্যাস মিলছে না। দিনেরবেলা এলপি গ্যাস দিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছে। কেরানীগঞ্জে শিল্প-কারখানার মধ্যে শুভাঢ্যা ইউনিয়নের হাসনাবাদে গ্লোবাল হেভি ক্যামিক্যাল, আগানগরে বিলাসী ডাইং, মেসার্স সারা স্ক্রিন প্রিন্ট, আরশাদ ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসপসহ বিভিন্ন কারখানা।
আরশাদ ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসপের স্বত্বাধিকারী আরশাদ রহমান সপু বলেন, মাস যায়, গ্যাস বিল ঠিক দিয়ে যাচ্ছি। অথচ আমরা দিনেরবেলা গ্যাস পাই কম। রাতের বেলা গ্যাস পাই।
নরসিংদীতে বিপর্যয় : নরসিংদী প্রতিনিধি মনিরুজ্জামান জানান, নরসিংদীতে কিছু কিছু এলাকায় বন্ধ রাখতে হচ্ছে কারখানা। শিল্পমালিকরা জানিয়েছেন, ডায়িং ও কম্পোজিট গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল মিলগুলো দিনের বেশির ভাগ সময় বন্ধ রাখতে হচ্ছে। এতে শিল্প খাতে বিপর্যয় নামার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন শিল্পমালিক ও শ্রমিকরা। মাধবদীর এমএমকে ডাইং, প্রিন্টিং অ্যান্ড ফিনিশিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও এমএমকে সিএনজি অ্যান্ড ফিলিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল কাইউম মোল্লা বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই গ্যাসসংকট চলছে। তবে গত ১০-১২ দিন ধরে সংকট তীব্র। কারখানায় চাপ কম হলেও দিনের একটা সময় মাঝেমধ্যে গ্যাস পাচ্ছি। কিন্তু সিএনজি পাম্পে একেবারে বন্ধ। সেখানে গ্যাসের কোনো চাপই পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে আবার গ্যাসের পাশাপাশি সাত-আট ঘণ্টা লোডশেডিং। শ্রমিকদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন গুনতে হচ্ছে আর এর প্রভাব পড়ছে ব্যাংকঋণের সুদে।
এমআর টেক্স সাইজিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মোহাম্মদ রুমন বলেন, ১০ দিন ধরে গ্যাসের সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করেছে। উৎপাদন নেমে এসেছে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশে। গ্যাস না থাকায় প্রায় প্রতিদিন সকাল ৮ থেকে কারখানা বন্ধ। দুপুর ১টার দিকে ১০-১২ শতাংশ চাপ এলেও তাতে মেশিন চালানো যাচ্ছে না। আবার বিকেল ৩-৪টা থেকে রাত ১১-১২টা পর্যন্ত পুরোপুরি গ্যাস সরবরাহ বন্ধ। এতে কারখানা এক প্রকার বন্ধই বলা যাচ্ছে।
সম্পর্কিত খবর

স্থায়ী কমিটির বৈঠক
ঘোষণাপত্রের সাংবিধানিক নয় রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চায় বিএনপি
নিজস্ব প্রতিবেদক

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে নয় বিএনপি। এটিকে রাজনৈতিক দলিল হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির বিষয়ে মত দিয়েছে দলটি। গত বুধবার রাতে দলটির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয়। এরই আলোকে ঘোষণাপত্রের ওপর বিএনপির মতামতে এই দলিলকে আর্কাইভে (সংরক্ষণ) রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের তরফ থেকে বিএনপির কাছে পাঠানো জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়া নিয়ে দলীয় মতামত চূড়ান্ত করতে বুধবার রাতে স্থায়ী কমিটির এ বৈঠক হয়। ওই রাতেই খসড়ায় প্রয়োজনীয় সংযোজন-বিয়োজন এনে তাতে চূড়ান্ত মতামত দিয়েছে বিএনপি। বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
জানা গেছে, বৈঠকে বিএনপি নেতারা বলেছেন, ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান সংবিধানে স্থান দেওয়া হলে তাতে ভবিষ্যতে জটিলতা বাড়তে পারে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এই ঘোষণাপত্র সংবিধানে যুক্ত করার দাবি তোলে।
স্থায়ী কমিটি বৈঠকে অংশ নেওয়া একজন নেতা বলেন, খসড়া ঘোষণাপত্র ৫ আগস্ট থেকে কার্যকর বলা হলেও বিএনপি তাতে দ্বিমত জানিয়েছে।
দলটির নেতারা বলেছেন, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে গৌরবময় বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই স্বাধীনতাযুদ্ধকেই প্রধান অর্জন হিসেবে উল্লেখ করে ঘোষণাপত্র শুরু হওয়া উচিত।
খসড়া ঘোষণাপত্রে আছে, ‘যেহেতু পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন শাসনামলের রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিনির্মাণের ব্যর্থতা ও অপর্যাপ্ত ছিল এবং এ কারণে বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও শাসকগোষ্ঠীর জবাদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা যায়নি’—বিএনপি এ ক্ষেত্রে ‘বিভিন্ন শাসনামলের জায়গায়’ ‘আওয়ামী শাসনামলের’ কথা উল্লেখ করেছে।
এ ছাড়া দলটি ১৯৭২ সালের ‘সংবিধান পুনর্লিখন বা প্রয়োজনে বাতিল করার অভিপ্রায়’ বাদ দিয়ে ‘সংবিধানের বিদ্যমান সংস্কার উপযুক্ত প্রক্রিয়ায় সংশোধন’ করার পক্ষে মত দিয়েছে। জানা গেছে, ঘোষণাপত্রের খসড়া থেকে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রসঙ্গটি বাদ দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। গত জানুয়ারি মাসে প্রস্তুত করা ঘোষণাপত্রের খসড়ার শেষ অংশে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ কথাটি উল্লেখ ছিল। জানা গেছে, এর বাইরেও খসড়ায় আরো কিছু শব্দগত সংযোজন-বিয়োজন করেছে বিএনপি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রকাশ করতে চেয়েছিল। এ ঘোষণাপত্র নিয়ে তখন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা তৈরি হয়। হঠাৎ ঘোষণাপত্রের বিষয়টি কেন সামনে আনা হলো, এর প্রভাব কী হতে পারে, তা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন ওঠে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস উইং তখন এ উদ্যোগের সঙ্গে সরকার সম্পৃক্ত নয় বলে উল্লেখ করেছিল। অবশ্য পরে ৩০ ডিসেম্বর রাতে জরুরি প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জানিয়েছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ওই রাতে বৈঠক করে ৩১ ডিসেম্বর শহীদ মিনারে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ (ঐক্যের জন্য যাত্রা) কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। ওই কর্মসূচি থেকে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়।
এর মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়। বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো তখন ওই খসড়ার ওপর তাদের মতামত দেয়। পরবর্তী সময়ে ছাত্রদের দেওয়া সময়সীমা শেষ হওয়ার পরদিন গত ১৬ জানুয়ারি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অংশীজনের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এই ইস্যুতে সরকারের কার্যক্রম ধীরগতিতে চলতে থাকে। এনসিপি সম্প্রতি সরকারকে আগামী ৩ আগস্টের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র ঘোষণার দাবি জানিয়েছে। অন্যথায় তাদের পক্ষ থেকে ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র’ দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দেয়।
সরকার ও রাজনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, চলতি মাসের শেষ সপ্তাহের মধ্যেই জুলাই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার। আর এটি চূড়ান্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে।
এদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গতকাল জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক শেষে বলেন, ‘জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে সরকার যে প্রস্তাব দিয়েছিল, আমরা তার ওপর মতামত গতকাল (বুধবার) দিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধকালে প্রবাসী সরকার একটা ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে সব কার্যক্রম চালিয়েছে। কিন্তু ’৭২-এর সংবিধানে তা অন্তর্ভুক্ত হয়নি। ’২৪-এর মহত্ত্ব ও গুরুত্বের প্রতি বিএনপি যথাযথ মর্যাদা দেয়। সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা ও বর্তমান সরকারকে বৈধতা দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু ঘোষণাপত্র সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ নেই।

উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক
ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস স্থাপনের খসড়া অনুমোদন
বিশেষ প্রতিনিধি

ঢাকায় তিন বছরের জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের একটি মিশন স্থাপনের বিষয়ে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের ৩৩তম বৈঠকে এ অনুমোদন দেওয়া হয়। জানা গেছে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবের ভিত্তিতে বাংলাদেশে ‘জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়’-এর মিশন স্থাপনসংক্রান্ত সমঝোতা স্মারকের খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
এর আগে গত ২৯ জুন ওই খসড়া উপদেষ্টা পরিষদে তোলা হলে তাতে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল।
বৈঠকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে মুসাপুর রেগুলেটর ও বামনি ক্লোজারের নকশা চূড়ান্তকরণ, ফেনীতে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প চূড়ান্তকরণ এবং নোয়াখালীর খাল ও ড্রেনেজ অবমুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ও মহেশখালী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নতুন অধ্যাদেশ অনুমোদনের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি প্রস্তাব পাস হয়।
বৈঠকে ‘জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়া নীতিগত ও চূড়ান্তভাবে অনুমোদন করা হয়, যা লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের ভেটিংয়ের পর কার্যকর হবে।
আন্তর্জাতিক পরিসরে গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপ হিসেবে বাংলাদেশ জাতিসংঘের ‘অপশনাল প্রোটোকল টু দ্য কনভেনশন অ্যাগেইনস্ট টর্চারে (ওপি-ক্যাট)’ পক্ষভুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
মালয়েশিয়ার জোহর বাহরুতে বাংলাদেশের একটি নতুন কনস্যুলেট জেনারেল স্থাপনের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়।
বৈঠকে মহেশখালীকে পরিকল্পিতভাবে উন্নয়নের আওতায় আনতে ‘মহেশখালী সমন্বিত উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়। অতিবৃষ্টির কারণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা ও বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।

মির্জা ফখরুল
দেশের মানুষ নির্বাচন চায়, তাহলে কেন হবে না?
নিজস্ব প্রতিবেদক

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘দেশে কেন নির্বাচন হবে না? দেশের মানুষ নির্বাচন চায়। নির্বাচিত প্রতিনিধি চায়। এ জন্য তারা জীবন দিয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতার পরিবর্তন হবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে আয়োজিত আলোচনাসভায় তিনি এসব কথা বলেন। ‘ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে সাংবাদিকদের ভূমিকা’ শীর্ষক আলোচনাসভাটি যৌথভাবে আয়োজন করেছে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)।
অনুষ্ঠানে গত ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধীসহ জুলাই আন্দোলনে শহীদ ৬৪ জন সাংবাদিকের ওপর শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন ডিইউজের সহসভাপতি রাশেদুল হক। বিএফইউজের প্রয়াত সভাপতি রুহুল আমিন গাজীর পরিবার এবং জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ ছয় সাংবাদিকের পরিবারের হাতে সম্মাননা তুলে দেন বিএনপি মহাসচিব।
তাঁর এই বক্তব্যের জবাবে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমি খুব আশাবাদী মানুষ। অনেকে বলেছেন যে, হবে না। কেন হবে না? নির্বাচন তো এ দেশের মানুষ চায়, নির্বাচনের জন্য তো এ দেশের মানুষ প্রাণ দিয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের সব কাজ গুছিয়ে ফেলতে তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) নির্দেশ দিয়েছেন। এটা অত্যন্ত ইতিবাচক ব্যাপার। আমরা আশা করব, নির্বাচন কমিশন এই কাজ খুব দ্রুততার সঙ্গে শেষ করে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করবেন। আমরা দাবি করছি, যেন এই নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়।’
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘আপনাদের কি মনে হয় দেশে নির্বাচন হবে? অনেক মানুষ জিজ্ঞেস করে, নির্বাচন কি হবে? গতকাল প্রেস সেক্রেটারি যে বক্তব্য রাখলেন, তাতে কি মনে হয় নির্বাচন হবে? বেশির ভাগ মানুষ মনে করে নির্বাচন হবে না। তাহলে কী হবে? আমাদের ভাবনার দরকার আছে।’
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘আওয়ামী লীগ তো নেই, দুঃশাসন কি বিদায় নিয়েছে? না। আমাদের আত্মতৃপ্তির কিছু নেই। আমাদের সামনে এখনো ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকাঠামো বিরাজমান। রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বত্র ফ্যাসিবাদের প্রেতাত্মারা, দিল্লির আধিপত্যের কালো থাবা চতুর্দিকে ছেয়ে বসছে। ব্যবসা-বাণিজ্য-রাজনীতি-আন্তর্জাতিক নীতি-কূটনীতি ইভেন সামনের নির্বাচনে জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে কিভাবে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া যায় তার চক্রান্ত এখনো বিদ্যমান।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, ‘স্বৈরাচার পালিয়েছে। কিন্তু স্বৈরাচারী মানসিকতা বিরাজমান। আজকেও যদি দেখেন, এটা যদি না হতে পারে, ওটা হতে পারবে না। এ রকম বক্তব্য দিচ্ছেন আমাদের তরুণ নেতৃত্বের কতিপয় নেতা। আপনি আপনার চাহিদা বলতেই পারেন, এটা আপনার স্বাধীনতা। কিন্তু আপনি এটা বলতে পারেন না যে, এটা না হলে, ওইটাও হবে না। এই অধিকার আপনার নেই। এই মানসিকতা আর স্বৈরাচারের মানসিকতা একই।’
তিনি বলেন, ‘৬৪ জন সাংবাদিক শহীদ হয়েছেন। মাহমুদুর রহমান, শফিক রেহমানের মতো বয়োজ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা নিগৃহীত হয়েছেন। সংগ্রামের সম্পাদক আসাদ ভাই নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। শুধু লেখনীর কারণে। এখনো তো আপনাদের কণ্ঠে একই ধরনের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এটি কি ঠিক?’
বিএফইউজের মহাসচিব কাদের গণি চৌধুরী বলেন, ‘গত ১৭ বছরে সাংবাদিকদের ভূমিকা বর্তমান সরকার স্বীকার করতে চায় না। এই সরকারের যারা সুবিধাভোগী, তারা এক-দেড় মাস লড়াই করেছেন। আমরা সাংবাদিকরা ১৭টি বছর ঢাকার রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি, অনেকে খুন হয়েছেন। তারপর স্বৈরাচারী সরকারের চূড়ান্ত পতনের জুলাই বিপ্লব এসেছে। সেখানে শুধু পেশাজীবী নয়, সাংবাদিকদেরও অবদান রয়েছে। আজকে মাঝে মাঝে কিছু শিশুকে দেখি সাংবাদিকদের হুমকি দিতে। তোমরা দেড় মাসের নেতা। আমরা ১৭ বছর লড়াই করে ফ্যাসিবাদের তক্ততাউস কাঁপিয়ে তুলেছিলাম। দেড় মাস নেতৃত্ব দিয়ে, ১৭ বছরের সংগ্রামকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তোমরা সাংবাদিকদের হুমকি দাও, এটা মেনে নেব না।’
অনুষ্ঠানে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও কালের কণ্ঠ সম্পাদক কবি হাসান হাফিজ বলেন, ‘একটা ফ্যাসিবাদের ভাষা আমরা দেখতে পাচ্ছি। এটার নিন্দা করছি। মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ, হুমকি দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করছি, সেটা খুবই অমঙ্গলসূচক। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত। কোনোভাবে মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে, হুমকি দিয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করা যায় না।’
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শহীদুল ইসলামের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক খুরশীদ আলমের সঞ্চালনায় সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আবদুস সালাম, জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, বিএফইউজের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ওবায়দুর রহমান শাহীন, দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক আবদুল হাই শিকদার, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সৈয়দ আবদাল আহমেদ, ইলিয়াস খান, এ কে এম মহসিন, ইরফানুল হক জাহিদ, সাঈদ খান, দিদারুল আলম, খন্দকার আলমগীর হোসেন ও প্রবাসী সাংবাদিক ইমরান আনসারী প্রমুখ।

‘ক্ষমা’ পেতে পারেন সাবেক আইজিপি
মেহেদী হাসান পিয়াস

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক পুলিশ প্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের বিচার শুরু হয়েছে। এ মামলায় অ্যাপ্রুভার (রাজসাক্ষী) হতে আবেদন করেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন।
গতকাল বৃহস্পতিবার চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ আবেদনটি মঞ্জুর করে তাঁকে সাক্ষী হিসেবে গণ্য করে সাক্ষ্য উপস্থাপনের অনুমতি দেন। এর পরই প্রশ্ন উঠেছে, মামুন কি রাজসাক্ষী হয়েছেন? হয়ে থাকলে তিনি ট্রাইব্যুনালের কাছ থেকে কী প্রতিকার পাবেন বা পেতে পারেন?
মামুনের দোষ স্বীকার
রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ‘প্রধানমন্ত্রী’ পদে থেকে অপরাধ করায় শেখ হাসিনাকে এই মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে।
রাজসাক্ষী নিয়ে যা বলা আছে ট্রাইব্যুনাল আইনে?
এই মামলায় তিন আসামির বিরুদ্ধে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপন্সিবিলিটি বা ঊর্ধ্বতনের নির্দেশনার দায়সহ হত্যা, হত্যা চেষ্টা, ব্যাপক মাত্রায় পদ্ধতিগত হত্যা, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, ষড়যন্ত্রসহ অন্যান্য অমানবিক আচরণ, সংঘটিত অপরাধ প্রতিরোধ না করার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। এসব অপরাধের বিচার হচ্ছে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে। আইনটির ১৫ ধারায় ‘একজন রাজসাক্ষীর ক্ষমা’ বিষয়ে বলা আছে। ধারার ১ উপধারায় বলা হয়েছে, ‘বিচারের যেকোনো পর্যায়ে, ধারা ৩-এ উল্লিখিত যেকোনো অপরাধের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত বা গোপনে জড়িত বলে মনে করা হয় এমন যেকোনো ব্যক্তির সাক্ষ্য গ্রহণের উদ্দেশ্যে ট্রাইব্যুনাল, অপরাধের সাথে সম্পর্কিত তার জ্ঞানের মধ্যে থাকা সম্পূর্ণ পরিস্থিতি এবং সংশ্লিষ্ট অন্য সকল ব্যক্তির কাছে, প্রধান বা সহায়তাকারী হিসেবে সম্পূর্ণ এবং সত্য প্রকাশ করার শর্তে, এই ক্ষমা প্রদান করতে পারে।’
২ উপধারায় বলা আছে, ‘এই ধারার অধীনে অভিযোগ গ্রহণকারী প্রত্যেক ব্যক্তিকে বিচারে সাক্ষী হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ আর ৩ উপধারায় ‘বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই ব্যক্তিকে হেফাজতে আটক রাখা হবে’ বলা আছে।
রাজসাক্ষী হলে আইনের শর্ত পূরণ করতে হবে : রাজসাক্ষী হতে চাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে মামুনের আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই মামলায় আদালত তাঁকে সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। সাক্ষ্য-জেরার পর আদালত যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে তিনি সব সত্যি বলেছেন, কোনো কিছু গোপন করেননি বা তাঁর সাক্ষ্যের পর প্রকৃত সত্য উদঘাটন হয়েছে, তখন আদালত তাঁকে রাজসাক্ষী হিসেবে স্বীকৃতি দেবেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ১৫ ধারায় যেসব শর্তের কথা বলা আছে, সেই সব শর্ত তাঁকে পূরণ করতে হবে। শর্ত পূরণ করতে পারলে ট্রাইব্যুনাল তাঁকে রাজসাক্ষী হিসেবে ঘোষণা করবেন। রাজসাক্ষী হতে পারলে ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার আছে তাঁর অপরাধ ক্ষমা করার।’
প্রসিকিউটর গাজী মনোয়ার হোসেন তামিম বলেন, ‘আসামি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন দোষ স্বীকার করেছেন ট্রাইব্যুনালের কাছে। তিনি বলেছেন, এই মামলার সম্পূর্ণ সত্যি এবং সব পরিস্থিতি তুলে ধরতে চান। এই মর্মে একটি আবেদনও দিয়েছেন। ট্রাইব্যুনাল তাঁর আবেদনটি মঞ্জুর করেছেন এবং মামলার সাক্ষী হিসেবে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপনের অনুমতি দিয়েছেন।’
ট্রাইব্যুনালে রাজসাক্ষী হওয়ার এটিই প্রথম নজির : প্রসিকিউটর গাজী মনোয়ার হোসেন তামিম বলেন, ফৌজদারি অপরাধের মামলায় রাজসাক্ষী হওয়ার অসংখ্য উদাহরণ থাকলেও আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের ইতিহাসে আর কোনো আসামি রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন করেননি। মামুনকে কারাগারে আলাদা সেলে রাখা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যেহেতু তিনি অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করে রাজসাক্ষী হতে চেয়েছেন এবং যেসব আসামির বিরুদ্ধে তিনি বলতে পারেন বা তাঁর বক্তব্যে যেসব আসামির সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে, সেসব আসামি তাঁকে বায়াস (পক্ষে আনার) করার চেষ্টা করতে পারেন, তাঁর নিরাপত্তার ঘাটতি হতে পারে, এই জন্য কারাগারে তিনি যেন আইসোলেটেড (বিচ্ছিন্ন) থাকেন অর্থাৎ আলাদা সেলে রাখা হয়, সেই আবেদন করেছেন। আবেদনটি মঞ্জুর করা হয়েছে।’ কারাগারে আলাদা সেলে থাকলেও সাবেক আইজিপি হিসেবে মামুন যে ডিভিশন সুবিধা পেয়ে আসছিলেন, তার বাইরে বাড়তি কোনো সুবিধা তিনি পাবেন না বলেও জানান প্রসিকিউটর তামিম।