ঢাকা, বুধবার ২৩ জুলাই ২০২৫
৮ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৭ মহররম ১৪৪৭

ঢাকা, বুধবার ২৩ জুলাই ২০২৫
৮ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৭ মহররম ১৪৪৭
সুন্দরবন ও কক্সবাজার

জলদস্যুর উৎপাতে আবারও অশান্ত

ওমর ফারুক
ওমর ফারুক
শেয়ার
জলদস্যুর উৎপাতে আবারও অশান্ত

সুন্দরবন ও কক্সবাজার এলাকার দেড় শতাধিক জলদস্যু অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণের পর নতুন করে আবার দস্যুতায় জড়িয়ে পড়ছে। এদের অনেকে ফের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদাবাজি শুরু করেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এবার এই জলদস্যুরা সরাসরি নিজের নামে বাহিনী না গড়ে নতুন কাউকে সামনে রেখে তাদের নামে বাহিনী পরিচালনা করছে। আর এদের দিয়েই শুরু করা হয়েছে অপহরণ ও চাঁদাবাজি।

এরই মধ্যে সুন্দরবনে নতুন করে অন্তত ১০টি জলদস্যু বাহিনী গড়ে উঠেছে। তবে কোস্ট গার্ড সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, সুন্দরবনে নতুন করে তারা শুধু আলিফ ও কলিম শরীফ বাহিনীর তথ্য পেয়েছে।

জলদস্যুর উৎপাতে আবারও অশান্তগত বছর ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর আত্মসমর্পণ করা সুন্দরবন অঞ্চলের জলদস্যুদের প্রায় সবাই আবারও দস্যুতার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে বলে তথ্য মিলছে। এর মধ্যে চলতি বছরের গত দুই মাসে সুন্দরবনে অন্তত ১৫০ জন জেলেকে অপহরণ করে ১০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত মুক্তিপণ আদায় করেছে তারা।

সর্বশেষ গত বুধবার ছয়জন নারীসহ ৩৩ জন জেলেকে অপহরণ করা হয়েছে। পরে কোস্ট গার্ড তৎপর হয়ে তাদের উদ্ধার করে। আত্মসমর্পণ করা জলদস্যুদের সঙ্গে নতুন জলদস্যু যুক্ত হওয়ায় তাদের শক্তি আরো বেড়েছে। ফলে এক ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সুন্দরবন, কক্সবাজারসহ বঙ্গোপসাগরের উপকূলে।
এই জলদস্যুদের কাছে পুলিশও অনেকটা অসহায়। কারণ বাধা পেলে গুলির ঘটনা ঘটাচ্ছে জলদস্যুরা।

কোস্ট গার্ডের মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সিয়াম উল হক গতকাল সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে বলেন, ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর সুন্দরবন দস্যুমুক্ত ঘোষণা হওয়ায় এ অঞ্চলের জেলেরা ভালোই ছিল। কিন্তু সম্প্রতি আবারও বন ও জলদস্যুদের তৎপরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের অধীন এলাকাগুলো মৎস্যজীবীদের নিরাপত্তা বিধান, জলদস্যু ও বনদস্যু দমন এবং নিরাপদ সুন্দরবন নিশ্চিত করতে ২৪ ঘণ্টা টহল অব্যাহত রাখা হয়েছে।

সবার সহযোগিতা নিয়ে আমরা আবারও জলদস্যু মুক্ত করব।

সূত্র জানায়, গত বছর ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর জলদস্যুরা আবারও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে শুরু করে। সুন্দরবনে বর্তমানে অন্তত ১০টি বাহিনী গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে রয়েছে কলিম শরীফ বাহিনী, আবদুল্লাহ বাহিনী, মজনু বাহিনী, দয়াল বাহিনী, রবিউল বাহিনী, মঞ্জুর বাহিনী, মাসুম বিল্লাহ ও ভাগ্নে বাহিনীসহ ১০টি বাহিনী। এসব বাহিনীর নেপথ্যে কাজ করছে আত্মসমর্পণ করা জলদস্যুদের অনেকে।

 

বর্তমানে যা ঘটছে

গত বুধবার সকালে মাছ ও কাঁকড়া আহরণে খুলনার কয়রা থেকে সুন্দরবনের উদ্দেশে রওনা করেন ছয় নারীসহ ৩৩ জন জেলে। পথে তাঁদের অপহরণ করে জলদস্যু কলিম শরীফ বাহিনী। তাঁদের জিম্মি করে প্রতি জনের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। পরে এ খবর জানতে পেরে ওই দিনই বাগেরহাটের কোস্ট গার্ড সকাল ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালায়। পরে করকরি নদীর মাল্লাখালী এলাকা থেকে তাঁদের উদ্ধার করা হয়। অভিযানের সময় কোস্ট গার্ডের উপস্থিতি টের পেয়ে ডাকাতদল ফাঁকা গুলি ছুড়ে বনের মধ্যে পালিয়ে যায়।

এদিকে গত ২৬ জানুয়ারি দুবলার চরসংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে জেলেদের অপহরণের চেষ্টাকালে তিন জলদস্যুকে মারধর করে আটক করেন জেলেরা। পরে আটক ব্যক্তিদের কোস্ট গার্ডের হাতে তুলে দেওয়া হয়। কোস্ট গার্ড তাদের শরণখোলা থানায় হস্তান্তর করে।

শরণখোলা থানার ওসি মো. শহিদুল্লাহ গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, মজনু বাহিনী বাগেরহাটের দুবলার চর থেকে জেলেদের অপহরণ করতে চাইলে জেলেরা একত্রিত হয়ে তিন জলদস্যুকে ধরে ফেলে।

সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার খাজুরা ইউনিয়নের পিরোজপুর গ্রামের জেলে মো. ইয়াসিনকে গত ৪ মার্চ রাতে বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবনে শরীফ বাহিনী অপহরণ করে। তিনি সুন্দরবনের শ্যালার চর শুঁটকি পল্লীর মৎস্য ব্যবসায়ী খুলনার মিঠু কমিশনারের ট্রলারের মাঝি। দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের সদস্য মৎস্য ব্যবসায়ী মিঠু কমিশনার জানান, রাত সাড়ে ১১টার দিকে সশস্ত্র জলদস্যুরা একটি ট্রলারে এসে জেলেদের ট্রলারে হানা দেয়। জলদস্যুরা প্রথমে মারপিট শুরু করে। পরে ট্রলারের মাঝি মো. ইয়াসিনকে তুলে নিয়ে যায়।

গত ২ এপ্রিল বরগুনা পাথরঘাটা এলাকা থেকে চারটি ফিশিং ট্রলারে ৬৭ জন জেলে মাছ শিকারের জন্য গভীর সমুদ্রে যায়। ৯ এপ্রিল রাত ১১টার দিকে বরগুনার তালতলী উপজেলাধীন সকিনার মোহনাসংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে জলদস্যুরা ট্রলারগুলোতে আক্রমণ করে। এতে দুজন জেলে গুলিবিদ্ধ হন এবং চলে যাওয়ার সময় জলদস্যুরা ট্রলারগুলোর ইঞ্জিন বিকল করে দিয়ে যায়। পরে গত বৃহস্পতিবার ট্রলার মালিক সেলিম চৌধুরী বিষয়টি কোস্ট গার্ডকে অবহিত করে।

গত ৭ ফেব্রুয়ারি রাতে কক্সবাজারের মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপের অদূরে সাগরে মাছ ধরার সময় জলদস্যুর কবলে পড়ে একটি মাছ ধরার ট্রলার। এ সময় ওই ট্রলারের জেলে বেলালের হাতে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে দস্যুদল। এরপর অন্য জেলেদের হত্যার হুমকি দিয়ে ট্রলারটিতে থাকা মাছ, ব্যবহৃত মোবাইল ও নগদ টাকা লুট করে নিয়ে ইঞ্জিন ভেঙে দিয়ে পালিয়ে যায় দস্যুদল। পরে দস্যুদলের কবলে পড়া জেলেরা ৯৯৯-এ কল দিলে কক্সবাজারের উপকূলবর্তী সোনাদিয়া দ্বীপ সন্নিহিত সাগরে অভিযান চালিয়ে লুট করা মাছসহ ১৮ জলদস্যুকে আটক করে কোস্ট গার্ড।

গত ৬ এপ্রিল হাতিয়া উপজেলার হরণী ইউনিয়নের বয়রার চর টাংকির ঘাট এলাকার জলদস্যু আব্দুর রব ও তাঁর সহযোগী আহছান উল্লাহকে (৫২) আটক করেছে হাতিয়া থানা পুলিশ। 

গত ২৮ মার্চ নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার চরগাশিয়ার কুখ্যাত জলদস্যু ফখরুল ইসলামের (ফকরা ডাকাত) প্রধান সহযোগী নাসির উদ্দিনকে (৩৪) আটক করেছে হাতিয়া কোস্ট গার্ড। পরে তাঁদের হাতিয়া থানায় হস্তান্তর করা হয়।

 

আত্মসমর্পণ করা জলদস্যুদের অনেকে ভিন্ন পেশায়

তবে আত্মসমর্পণ করা জলদস্যুদের কেউ কেউ সৎপথেও আছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তারা। তাঁদের কেউ কেউ মাছ শিকার, লবণ চাষ ও নাইট গার্ডের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। কেউ আবার জনপ্রতিনিধিও হয়েছেন। আত্মসমর্পণকারী জলদুস্যদের গতিবিধির ওপর নজর রাখছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী।

সূত্র জানায়, একসময় আত্মসমর্পণকারীরা সুন্দরবনের শিবসা নদীসংলগ্ন বিভিন্ন খাল ও সাতক্ষীরা রেঞ্জের কাটেশ্বর ও সাপখালীসংলগ্ন অঞ্চলের বনজীবী ও জলজীবী সাধারণ মানুষকে নিশানা করে চাঁদাবাজি ও ডাকাতি করত। এ ছাড়া অপহরণ করাও ছিল তাদের কাজ। এ অবস্থায় ২০১৬ সালে জলদুস্যরা র‌্যাবের মাধ্যমে আত্মসমর্পণের উদ্যোগ নেয়। এরপর ২০১৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর সুন্দরবনের কুখ্যাত জলদস্যু শান্ত বাহিনী ও আলম বাহিনীর প্রধানসহ ১৪ সদস্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। বরিশাল র‌্যাব-৮-এর কার্যালয়ে ১৪ বনদস্যু ২০টি দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র ও এক হাজার আট রাউন্ড গোলাবারুদও জমা দেয় সেদিন।

এরপর ২০১৭ সালের ৩০ জানুয়ারি সুন্দরবনের কুখ্যাত জলদস্যু জাহাঙ্গীর বাহিনীর ২০ সদস্য আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। এরপর চট্টগ্রামের বাঁশখালী, কক্সবাজারের মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া উপকূলীয় এলাকায় ২০১৮, ২০২০ ও ২০২৪ সালে আত্মসমর্পণ করে ১২৭ জন জলদস্যু। তাঁরা একসময় বঙ্গোপসাগরের পেশাদার জলদস্যু হিসেবে পরিচিত ছিল। তাঁদের মধ্যে রহিমা বেগম নামের এক নারীও ছিলেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কক্সবাজার এলাকার আত্মসমর্পণ করা ১২৭ জনের বেশির ভাগ কক্সবাজার অঞ্চলে মাছ শিকার, লবণ চাষ, নাইট গার্ডসহ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তবে সুন্দরবন ও কক্সবাজার এলাকার আত্মসমর্পণকারী জলদুস্যুদের কেউ কেউ গোপনে নতুন করে জলদস্যুদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন বলে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন। তাদের দলকে গ্রেপ্তারে গোয়েন্দারা তৎপরতা চালাচ্ছেন।

চলতি বছর গত ২৩ মার্চ সকাল ১১টার দিকে চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলা পরিষদ হলরুমে র‌্যাবের মহাপরিচালকের পক্ষ থেকে আত্মসমর্পণ করা জলদুস্যদের ঈদ উপহার দেওয়া হয়। ওই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে জলদুস্য রানী খ্যাত রহিমা বেগম বলেন, অনেক মামলার আসামি হয়েছি, মামলাগুলো এখনো চলমান রয়েছে। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পেরে ভালো লাগছে।

আত্মসমর্পণ করা জলদস্যু আবদুল হাকিম বাইশ্যা কালের কণ্ঠকে বলেন, ২০২০ সালে আত্মসমর্পণের পর আমাদের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ১১ মাস পর কারাগার থেকে মুক্ত হয়েছি।

তিনি জানান, কারাগার থেকে বের হওয়ার পর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হয়। এলাকার লোকজন তাঁকে মেম্বার পদে নির্বাচনের জন্য বলে। তিনি বাশখালী সনুয়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে মেম্বার পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জীবিকা হিসেবে তিনি ও তাঁর মতো অনেকে এখন মাছ ধরার কাজ করেন। তিনি বলেন, ভালো মানুষ হয়ে যাওয়ার পর এখন অনেক সুখে দিন চলছে আমাদের। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শুনেছি কক্সবাজার এলাকায় আত্মসমর্পণকারীদের মাঝে কেউ কেউ নতুন করে জলদস্যুতায় জড়াচ্ছে।

বাগের হাটের এসপি তৌহিদুল আরিফ বলেন, জলদস্যুরা আবারও সংগঠিত হচ্ছেএমন খবর পাওয়া যাচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি রোধ করার জন্য।

সাতক্ষীরার এসপি মনিরুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবন বিশাল এরিয়া। শুধু পুলিশ নয়, র‌্যাব ও কোস্ট গার্ড দায়িত্ব পালন করে। আমরা চেষ্টা করছি কোনো জলদুস্য যাতে কোনো কর্মকাণ্ড চালাতে না পারে।

 

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

হতাহতের তথ্য নিয়ে অসংগতি

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
শেয়ার
হতাহতের তথ্য নিয়ে অসংগতি

রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় হতাহতের তথ্যে অসংগতি রয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, ১০ হাসপাতালে এ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৩১। ১৬৫ জন বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছে।

বিকেল ৩টায় এক সংবাদ সম্মেলনে অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম জানান, এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ২৮ এবং আহত ৬৯ জন।

এমন পরিস্থিতিতে গতকালও হাসপাতালে আহতদের খুঁজতে দেখা গেছে স্বজনদের। তাঁরা নিহতদের সঠিক নাম, তথ্য প্রকাশ এবং আহতদের সম্পূর্ণ ও নির্ভুল তালিকা দ্রুত প্রকাশ করার দাবি জানান।

তথ্য প্রকাশে পিছিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় : জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে বিকেল ৩টায় সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান বলেন, আমরা আইএসপিআরের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের হিসাবে একটি হাসপাতাল যুক্ত হয়েছে।

সেটি হলো লুবানা জেনারেল হাসপাতাল। আমরা সেখানে যোগাযোগ করেছি। তাদের নিবন্ধন খাতায় কোথাও কোনো মৃত্যু নেই। কিন্তু তারা মুখে বলছে, সেখানে দুই শিশু হাসপাতালে মৃত অবস্থায় আসে, যাদেরকে তাদের অভিভাবকরা নিয়ে গেছেন।
এই দুজন পরে কোনো হাসপাতালে না আসায় মৃত্যুর তালিকায় তাদের নাম নেই।

এ ছাড়া উত্তরা আধুনিক হাসপাতালের হিসাবে একটি পার্থক্য হয়েছে। আমরা বলেছিলাম, সেখান থেকে একজনের মরদেহ সিএমএইচে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মূলত এই সংখ্যায় আমাদের সঙ্গে আইএসপিআরের পার্থক্য হয়েছে।

অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান জানান, আহতদের সংখ্যা বলা হচ্ছে ১৬৫।

এখানে উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে ৬০ জনের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে এবং লুবানা জেনারেল হাসপাতালে ১৩ জনের চিকিৎসার কথা বলা হয়েছে। অথচ সেখানে দু-তিনজন রোগীও নেই। জরুরি চিকিৎসা দেওয়া এবং রোগীদের এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে স্থানান্তরের কারণে সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ভর্তি রোগীদের মধ্যে ৩০ জন বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। ১০ জনের অবস্থা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। অন্যদের মধ্যে ১০ জন শঙ্কামুক্ত এবং দুজনকে সাধারণ ওয়ার্ড থেকে কেবিনে স্থানান্তর করার প্রস্তুতি চলছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য : মাইলস্টোনে বিমান দুর্ঘটনায় হতাহতদের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানিয়ে গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় যে তথ্য দিয়েছে তাতে দেখা গেছে, এখন পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি রোগী ৬৮ জন, মৃত ২৮ জন। বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি ৪২ জন, এ পর্যন্ত মৃত্যু ১০ জনের। সিএমএইচে ভর্তি ২৩ জন, মৃত্যু ১৫ জনের। কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে ভর্তি একজন, মৃত্যু নেই। শহীদ মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি একজন, মৃত্যু নেই। ঢাকা মেডিক্যালে কোনো রোগী ভর্তি নেই, মৃত্যু একজনের। লুবানা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি কোনো রোগী নেই, মৃত্যু একজনের। উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে বর্তমানে চিকিৎসাধীন একজন, মৃত্যু নেই। এ ছাড়া ইউনাইটেড হাসপাতালে কোনো রোগী নেই, মৃত্যু একজনের।

এর আগে দুপুর সাড়ে ১২টায় হালনাগাদ করা তালিকা প্রকাশ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এই তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ভর্তি রোগীদের মধ্যে ৩৯ জনই শিক্ষার্থী। ছয়জন শিক্ষক, ১৫ জন সেনা সদস্য এবং একজন করে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসকর্মী, স্কুল স্টাফ, গৃহকর্মী ও ইলেকট্রিশিয়ান রয়েছে। এ ছাড়া পরিচয় শনাক্ত না হওয়া চারজন রয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টার এই বিশেষ সহকারী বলেন, এখন পর্যন্ত অজ্ঞাতপরিচয় ছয়টি লাশ আছে। এর মধ্যে চারজনের স্বজন এসেছেন। ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে লাশ হস্তান্তর করা হবে। বাকি দুজনের স্বজনদের খোঁজ এখনো মেলেনি।

সায়েদুর রহমান বলেন, আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর থেকে একটি মেডিক্যাল টিম মঙ্গলবার রাতের মধ্যে ঢাকায় এসে পৌঁছবে। এই টিমে একজন সিনিয়র কনসালট্যান্ট ও দুজন নার্স থাকবেন। বুধবার থেকে তাঁরা আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসাসেবায় যুক্ত হবেন।

চিকিৎসা নিয়ে উত্তরার হাসপাতাল ছেড়েছে আহতরা : গতকাল ঘটনার দ্বিতীয় দিন উত্তরার হাসপাতালগুলো ঘুরে দেখা যায়, বেশির ভাগ রোগী চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, এসব রোগীর মধ্যে অনেকে ঘটনাস্থলের ভয়াবহতা দেখে মানসিক আঘাত বা প্যানিক অ্যাটাকে অসুস্থ হয়ে পড়ে। উদ্ধারকাজে অংশ নিয়ে কেউ কেউ আহত হয়েছে। সামান্য দগ্ধ কয়েকজনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে গুরুতর দগ্ধ রোগীদের দ্রুত ঢাকা মেডিক্যাল ও জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়েছে।

উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি আহত শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। হাসপাতালের ডেপুটি ডিরেক্টর ডা. বজলুর রহমান আদিল বলেন, এখানে এক শর বেশি শিক্ষার্থী আসে। এর মধ্যে প্রথমে আসা প্রায় ৪০ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক থাকায় শুধু স্যালাইন আর বার্ন ক্রিম দিয়ে দ্রুত ঢাকা মেডিক্যালে পাঠানো হয়। পরে যারা এসেছে, তারা মূলত আতঙ্কগ্রস্ত ছিল। রাতের মধ্যে তারা চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়। ২৩ জনকে ভর্তি করা হয়েছিল, তারাও পরদিন হাসপাতাল ছাড়ে। হাত পুড়ে যাওয়ায় এক শিক্ষার্থী এখনো চিকিৎসা নিচ্ছে।

ঘটনার পর দুটি মৃতদেহ হাসপাতালটিতে আনা হয়েছিল, যা পরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালের কাস্টমার রিলেশন অফিসার নয়ন বলেন, দগ্ধ ১২ জন শিক্ষার্থী এসেছিল। পাঁচজনকে ঢাকা মেডিক্যালে পাঠানো হয়, অন্যরা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে চলে যায়। এখানে কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি।

মন্তব্য
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে চার দলের বৈঠক

সরকারের পাশে থাকার আশ্বাস, কঠোর হওয়ার পরামর্শ

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
শেয়ার
সরকারের পাশে থাকার আশ্বাস, কঠোর  হওয়ার পরামর্শ

মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনার পর ক্ষোভ-বিক্ষোভে উত্তাল পরিস্থিতিতে চার রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বৈঠকে দলগুলো সরকারের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। একই সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সরকারকে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চার দলের নেতারা।

গতকাল মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় রাত ৯টা থেকে প্রায় দুই ঘণ্টা ওই বৈঠক চলে।

বৈঠক শেষে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেন, সব দলই ফ্যাসিবাদ মোকাবেলায় সরকারের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে দুটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে আসিফ নজরুল বলেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষার ক্ষেত্রে আমরা যেন আরো শক্ত অবস্থান নিই। এ ক্ষেত্রে আমাদের কিছুটা ঘাটতি আছে, এটা ওনারা বলেছেন। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নির্বাচনপ্রক্রিয়ার দিকে আমাদের সুষ্ঠুভাবে অগ্রসর হওয়া উচিত।

প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্ধৃত করে আসিফ নজরুল বলেন, বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশে বলেন, আপনাদের মধ্যে যে ঐক্য আছে, সেটা আরেকটু দৃশ্যমান হলে ভালো হয়। গঠনমূলক কোনো কর্মসূচি দিয়ে হোক অথবা যেকোনোভাবে হোক, আপনারা যদি একসঙ্গে থাকেন, তাহলে মানুষের মনে স্বস্তি আসবে। তিনি বলেন, ঐক্যের প্রমাণ হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলো উপস্থাপন করে যে, মাঠে উনারা নিজেদের মধ্যে যাই বলুন না কেন, প্রধান উপদেষ্টা ডাকলে তাঁরা আসেন। প্রধান উপদেষ্টা ডাকলে সবাই একসঙ্গে হাজির হন।

ঐক্য থাকার আরেকটা প্রমাণ হচ্ছে যে, দলগুলো জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মিটিংয়ে নিয়মিত যাচ্ছে।

আসিফ নজরুল বলেন, দলগুলো একটা বিষয় খুব জোর দিয়ে বলেছে, ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো হতাশা বা দুশ্চিন্তা থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। রাজনীতির মাঠে তারা যাই বলেন, ফ্যাসিবাদের বিষয়ে তারা ঐক্যবদ্ধ।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দলগুলো একটি বিষয় বলার চেষ্টা করেছে, নিষিদ্ধ দল, ফ্যাসিস্টদের সহযোগীরা মাঝেমধ্যে দেশের এখানে-সেখানে মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে। উনারা আমাদের বলেছেন, প্রশাসনিকভাবে ব্যবস্থা নিতে।

আমরা উনাদের বলেছি, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যটা মাঠে আরো বেশি দৃশ্যমান করুন।

বৈঠক শেষে ইসলামী আন্দোলনের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, এনসিপিসবাই আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে বলেছি যে, আমরা অবশ্যই সরকারের পাশে অতীতেও ছিলাম, এখনো আছি, সামনেও ইনশাআল্লাহ এই সরকারের পাশে থাকব।

গতকাল রাত ৯টা থেকে শুরু হওয়া এ বৈঠকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী; জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ, এনসিপির আহবায়ক নাহিদ ইসলাম ও সদস্যসচিব আখতার হোসেন এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম মেম্বার অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন ও যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠক শেষে বিএনপির পক্ষ থেকে কেউ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেননি।

আলোচনার বিষয়বস্তু তুলে ধরে আতাউর রহমান বলেন, বাংলাদেশে গতকাল থেকে আজকে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, তিনি (ইউনূস) বলেছেন যে পরাজিত শক্তি, বিশেষ করে ফ্যাসিবাদী শক্তির দোসররা, বিভিন্নভাবে চাচ্ছে এই পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়ার জন্য এবং পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে যাতে দেশে একটি অস্থিরতা তৈরি করা যায়, জনমনে আতঙ্ক ছড়ানো যায়, গুজব ছড়ানো যায়।

আতাউর রহমান বলেন, আমরা বলেছি, রাজনৈতিক দল হিসেবে একেক দলের একেক রকম বক্তব্য থাকবে, সমালোচনাও থাকবে। সামনে যেহেতু নির্বাচন হবে, নির্বাচনের আগে একদল অন্য দলের বিরুদ্ধে সমালোচনা করবে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা একটা প্রশ্নে সবার মধ্যে একমত, সেটা হলো আওয়ামী ফ্যাসিবাদ যাতে আবার পুনর্বাসিত হতে না পারে, তারা যাতে দেশ নিয়ে ষড়যন্ত্র করতে না পারে, দেশের বিরুদ্ধে কোনো রকম তৎপরতা চালাতে না পারে, এই ব্যাপারে আমরা ঐক্যবদ্ধ আছি।

তিনি বলেন, আমরা বলছি, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরো উন্নত করতে হবে এবং প্রশাসনিকভাবে সরকার যেন মজবুত হয়, আরো কঠোর হয় এবং সব কিছুকে কঠিনভাবে দমন করে।

আগামী দিনে যাতে একটা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়, সে ব্যাপারে বৈঠকে সবাই একমত হয়েছে মন্তব্য করে আতাউর রহমান বলেন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির জন্য আমরা সবাই একযোগে কাজ করব, এই ব্যাপারেও আমরা সবাই একমত হয়েছি।

মন্তব্য
সরেজমিন মাইলস্টোন

ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ছিন্নভিন্ন বই-খাতা স্বজনদের হাহাকার

শরীফ শাওন
শরীফ শাওন
শেয়ার
ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ছিন্নভিন্ন বই-খাতা স্বজনদের হাহাকার
বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনটিতে গতকালও উদ্ধার তৎপরতা চালানো হয়। ছবি : কালের কণ্ঠ

রাজধানীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ উত্তরা শাখার প্রাথমিক ভবনটি এখন ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। এক দিন আগেও যে ভবনটি শিশু শিক্ষার্থীদের কলহাস্য-গুঞ্জনে মুখর ছিল, সেখানে পুড়ে যাওয়া বিভিন্ন জিনিসের স্তূপ জমে আছে। পোড়া গন্ধে বাতাস ভারী। চারদিকে ছড়িয়ে আছে ছিন্নভিন্ন বই-খাতার ছাই আর আধপোড়া জঞ্জাল।

পরিবেশটা আরো দুঃসহ করে তুলেছে সন্তানের খোঁজে আসা অভিভাবক-স্বজনদের হাহাকার।

গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে সরেজমিনে দেখা যায়, দুর্ঘটনার দ্বিতীয় দিনও স্কুল ক্যাম্পাসের বাতাস ভারী হয়ে আছে পোড়া গন্ধে। সেই গন্ধে মিশে আছে দুর্ঘটনায় হতাহত শিশুদের কান্না, আতঙ্ক আর অসমাপ্ত পাঠ। থমথমে পরিবেশের মধ্যে শুধু নিঃশব্দে কান্না করে যাচ্ছেন কেউ কেউ।

কেউ পাথরের মতো স্থির, কেউ ভেঙে পড়ছেন ছেলের বা মেয়ের নাম লেখা একটি ছেঁড়া খাতার পাতা দেখে।

ভবনের সামনের খোলা জায়গায় পানি লেগে স্যাঁতসেঁতে হয়ে পড়ে আছে আংশিক পোড়া বই, আইডি কার্ড ও ব্যাগের টুকরা। এসবের ভেতর নিখোঁজ সন্তানদের চিহ্ন খুঁজে ফিরছেন অভিভাবকরা। কেউ পেয়েছেন সন্তানের ব্যবহৃত বই, কেউ নোটখাতা, আবার কেউ আইডি কার্ডের টুকরা।

তা দেখে বুক ঠেলে আসা হাহাকারে মুষড়ে পড়ছেন মা-বাবা।

এমন একজন অভিভাবক রাবেয়া খাতুন। মাটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বই-খাতাগুলো নিয়ে দেখছিলেন তিনি। হঠাৎ চিকার দিয়ে বলেন, এটা আমার মেয়ের ব্যাগ...আর এটা আমার মেয়ের লেখা। ওর খোঁজ তো পাইলাম না।

এগুলো তার চিহ্ন হয়ে থাকবে।

রাবেয়া খাতুনের ভাই সাগর হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, রাইসা মণি তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। সে দুর্ঘটনার পর থেকে নিখোঁজ। ক্যাম্পাসসহ রাতভর রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে খুঁজেও তার সন্ধান পাইনি।  তাই আজ (মঙ্গলবার) আবার এসেছি। একটি ছেঁড়া খাতায় তার হাতের লেখা আর ব্যবহৃত ব্যাগ দেখে শনাক্ত করতে পেরেছি।

স্কুল ক্যাম্পাসের চারপাশে নিরাপত্তা ও সহায়তা দিতে কাজ করছিলেন কিছু স্বেচ্ছাসেবক। ভবনের সিঁড়ির পাশে তাঁরা দড়ি দিয়ে একটি করিডর তৈরি করেছেন, অভিভাবকরা যাতে ভেতরে ঢুকে শেষবারের মতো একবার চেনা পরিবেশ দেখে আসতে পারেন। সেখানে কাউকে দেখা যায় নিঃশব্দে দেয়ালের পোড়া দাগ ছুঁয়ে কাঁদছেন, কেউ চোখ বন্ধ করে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে সয়ে নেওয়ার চেষ্টায় বুকচাপা কষ্ট।

স্বেচ্ছাসেবক রফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, অনেকে ভেতরে এসে কেবল দাঁড়িয়ে থাকেন, কেউ কিছু বলেন না। শুধু একটা বই বা আইডি খুঁজে নেন। আমরা তাঁদের সহায়তা করছি, কিন্তু কাকে কিভাবে সান্ত্বনা দেব, তা বুঝে উঠতে পারছি না।

সকালে ক্যাম্পাসজুড়ে ছিল অভিভাবকদের ভিড়। এর মধ্যে অনেকের দাবি, তাঁদের সন্তান এখনো নিখোঁজ। রাতভর বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরেও তাদের সন্ধান মেলেনি। তাই সকাল হতেই ছুটে এসেছেন ক্যাম্পাসে। তাঁরা জানেন না, সন্তানের ভাগ্যে কী ঘটেছে। শেষ স্মৃতি হিসেবে সন্তানের ব্যবহৃত একটি বই, খাতা, আইডি কার্ড বা ব্যাগ স্মৃতি হিসেবে খুঁজে বেড়াচ্ছেন তাঁরা।

মন্তব্য
পড়ে আছে ৬ এয়ারফিল্ড

ঢাকার আকাশে শিগগিরই বন্ধ হচ্ছে না যুদ্ধবিমানের প্রশিক্ষণ

মাসুদ রুমী
মাসুদ রুমী
শেয়ার
ঢাকার আকাশে শিগগিরই বন্ধ হচ্ছে না যুদ্ধবিমানের প্রশিক্ষণ

রাজধানীর আকাশে সামরিক ও বেসরকারি প্রশিক্ষণ বিমান উড্ডয়ন-অবতরণ দিন দিন বাড়ছে। এতে ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানীতে সাধারণ মানুষের জীবনে ঝুঁকির মাত্রাও বাড়ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা। গত সোমবার উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলের ওপর একটি এফটি-৭ বিজিআই প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে কোমলমতি ৩১ শিক্ষার্থী নিহত ও ১৬৫ জনের বেশি আহত হওয়ার পর বিষয়টি আবারও আলোচনায় এসেছে। দেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনার রেকর্ড এটি।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অন্তত ছয়টি এয়ারফিল্ড পড়ে থাকলেও রাজধানীর আকাশে কেন ঝুঁকিপূর্ণ যুদ্ধবিমানের প্রশিক্ষণ চলছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে নানা মহলে। মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি থেকে শিক্ষা নিয়ে এ বিষয়ে পদক্ষেপ না নিলে যেকোনো সময় আরো বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিমান চলাচল সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, আকাশও শহরের একটি স্পেস। সেটিকে নিরাপদ রাখা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রাজধানীর আকাশে প্রতিদিন গড়ে ১০-১২টি সামরিক ফ্লাইট এবং আরো কয়েকটি বেসরকারি ফ্লাইং ফ্লাইট পরিচালিত হয়। অথচ এসব মহড়ার জন্য শহরের বিকল্প প্রশিক্ষণস্থল যেমন ঈশ্বরদী, শ্রীমঙ্গল বা সৈয়দপুরকে ব্যবহার করার কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। দুর্ঘটনার পরও বিমানবাহিনী বা বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে রাজধানীর প্রশিক্ষণ আকাশপথ সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।

জানতে চাইলে এভিয়েশন বিশ্লেষক এ টি এম নজরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, এ ধরনের যুদ্ধবিমান নিয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় প্রশিক্ষণ চালানো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

অনেকে ভাবেন এগুলো শুধু প্রশিক্ষণের জন্য, কিন্তু এগুলো আসলে জেট যুদ্ধবিমানএকটি মেশিনের সামান্য ত্রুটি বড় দুর্ঘটনা ডেকে আনতে পারে।

তিনি বলেন, যখন ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি নির্মিত হয়েছিল, তখন এর আশপাশে এত ঘনবসতি ছিল না। সেখানে আমরা আবাসন, এমনকি স্কুল করতে দিলাম। যে স্কুলটিতে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটে গেল, সেই স্কুলটি কি বিমানবন্দরের এত কাছে থাকা উচিত? প্রতিদিন এখানে শতাধিক উড়োজাহাজ উঠছে-নামছে, এর বিকট শব্দ যাচ্ছে শিশুদের কানে। আকাশ প্রতিরক্ষার নিয়ম মানতে হবে, সেই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন থাকতে হবে।

শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে বিমানবন্দর সরানো যায়নি আমাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাবে।

 

আন্তর্জাতিক রীতিনীতি

পৃথিবীর কোনো দেশে এমন নজির নেই। সব দেশেই যাত্রীবাহী ও সামরিক বিমান উড্ডয়নের জন্য পৃথক রানওয়ে বা বিমানবন্দর থাকে। আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইকাও) সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে, প্রশিক্ষণ ও মহড়ার মতো উচ্চঝুঁকির ফ্লাইট অপারেশন জনবসতিপূর্ণ এলাকার বাইরে পরিচালনা করতে হবে।

আইকাওয়ের অ্যানেক্স-১৪-এর নির্দেশনায় বলা হয়েছে, প্রশিক্ষণ ফ্লাইটের জন্য এমন জায়গা নির্বাচন করতে হবে, যেটি হবে জনবসতি থেকে দূরে। যেখানে শব্দদূষণ কম হবে এবং ঝুঁকি কম থাকবে। বেবিচকের নীতিমালায়ও একই কথা বলা হয়েছে। তবে এসব বিধান অনুযায়ী প্রশিক্ষণ পরিচালনা না করে বিপদে রাখা হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, ঘনবসতিপূর্ণ শহরের ওপর দিয়ে জেট ইঞ্জিনধারী যুদ্ধবিমান ওড়ানো এক ধরনের অন্ধ ঝুঁকি নেওয়ার নাম। আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থার (আইকাও) নির্দেশনা অনুসারে, প্রশিক্ষণ পরিচালিত হওয়া উচিত জনবসতি ও বাণিজ্যিক উড়ানহীন অঞ্চলে’—যা রাজধানীর ক্ষেত্রে পুরোপুরি উপেক্ষিত।

 

পড়ে আছে দেশের ৬ এয়ারফিল্ড

বাংলাদেশে অন্তত ছয়টি পুরনো এবং পরিত্যক্ত এয়ারফিল্ড রয়েছে, যেগুলোর বেশির ভাগই সামান্য মেরামতে প্রশিক্ষণ উপযোগী করা সম্ভব বলে মনে করেন এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু এত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এই এয়ারস্ট্রিপগুলো এখনো কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না। ফলে ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানীর আকাশেই যুদ্ধবিমান প্রশিক্ষণ চালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে বিমানবাহিনী।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, পরিত্যক্ত বা আংশিক ব্যবহৃত অবস্থায় থাকা ছয়টি এয়ারফিল্ড হলোঈশ্বরদী, ঠাকুরগাঁও, কুমিল্লা, লালমনিরহাট, টাঙ্গাইল ও ফেনী। কিন্তু প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও বেবিচকের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, নীতিহীনতা ও সিকিউরিটি ট্যাগের কারণে এসব বিকল্প ব্যবহার হচ্ছে না।

 

প্রশিক্ষণের অবস্থান নতুন করে ভাবা দরকার : সাখাওয়াত

বিমান প্রশিক্ষণের জন্য স্থান নির্বাচনে নতুন করে ভাবার তাগিদ দিয়েছেন নৌপরিবহন, শ্রমকর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, ঢাকা শহর অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ। যুদ্ধবিমান প্রশিক্ষণের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কার্যক্রম কোনো দুর্ঘটনার আশঙ্কা বাড়িয়ে তোলে। তাই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে বিষয়টি নতুন করে বিবেচনা করা উচিত।

 

ইতিহাস আগেও আছে, গুরুত্ব পায়নি

এই দুর্ঘটনাই প্রথম নয়, আগেও ঘটেছে। বাংলাদেশে এফটি-৭ যুদ্ধবিমানের আরো কয়েকটি দুর্ঘটনার রেকর্ড রয়েছে। ২০১৮ সালের ২৩ নভেম্বর টাঙ্গাইলের মধুপুরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর বহরে থাকা একটি চীনা এফ-৭ বিজি বিধ্বস্ত হয়। সেই সময় বিমানের পাইলট উইং কমান্ডার আরিফ আহমেদ দীপু মারা যান। ২০১৫ সালের ২৯ জুন চীনা এফ-৭এমবি বঙ্গোপসাগরে বিধ্বস্ত হয়। সাগরে পড়ে যাওয়া ওই বিমানের পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তাহমিদ নিখোঁজ হন। এ ছাড়া ২০০৮ সালের ৮ এপ্রিল টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে বিধ্বস্ত হয় একটি চীনা এফটি-৭ যুদ্ধবিমান। বিমান থেকে বেরিয়ে আসার পরও স্কোয়াড্রন লিডার মোর্শেদ হাসান মারা যান।

 

প্রশিক্ষণ বিমান কারা চালান?

রাজধানীর আকাশে বর্তমানে প্রশিক্ষণ পরিচালনায় দুটি পক্ষ সক্রিয়। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর কুর্মিটোলা ঘাঁটি থেকে প্রতিদিন গড়ে ১০-১২টি প্রশিক্ষণ ফ্লাইট উড্ডয়ন করে। বেসরকারি ফ্লাইং স্কুল অন্তত তিনটি প্রতিষ্ঠান রাজশাহী, চট্টগ্রাম, উত্তরা ও আশপাশে প্রশিক্ষণ চালায়।

 

যা বলছে কর্তৃপক্ষ

ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় প্রশিক্ষণের বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান বলেন, বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে এমন জায়গা খুঁজে বের করলেও পাশে আবার ঘনবসতি হয়। এখানে যখন বিমানবন্দর হয়েছিল আমি যখন প্রথম এখানে ১৯৮৫ সালে ফ্লাই করেছিলাম তখন ওদিকে কিছুই ছিল না, উত্তরা বলতে কিছু ছিল না। এটার সঙ্গে ঘনবসতির সম্পর্ক করা ঠিক না। আমাদের দেশ ছোট, সব জায়গায় মানুষ। এটা (কুর্মিটোলা) আমাদের মেইন বেইস, সবচেয়ে ইম্পোর্ট্যান্ট জায়গা এটা। ভিআইপিরা এখানে থাকেন, আমাদের স্থাপনা এখানে, পার্লামেন্ট এখানে। একটা প্রটেকশনের ব্যাপার আছেএখানে একটা স্ট্রং এয়ারবেইস থাকা খুবই দরকার।

রাজধানী থেকে প্রশিক্ষণ বিমান স্থানান্তর প্রসঙ্গে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিক কালের কণ্ঠকে বলেন, এটা সরানোর উদ্যোগ আমার জানা মতে এই মুহূর্তে নেই।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, ঢাকা থেকে মাদারীপুর ও শরীয়তপুরের সীমান্তঘেঁষে একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের চূড়ান্ত পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী সমীক্ষাও করা হয়েছে। এক লাখ কোটি টাকা ব্যয়ের বিমানবন্দরের ড্রয়িং-ডিজাইন ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ব্যয় হয়েছে শতকোটি টাকা। তবে এক যুগ পরও বিমানবন্দর তৈরির পরিকল্পনা এখনো হিমঘরে। এ বিষয়ে খুব একটা অগ্রগতি নেই বলেও জানিয়েছেন বেবিচক চেয়ারম্যান।

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ