নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে সারা দেশ এখন সোচ্চার। মাগুরায় আট বছরের শিশুটির মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর পুরো দেশ শোকে আবেগে ক্ষুব্ধ। এ সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সংঘটিত নারী নিপীড়নের ঘটনাগুলো ফলাও করে গণমাধ্যমে আসছে। দেশের মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ছে।
নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে ড. ইউনূসের দর্শন বাস্তবায়ন দরকার
বিশেষ প্রতিনিধি

বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের ঘটনা নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরে এই ঘটনাগুলো আমাদের সমাজে ঘটে চলেছে। মাঝেমধ্যে কোনো কোনো ঘটনা আমাদের আবেগতাড়িত করে। আমরা ক্ষোভে ফুঁসে উঠি।
নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধের দিকনির্দেশনা আমরা পেতে পারি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চিন্তা ও দর্শনে। ড. ইউনূস মনে করেন, নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে প্রথমে যেটি করা উচিত তা হলো আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। আর সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য নারীর ক্ষমতায়ন অত্যন্ত জরুরি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে গ্রামীণ ব্যাংকের মডেল আবিষ্কার করেছিলেন এবং যে মডেল আজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত সেই মডেলে নারীর ক্ষমতায়নের একটি বিন্যস্ত রূপরেখা রয়েছে। আমরা দেখেছি, গ্রামীণ ব্যাংকের এই মডেল প্রত্যন্ত গ্রামে বাস্তবায়নের পর বাংলাদেশে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি এবং নারী নির্যাতন কিছুটা হলেও কমেছে। গ্রামীণ ব্যাংকের নারী সদস্যরা তুলনামূলক কম নির্যাতনের শিকার। নারীর ক্ষমতায়নের মডেল যদি আর্থ-সামাজিক অবকাঠামোর মধ্যে প্রতিস্থাপন করা যায়, তাহলে নারীর প্রতি সহিংসতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে বলে সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দর্শনের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা গ্রামীণ ব্যাংকের মডেলে নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করলে একদিকে যেমন সমাজে নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাবে, নারীকে শ্রদ্ধার চোখে দেখবে অন্যদিকে নারীর এই ক্ষমতায়ন নারীকে স্বাবলম্বী করবে এবং তাঁর স্বাধীনতা, অধিকার আদায়ের পথ প্রশস্ত করবে। এই দুটির সমন্বয়ে আমরা একটি সহনীয় সমাজ পাব, যে সমাজে নারীর প্রতি নির্যাতন ও নিপীড়ন কম হবে। নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা আইনের আওতায় আসবে।
প্রথমে আমাদের দেখতে হবে, নারীর প্রতি কেন সহিংসতা ঘটছে? এসব ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ বিভিন্ন মহল রাজপথে নেমে আসার পরও এসব সহিংসতা কেন বন্ধ হচ্ছে না? এর সহজ উত্তর হচ্ছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। ধর্ষণ, নির্যাতন, নিপীড়নের বিচার আতীতে আমরা সঠিকভাবে করতে পারিনি। মাঝপথে থেমে গেছে বিচার। কারণ হলো যারা অপরাধ করেছে তারা ক্ষমতাবান। অন্যদিকে যেসব নারী ভিকটিম হয়েছেন তাঁরা দরিদ্র হওয়ায় মামলার দীর্ঘ প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে সক্ষম হননি। এখানেই আসে নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্ন। এখানেই আসে গ্রামীণ ব্যাংকের মডেলের কথা।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৭৬ সালে জোবরা গ্রামে গ্রামীণ ব্যাংকের যে মডেল শুরু করেছিলেন, সেই মডেলের একটি বড় দিক ছিল নারীর ক্ষমতায়ন। গ্রামীণ ব্যাংকের নারীদের অংশগ্রহণ এবং নারীদের ঋণ দেওয়ার হার ৯০ শতাংশের বেশি। সর্বশেষ হিসাবে দেখা গেছে, দেশজুড়ে গ্রামীণ ব্যাংকের আড়াই হাজারের বেশি শাখা থেকে প্রায় এক কোটি ১০ লাখ গ্রাহককে ঋণ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৯৭ শতাংশ নারী। গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মসংস্থানের হারে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, সেখানে ৯৬.৮১ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ রয়েছে। গ্রামাঞ্চলে নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারী নিপীড়ন বন্ধে এটি একটি নীরব বিপ্লব। বিশ্লেষণে দেখা যায়, যেসব জেলায় বা স্থানে গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম বিস্তৃত এবং যেসব নারী গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ গ্রহণ করেছেন তাঁরা স্বাবলম্বী হয়েছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নিয়ে ক্ষুদ্র সামাজিক ব্যবসায় নিজেকে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তুলেছেন। এসব নারী একদিকে যেমন সামাজিকভাবে মর্যাদাবান হয়েছেন, অন্যদিকে তাঁদের পারিবারিক ও সামাজিক নির্যাতনের হার তুলনামূলকভাবে অনেক কম। বিশেষ করে নারীরা যখন শিক্ষিত হন এবং অর্থনৈতিকভাবে আত্মনির্ভরশীল হন তখন তাঁর ওপর সহিংসতার মাত্রা অনেক কমে যায়।
তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অর্থনৈতিকভাবে পরনির্ভরশীল নারীরা গৃহে যতটা নির্যাতনের শিকার হন, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নারীরা সে তুলনায় অনেক কম নিপীড়নের শিকার হন। আর এখানেই হলো ড. ইউনূসের চিন্তার বাস্তব সাফল্য। তিনি সব সময় অনুধাবন করেছেন, আমাদের সমাজে নারীর প্রতি বৈষম্য, নারী নিপীড়ন এবং নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে নারীকে শক্তিশালী করতে হবে। নারীর ক্ষমতায়ন করতে হবে। এ কারণে তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের মডেলকে শুধু নারীর সম্পৃক্ততায় প্রধান করে তোলেননি, বরং গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক যে ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো করা হয়েছে, সেই প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারীদের অর্থনৈতিক চাঞ্চল্য ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেমন—গ্রামীণ টেলিকম, গ্রামীণ উদ্যোগ, গ্রামীণ সলিউশন, গ্রামীণ ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেড, গ্রামীণ শিক্ষা ইত্যাদি। অর্থাত্ এসব প্রতিষ্ঠান যে শুধু আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি কিংবা প্রান্তিক মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে কাজ করছে তা-ই নয়, একই সঙ্গে নারী জাগরণের কাজও করেছে। এভাবে তিনি নারী মুক্তির একটি রূপকল্প তৈরি করেছেন।
ড. ইউনূসের দর্শন হলো একটি কন্যাশিশুকে ছোটবেলা থেকে সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। তাকে বিকশিত করতে হবে। তার শিক্ষার সুব্যবস্থা করতে হবে এবং তাকে বাল্যবিবাহ থেকে দূরে রাখতে হবে। উপযুক্ত শিক্ষার পর তার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। গ্রামীণ ব্যাংক এই মডেলের মাধ্যমে বহুমাত্রিক কর্মসূচির মাধ্যমে নারী জাগরণের নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছে। এর ফলে দেশে নীরবে নারীর অধিকার আদায়ের বিষয়টি সামনে এসেছে। এখন আমরা যে নারী নিপীড়নের ঘটনাগুলো ঘটতে দেখছি, সেই ঘটনাগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত। কিন্তু এসব দুর্ভাগ্যজনক ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো প্রকাশ পাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, গণমাধ্যমের মাধ্যমে আমরা বিষয়গুলো জানছি। আগে এই বিষয়গুলোকে মানুষ নিয়তি বলে মেনে নিত। ভাবত, একজন নারীর জন্মই হয়েছে নির্যাতিতা হওয়ার জন্য। নির্যাতিতা হলে তিনি কোনো প্রতিবাদ করতে পারবেন না। কারণ নানা রকম লোকলজ্জার ভয়ে এ ধরনের প্রতিবাদ করলে উল্টো তাঁকেই অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। সেই বাস্তবতা থেকে নারীকে তাঁর অধিকার আদায়ের জায়গায় সোচ্চার হওয়ার যে মন্ত্রণা, শক্তি, সেটি ড. ইউনূসের দর্শন থেকেই নেওয়া।
দেশে গ্রামীণ ব্যাংকের যে বিস্তৃত কর্মযজ্ঞ, এই কর্মযজ্ঞকে আমরা যদি রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় প্রতিস্থাপন করতে পারি, ড. ইউনূসের আবিষ্কৃত গ্রামীণ ব্যাংকের যে চিন্তা ও দর্শন সেটাকে যদি আমরা রাষ্ট্র ও সমাজে বাস্তবায়ন করতে পারি তাহলে দেখব অভূতপূর্ব একটা নারী জাগরণ হয়ে গেছে। এর ফলে নারীর কর্মসংস্থান যেমন বৃদ্ধি পাবে, নারী শিক্ষার হার এবং নারীর অধিকার প্রাপ্তির হারও বেড়ে যাবে।
মনে রাখতে হবে, দেশের ৫১ শতাংশ জনগোষ্ঠী নারী। কাজেই এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে বাইরে রেখে কোনোভাবেই একটি কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। আর এ কারণে নারীকে আমাদের উন্নয়নের মূল কাঠামোর সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। এই সম্পৃক্তি যেন বৈষম্যমুক্ত হয়, সে জন্য ড. ইউনূসের দর্শনের কোনো বিকল্প নেই।
আজ মাগুরার শিশুটির মতো যেসব দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটছে, তা শুধু আইন দিয়ে বন্ধ করা যাবে না, এর জন্য প্রয়োজন সমাজে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। সমাজে নারীর ন্যায্য অবস্থান নিশ্চিত করা। এটি করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উপায় হলো ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নারী ক্ষমতায়নের যে দর্শন, তা বাস্তবায়ন করা। ড. ইউনূসের দর্শনকে যদি আমরা সর্বস্তরে বাস্তবায়ন করতে পারি তাহলে নারী নিপীড়নমুক্ত একটি দেশ আমরা পাব।
সম্পর্কিত খবর

মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি : অকালে ঝরা ফুল
যাঁদের হারালাম
নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দগ্ধ হয়ে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত ৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী। এ ছাড়া একাধিক শিক্ষক ও অভিভাবক রয়েছেন। নিহতদের মধ্যে রয়েছে স্কুলটির তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ফাতেমা আক্তার (৯), সপ্তম শ্রেণির মাহতাব রহমান ভূঁইয়া (১৪), চতুর্থ শ্রেণির আয়মান (১০), সপ্তম শ্রেণির আব্দুল মুসাব্বির মার্কিন (১৪), সপ্তম শ্রেণির মেহনাজ আফরিন হুমাইয়রা (১৪), তৃতীয় শ্রেণির ওয়াকিয়া ফেরদৌস নিধি (৯), তৃতীয় শ্রেণির নুসরাত জাহান আনিকা (১০), অভিভাবক রজনী ইসলাম (৩৭) ও লামিয়া আক্তার সোনিয়া; তৃতীয় শ্রেণির সাদ সালাউদ্দিন (৮), সপ্তম শ্রেণির সামিউল করিম (১৩), সপ্তম শ্রেণির সায়ান ইউসুফ (১৪), তৃতীয় শ্রেণির সায়মা আক্তার (৯), তৃতীয় শ্রেণির রাইসা মণি (৯), অষ্টম শ্রেণির তানভীর (১৩), অষ্টম শ্রেণির মাহিয়া তাসনিম (১৪), পাইলট তৌকির ইসলাম সাগর (২৭), ষষ্ঠ শ্রেণির আব্দুল্লাহ শামীম (১৩), নাদিয়া তাব্বাসুম নিঝুম (১৩) ও তার ছোট ভাই দ্বিতীয় শ্রেণির আরিয়ান আশরাফ নাফি (৯), শিক্ষক মেহরিন চৌধুরী (৪৬) ও মাসুকা বেগম (৩৭), অভিভাবক আফসানা আক্তার (২৮), তৃতীয় শ্রেণির শারিয়া আক্তার (৯), দ্বিতীয় শ্রেণির বোরহান উদ্দিন বাপ্পী (৮), শিক্ষক জোবায়ের (৩০), শিক্ষার্থী জোনায়েত (৯), শিক্ষার্থী আফনান ফাইয়াজ (১৪), শিক্ষার্থী এরিকসন (১৩), শিক্ষার্থী ওমর নূর আশিক (১১), আসিফ, মারিয়াম উম্মে আফিয়া ও উক্য মারমা।

পরশুরাম সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে দুই বাংলাদেশি নিহত
- জামায়াতের আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি
ফেনী প্রতিনিধি

ফেনীর পরশুরামে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে তিন বাংলাদেশি গুলিবিদ্ধ হয়ে দুজন নিহত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার রাত ১টা ৩০ মিনিটের দিকে উপজেলার গুথুমা বাঁশপদুয়া সীমান্তে এ ঘটনা ঘটে।
নিহত মিল্লাত হোসেন পৌর এলাকার বাঁশপদুয়া গ্রামের ইউছুফ মিয়ার ছেলে এবং নিহত লিটন একই গ্রামের আবুল কালামের ছেলে। আহত আবছারও একই গ্রামের মৃত এয়ার আহম্মদের ছেলে।
পরশুরাম স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা. ইফতেখার হোসেন জানান, গুলিবিদ্ধ মিল্লাত হোসেনকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনার আগেই তিনি মারা যান এবং মো. আবছারের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাঁকে ফেনী সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
স্থানীয় ও পরিবার সূত্রে জানা গেছে, গুলিবিদ্ধ লিটনকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বিলোনিয়া হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু রাতেই তিনি মারা যান বলে খবর আসে।
এলাকাবাসী ও বিজিবি সূত্রে জানা যায়, ২১৬৪/৩ এস পিলারের কাছে বিএসএফের ৪৩ ব্যাটালিয়নের আমজাদনগর ক্যাম্পের সদস্যরা বাংলাদেশিদের লক্ষ্য করে গুলি চালান।
এ বিষয়ে ফেনী বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মোশারফ হোসেন জানান, এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। কেন তাঁরা গভীর রাতে শূন্য রেখা অতিক্রম করেছেন বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। বিজিবির পক্ষ থেকে বাংলাদেশি নাগরিক নিহতের ঘটনায় বিএসএফকে প্রতিবাদলিপি পাঠানো হয়েছে। নিহত লিটনকে আনার ব্যবস্থাও করা হচ্ছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিএসএফের তাড়ায় একজন আহত : চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, শিবগঞ্জ উপজেলার সিংনগর সীমান্তের ওপারে বিএসএফের তাড়ার মুখে দেশে ফেরার পথে সেলিম মিয়া (২৫) নামের এক বাংলাদেশি চোরাকারবারি আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে বিজিবি।
সেলিম একই ইউনিয়নের তারাপুর পণ্ডিতপাড়া গ্রামের আরিফুল হক ওরফে হানিফের ছেলে। তবে তিনি কিভাবে আহত হয়েছেন তা বিজিবি জানাতে পারেনি। এ ছাড়া সীমান্তে গুলির কোনো ঘটনাও ঘটেনি বলে জানিয়েছে বিজিবি।
বিজিবি জানায়, বৃহস্পতিবার রাত ৪টার দিকে সিংনগর বিওপির অধীন সীমান্ত পিলার ৪/৫-১ এস-এর কাছ দিয়ে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করে দুই-তিনজন চোরকারবারির একটি দল। এ সময় ৭১ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের দৌলতপুর ক্যাম্পের সদস্যরা তাদের চ্যালেঞ্জ করলে তারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। বিজিবি ঘটনাটি জানার পর সেলিমের বাড়িতে খোঁজ করে তাঁকে পায়নি। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পর্যন্ত আহত ব্যক্তির খোঁজ করেও তাঁর সন্ধান মেলেনি। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি লুকিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
জামায়াতের আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি : দুই বাংলাদেশিকে গুলি করে অন্যায়ভাবে হত্যা করার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং জাতিসংঘের অধীনে সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। গতকাল রাতে এক বিবৃতিতে তিনি এ দাবি জানান।
জামায়াত আমির বলেন, ‘আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, বিএসএফ বাংলাদেশ সীমান্তে প্রায়ই বিনা কারণে হত্যাকাণ্ড ঘটায়। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে হত্যাকাণ্ড শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে ভারত বারবার প্রতিশ্রুতি দিলেও হত্যাকাণ্ড ক্রমাগত বাড়ছে। এসব হত্যাকাণ্ড ও ঘটনার আজ পর্যন্ত কোনো তদন্ত ও বিচারকাজ সম্পন্ন হয়নি। বাংলাদেশের জনগণ সব সময় প্রতিবেশীদের কাছে বন্ধুসুলভ ও সম্মানজনক আচরণ কামনা করে। আশা করি, ভারত সরকার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অনাকাঙ্ক্ষিত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করবে এবং বাংলাদেশি দুই যুবক মিল্লাত হোসেন ও লিটন হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে। একই সঙ্গে আমরা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে সব বাংলাদেশি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জাতিসংঘের অধীনে আন্তর্জাতিক তদন্ত ও বিচার দাবি করছি। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয় বিবৃতিতে।

তারেক রহমানের নির্দেশ
নিহতদের বাসায় গিয়ে সহমর্মিতা ফখরুলসহ বিএনপি নেতাদের
নিজস্ব প্রতিবেদক

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারের বাসাবাড়িতে গিয়ে সহমর্মিতা জানিয়েছেন বিএনপি নেতারা। একই সঙ্গে তাঁরা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে সমবেদনা ও শোক বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন।
গতকাল শুক্রবার দলটির নেতারা নিহতদের বাসায় যান বলে জানিয়েছেন বিএনপির মিডিয়া উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান।
দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিকেল ৪টায় ঢাকার সেনানিবাসে অবস্থিত শহীদ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম সাগরের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
আর মির্জা ফখরুল ইসলামের সঙ্গে ছিলেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান ও বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, চেয়ারপারসনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও সাবেক সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহী আকবর ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এ কে এম শামছুল ইসলাম। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় যান রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ীতে নিহত তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান আনিকাদের বাসায়।
দলের যুগ্ম মহাসচিব ও মিডিয়া সেলের সদস্য শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি যান শিক্ষিকা মাসুকা বেগমের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সেখানে তাঁরা এই শিক্ষিকার কবর জিয়ারত করে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করে শোক ও সমবেদনা জানান।
জাতীয়তাবাদী মহিলাদলের সভাপতি আফরোজা আব্বাসসহ দলের অন্য নেত্রীরা যান নীলফামারী জেলায়। সেখানে তাঁরা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষিকা মেহরিন চৌধুরীর কবর জিয়ারত করেন, যিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করে ২০ জন শিশুর প্রাণ রক্ষা করেছেন।
নীলফামারীতে জাতীয়তাবাদী মহিলা দল : নীলফামারী ও জলঢাকা প্রতিনিধি জানান, উত্তরায় শিক্ষার্থীদের জন্য জীবন উৎসর্গকারী মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষিকা মেহরিন চৌধুরীর কবর জিয়ারত করতে গতকাল শুক্রবার তাঁর গ্রামের বাড়িতে যায় বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাসের নেতৃত্বে মহিলা দলের নেত্রীরা নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার বগুলাগাড়ি চৌধুরীপাড়া গ্রামে পৌঁছান। তাঁরা কবর জিয়ারতের পর শিক্ষিকা মেহরিনের পরিবারের খোঁজখবর নিয়ে তাঁদের প্রতি সমবেদনা জানান।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য হেলেন জেরিন খান, মৃত মেহরিন চৌধুরীর স্বামী মনছুর হেলাল, নীলফামারী জেলা মহিলা দলের সভাপতি তাসমিন ফৌজিয়া ওপেল, লালমনিরহাট মহিলা দলের সভাপতি অ্যাডভোকেট জিনাত ফেরদৌস আরা রোজি, জলঢাকা উপজেলা মহিলা দলের সভাপতি নাসনি আক্তার ববি প্রমুখ।

‘কালো জামাটায় নুসরাতের গায়ের ঘ্রাণ লেগে আছে’
শিমুল মাহমুদ

তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান আনিকা। নতুন জামার প্রতি একটা টান ছিল ওর। প্রায়ই বায়না ধরত নতুন জামা কিনে দেওয়ার। ছবি আঁকতে খুব পছন্দ করত আর পছন্দ ছিল পাখি পুষতে।
গত সোমবার রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় মারা গেছে নুসরাত। উত্তরার দিয়াবাড়ীর মেট্রো রেলের ডিপোর পাশেই নুসরাতদের বাড়ি।
ড্রয়িংরুমের যে সোফায় বসে নুসরাত টিভি দেখত, সেখানে বসে আছেন বাবা আবুল হোসেন। পাশেই নুসরাতের প্রিয় সাইকেলটি। ভেতরের রুমে বিলাপ করছেন মা পারুল বেগম।
আবুল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঘটনার পর নিখোঁজ মেয়ের মরদেহ পাই পাঁচ ঘণ্টা পর, সিএমএইচে। গিয়ে দেখি, মুখে শুধু কালো দাগ। চুলের বেণি, স্কুলের আইডি কার্ড, ইউনিফর্ম কোনো কিছুই পোড়েনি।’
আবুল হোসেন বলেন, ‘ঘটনা ঘটে ২১ জুলাই। এর দুই দিন আগে নতুন জামা কিনে দিতে আবদার করেছিল।
প্রতিদিনের মতো সেদিনও বাবার হাত ধরে স্কুলে যায় নুসরাত। দুপুরে টিফিন নিয়ে যান মা পারুল বেগম। তিনি বলেন, ‘মৃত্যুর ১০ মিনিট আগেও আমার সঙ্গে কথা হয়। ক্লাস থেকে বের হয় মন খারাপ নিয়ে। জিজ্ঞাসা করলাম, কিছু হয়েছে? কিছু বলেনি। তখন দুপুর ১টা। আমি ঠাণ্ডা একটা কোক, রোল আর একটা কেক টিফিন নিয়ে যাই। বললাম, টিফিন খেয়ে নিয়ো। কোচিং শেষে আমি না হয় তোমার বাবা এসে নিয়ে যাব।এর কিছুক্ষণ পর বিমান বিধ্বস্ত হলো।’
তিনি বলেন, ‘ঘটনার খবর শুনে স্কুলে গিয়ে দেখি, শ্রেণিকক্ষে স্কুলের ব্যাগ, টিফিন বক্স পড়ে আছে। মেয়ে আমার টিফিনটুকুও খেতে পারল না।’
নুসরাতের ঘরে ঢুকতেই চোখ যায় দেয়ালে তার ছবিটির দিকে। দরজায় ফুল, লতাপাতা, মাঝে আরবিতে ‘আল্লাহ’ লেখা হাতে আঁকা ছবি। বিছানার পাশে পড়ার টেবিল রাখা, ড্রয়িং খাতা, বাংলা ও ইংরেজি বই। এর পাশে ওয়ার্ডরোব।
নুসরাতের মা ওয়ার্ডরোব খুলে কালো রঙের জামা বের করে দেখান। মেয়ের জামা বুকে জড়িয়ে চুমু খেতে খেতে বলেন, ‘এই জামাটায় মেয়ের গায়ের ঘ্রাণ পাই। স্কুলে যাওয়ার আগে মেয়েটার এ জামা পরা ছিল। কিছুদিন পর পর আবদার করত নতুন জামা কিনে দিতে। কত জামা যে কিনে দিয়েছি, এর মধ্যে এই জামাটা বেশি পরত।’
তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিল নুসরাত। মেজো বোন সুমাইয়া আক্তার রাত্রিও থাকত একসঙ্গে। সেও একই স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ে।
সুমাইয়া কালের কণ্ঠকে বলে, ‘নুসরাত যেদিন মারা যায়, সেদিন আমার সঙ্গে ওর দেখা হয়নি। আমি ঘুম থেকে ওঠার আগেই ও স্কুলে চলে যায়। দুজনের মধ্যে প্রায়ই খুনসুটি লেগে থাকত। এখনো আমার মনে হয় না যে ও নেই।’
সুমাইয়া বলেন, ‘গত দুই দিন আমি ওর বিছানায় যাইনি। যখনই ঘুমাতে যাই, আমার মনে হয়, নুসরাত আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে।’