১৯৯৩ সালে বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান এফটি-৫ বিধ্বস্ত হলে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট কুদ্দুস নিহত হন। ১৯৯৬ সালে পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে বিমানবাহিনীর দুটি পিটি-৬১ প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হলে উইং কমান্ডার হক, স্কোয়াড্রন লিডার ইসলাম ও ফ্লাইং অফিসার মাসুদ নিহত হন। ১৯৯৮ সালের ২৬ অক্টোবর টাঙ্গাইলের মধুপুরে বিমানবাহিনীর মিগ-২১ বিধ্বস্ত হলে পাইলট নিহত হন। ১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে ২০০২ সালের ৭ জুন পর্যন্ত পারাবত ফ্লাইং একাডেমির বিমান দুর্ঘটনায় তিনজন পাইলটের মৃত্যু হয়। ১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর প্রশিক্ষণ উড্ডয়নের সময় এয়ার পারাবতের একটি বিমানে আগুন ধরে গিয়ে ঢাকার পোস্তগোলায় বিধ্বস্ত হলে নিহত হন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের কন্যা পাইলট ফারিয়া লারা (২৬) ও কো-পাইলট সৈয়দ রফিকুল ইসলাম। এর আগে ওই বছরের ২৭ জুন এয়ার পারাবতের আরেকটি বিমান সাভারের কাছে ক্র্যাশ ল্যান্ডিং করে। এতে কোনো প্রাণহানি ঘটেনি। ২০০২ সালের ৭ জুন এয়ার পারাবতের আরেকটি সেসনা-১৩০ প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন পাইলট মুখলেছুর রহমান সাকিব। এসব দুর্ঘটনার পর বন্ধ হয়ে যায় বেসরকারি এয়ারলাইনস এয়ার পারাবত।
এর আগে ২০০১ সালে ৭ জানুয়ারি একটি এফটি-৭ যুদ্ধবিমান ঢাকা বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত হলে স্কোয়াড্রন লিডার মোহাম্মদ মহাসীন নিহত হন। ২০০২ সালের ৩০ জুলাই চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হলে নিহত হন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আদনান মুকিত। ২০০২ সালের ১৯ অক্টোবর বিমানবাহিনীর একটি এম-১ হেলিকপ্টার চট্টগ্রামে সার্জেন্ট জহুরুল হক বিমানঘাঁটির কাছে একটি টেলিভিশন টাওয়ারে ধাক্কা লেগে বিধ্বস্ত হলে নিহত হন উইং কমান্ডার কাজী কামরুল নেওয়াজ, ফ্লাইং অফিসার সাব্বির আহমেদ, ওয়ারেন্ট অফিসার জহির হোসেন ও সার্জেন্ট আবদুস সামাদ।
২০০৫ সালের ৭ জুন ঢাকার উত্তরায় একটি ভবনে ধাক্কা খেয়ে ভেঙে পড়ে বিমানবাহিনীর একটি এফ-৭ এমবি যুদ্ধবিমান। এ ঘটনায় পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আহসানুল কবীর প্যারান্ডাটের মাধ্যমে অবতরণ করে নিজের জীবন বাঁচাতে সক্ষম হলেও দুই শিশুসহ ছয় বেসামরিক নাগরিক আহত হন। ২০০৬ সালের ২৪ এপ্রিল বিমানবাহিনীর একটি পিটি-৬১ প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। এ ঘটনায় ফ্লাইট ক্যাডেট তানিউল ইসলাম নিহত হন।
২০০৭ সালের ৯ এপ্রিল বিমানবাহিনীর একটি পিটি-৬১ প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। এতে নিহত হন বিমানটির পাইলট ফ্লাইট ক্যাডেট ফয়সল মাহমুদ। ২০০৮ সালের ৮ এপ্রিল আরেকটি এফ-৭ এমবি জঙ্গি বিমান বিধ্বস্ত হয় টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার পাহাড়িপাড়া গ্রামে। বিমানটির পাইলট স্কোয়াড্রন লিভার মোরশেদ হাসান বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার আগে প্যারাশুটের মাধ্যমে অবতরণের চেষ্টা করলেও শেষরক্ষা হয়নি। পরে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়।
২০০৯ সালের ৯ মার্চ যশোর থেকে ঢাকায় আসার পথে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় মর্মান্তিকভাবে নিহত হন মেজর জেনারেল রফিকুল ইসলাম ও হেলিকপ্টারের পাইলট লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহীদ ইসলাম। ২০০৯ সালের ১৬ জুন এফটি-৬ মডেলের প্রশিক্ষণ বিমান চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে পড়ে বিধ্বস্ত হয়। বিমানটির পাইলট সে সময় প্যারাশুটের মাধ্যমে অবতরণ করে জীবনরক্ষায় সক্ষম হন। একই বছরের ২২ অক্টোবর বগুড়ার কাহালুর কাছে এরোলিয়ায় রানওয়েতে অবতরণের সময় বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। ২০১০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে বিমানবাহিনীর এফ-৭ এমবি মডেলের একটি জঙ্গি বিমান বিধ্বস্ত হয়। ওই ঘটনায়ও পাইলট তাঁর জীবন রক্ষা করতে সক্ষম হন। ওই বিমানটিসহ আগের পাঁচ বছরে বিমানবাহিনীর তিনটি এফ-৭ এমবি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়।
২০১০ সালের ৩০ অক্টোবর সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার কাছে যমুনা নদীতে বিধ্বস্ত হয় ফ্লাইং ক্লাবের একটি প্রশিক্ষণ বিমান। এতে পাইলট কামরুল হাসানের মৃত্যু হয়। আরেকটি বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটে ২০১০ সালের ২০ ডিসেম্বর। এদিন বরিশালের কাছে একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে বিমানবাহিনীর দুজন বৈমানিক স্কোয়াড্রন লিডার আশরাফ ইবনে আহমেদ ও স্কোয়াড্রন লিডার মোহাম্মদ মাহমুদুল হক নিহত হন।
২০১১ সালের ১০ অক্টোবর চট্টগ্রামে প্রশিক্ষণ বিমানে আগুন লেগে গেলে দুজন পাইলট আহত হন।
২০১২ সালের ৮ এপ্রিল টাঙ্গাইলের মধুপুরে মুরইল ইউনিয়নের বড়মহর গ্রামে বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হলে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শরিফ রেজা নিহত হন।
২০১৩ সালের জুলাইয়ে রাশিয়ার তৈরি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান এ-ফাইভ পটিয়া উপজেলার একটি বিলে পড়ে। তার আগে প্যারাশুটের সাহায্যে নিরাপদে অবতরণ করেন পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আবু জাহের আরাফাত। ২০১৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি যশোরের সদর উপজেলার মাহিদিয়া গ্রামের ধানক্ষেতে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি পিটি-৬ প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। ওই ঘটনায় অক্ষত থাকেন বিমানের দুই পাইলট স্কোয়াড্রন লিডার ফারুক ও পাইলট অফিসার জামি। একই বছরের ৩০ এপ্রিল চট্টগ্রামে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়।
২০১৫ সালের ১ এপ্রিল রাজশাহীর শাহ মখদুম (রহ.) বিমানবন্দরে বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমির একটি ১৫২ মডেলের সেনা প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। এতে প্রশিক্ষণার্থী পাইলট তামান্না রহমান (২২) ঘটনাস্থলে নিহত হন। তাঁর প্রশিক্ষক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাঈদ কামালও পরে মারা যান। একই বছরের ২৮ জুন চট্টগ্রামে প্রশিক্ষণ চলাকালে সাগরে বিধ্বস্ত হয় এফ-৭ যুদ্ধবিমান। এতে বিমানের পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তাহমিদ নিখোঁজ হন। ২০১৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর সকালে কক্সবাজারের উখিয়ার সোনারপাড়া সমুদ্রসৈকতে মেঘনা এভিয়েশনের একটি হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে একজন নিহত ও চারজন আহত হন।
২০১৬ সালের ৯ মার্চ ট্রু এভিয়েশনের একটি কার্গো বিমান কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের কয়েক মিনিট পর বঙ্গোপসাগরের নাজিরারটেক পয়েন্টে বিধ্বস্ত হয়। এতে পাইলটসহ তিন ক্রু নিহত হন। আহত হন আরো এক বিদেশি। বিমানটি চিংড়ি পোনা নিয়ে কক্সবাজার থেকে যশোর যাচ্ছিল। নিহতরা হলেন বিমানটির পাইলট মুরাদ কাপারত, ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার কুলিশ আন্ত্রে ও কো-পাইলট ইভান ডেমান।
২০১৭ সালে মহেশখালীতে বিমানবাহিনীর দুই প্রশিক্ষণ বিমানের মধ্যে সংঘর্ষে দুটি বিমানই বিধ্বস্ত হয়। তবে পাইলটরা অক্ষত ছিলেন।
২০২১ সালের ১৬ মার্চ রাজশাহীর তানোরে আলুক্ষেতে বাংলাদেশ ফ্লাইং ক্লাবের একটি প্রশিক্ষণ বিমান আছড়ে পড়ে।
২০২২ সালের ২৭ জুলাই আর্মি এভিয়েশনের একটি বেল-২০৬ হেলিকপ্টার ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার একটি ধানক্ষেতে পড়ে। হেলিকপ্টারটি নিয়মিত প্রশিক্ষণ ফ্লাইট পরিচালনার অংশ হিসেবে ‘ইমার্জেন্সি ল্যান্ডিং প্রসিডিউর’ অনুশীলন করার সময় যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে অবতরণ করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ে। হেলিকপ্টারের উভয় পাইলট লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইসমাইল ও মেজর শামসকে হেলিকপ্টারযোগে ঢাকা সিএমএইচে আনা হয়।
২০২৪ সালের ৯ মে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকায় বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। এতে স্কোয়াড্রন লিডার আসিম জাওয়াদ নিহত হন।
গত ১৩ মার্চ যশোর বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণকালে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনার শিকার হয়। এ ঘটনায় বিমানের দুই পাইলট গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোল্লা মোহাম্মদ তহিদুল হাসান ও স্কোয়াড্রন লিডার আহমদ মুসা সুস্থ ছিলেন।
সর্বশেষ গতকাল ২১ জুলাই সোমবার বাংলাদেশে বিমান দুর্ঘটনার ইতিহাসে একটি শোকের দিন হিসেবে স্থান পায়। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান নিয়মিত প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে গতকাল দুপুর ১টা ৬ মিনিটে ঢাকার উত্তরায় দিয়াবাড়ীতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দোতলা একটি ভবনে বিধ্বস্ত হয়। নিহত হন বিমানের পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম সাগরসহ অনেকে। আইএসপিআর জানায়, গতকাল বিকেল ৫টা ২৫ মিনিট পর্যন্ত মর্মান্তিক ওই দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা পৌঁছেছে ২০ জনে। আহতের সংখ্যা ১৭১। এদের বেশির ভাগই শিক্ষার্থী।