অসীম-অনন্ত প্রেমময় আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে গভীর আকুতিপূর্ণ মোনাজাতের মধ্য দিয়ে গতকাল রবিবার শেষ হলো তাবলিগ জামাতের ৫৮তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের প্রথম দফা। রাজধানীর পাশেই টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে গভীর ভাবাবেগপূর্ণ পরিবেশে ‘আমিন, আল্লাহুম্মা আমিন’ ধ্বনিতে মুখরিত হয় আকাশ-বাতাস।
শুরায়ে নেজামের অনুসারীদের আখেরি মোনাজাত বা সমাপনী দোয়ায় মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে সমগ্র বিশ্বের মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, মুক্তি, শান্তি, সমৃদ্ধি, নিরাপত্তা, ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ কামনা করা হয়। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের কয়েক লক্ষাধিক মুসল্লি ছাড়াও আখেরি মোনাজাতে অংশ নিয়েছেন বিশ্বের অর্ধশতাধিক রাষ্ট্রের তিন সহস্রাধিক ধর্মপ্রাণ মুসলমান।
ইজতেমা ময়দানের বিদেশি নিবাসের পূর্ব পাশের মঞ্চ থেকে আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন মাওলানা হাফেজ মোহাম্মদ জুবায়ের আহমেদ। ২৪ মিনিটের মোনাজাতে মাওলানা জুবায়ের প্রথম ১২ মিনিট মূলত পবিত্র কোরআনে বর্ণিত দোয়ার আয়াতগুলো পাঠ করেন, শেষ ১২ মিনিট বাংলা ভাষায় দোয়া করেন।
সকাল ৯টা ১১ মিনিটে শুরু হয়ে ৯টা ৩৫ মিনিট পর্যন্ত চলে আবেগঘন আখেরি মোনাজাত। এই মোনাজাত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, মোবাইল ফোন, বেতার, ওয়্যারলেস সেট, ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও স্যাটেলাইট টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারের কারণে দেশ-বিদেশের আরো লাখ লাখ মানুষ এতে শরিক হতে পেরেছেন।
গতকাল মোনাজাতের আগে বাদ ফজর হেদায়েতি ও নসিহতমূলক বয়ান করেন ভারতের মাওলানা ইব্রাহিম দেওলা। তিনি ঈমান, নামাজ, আমল, তালিম, ইলম, জিকির, দাওয়াতের গুরুত্ব তুলে ধরেন। দিকনির্দেশনামূলক বয়ানের পর সকাল ৯টা ১১ মিনিটে জনসমুদ্রে হঠাৎ নেমে আসে আবেগঘন পিনপতন নীরবতা। যিনি যেখানে ছিলেন সেখানে দাঁড়িয়ে কিংবা বসে হাত তোলেন আল্লাহর দরবারে।
মোনাজাত উপলক্ষে টঙ্গী, গাজীপুর, উত্তরাসহ চারপাশের এলাকার প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, মার্কেট, বিপণিবিতান, অফিস—সব ছিল বন্ধ।
ফিরতি যাত্রায় বিড়ম্বনা ও যানজট : আখেরি মোনাজাত শেষে বিশাল জনস্রোতের সবাই একসঙ্গে বাড়ি ফেরার সময় সড়ক-মহাসড়কগুলোতে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। রাজপথজুড়ে শুধু মানুষ আর মানুষ, গাড়ি চলার মতো কোনো জায়গা ছিল না। প্রতিবছরই আখেরি মোনাজাতের পর এমন ঘটে থাকে।
দুপুরের পর সীমিত আকারে যানবাহন চলাচল শুরু হলেও বিকেল পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি।
টঙ্গী রেলস্টেশনে ফিরতি যাত্রীদের জন্য অপেক্ষমাণ ট্রেনগুলোতে উঠতে মানুষের জীবনবাজি লড়াই ছিল উদ্বেগজনক। ট্রেনের ভেতরে জায়গা না পেয়ে ছাদে ও দরজা-জানালায় ঝুলে শত শত মানুষকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি ফিরতে দেখা যায়। এক পর্যায়ে মানুষের কারণে ট্রেন দেখা যাচ্ছিল না।
৭ মুসল্লির মৃত্যু : বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের প্রথম দফায় মোট সাতজন মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে বলে কমিটি সূত্রে জানা গেছে। এই সাতজন হলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া থানার মো. ওয়াহিদ (৫০), ভোলার চরফ্যাশনের হাজি আব্দুল গফুর (৭৫), হবিগঞ্জ জেলা সদরের রমিজ উদ্দিন (৫৫), একই জেলার বাহুবল থানার ইয়াকুব আলী (৬০), খুলনার ডুমুরিয়া থানার আব্দুল কুদ্দুস গাজী (৬০), ঠাকুরগাঁও জেলার আমিরুল ইসলাম (৪৬) এবং শেরপুরের শ্রীবরদী থানার সাবেদ আলী (৭০)।
মোনাজাত চলাকালে ড্রোন আতঙ্কে শতাধিক আহত : গতকাল আখেরি মোনাজাতের শেষ দিকে সকাল ৯টা ৩১ মিনিটে টঙ্গী স্টেশন রোডে ফ্লাইওভারের পাশে হঠাৎ মুসল্লিরা আতঙ্কে ছোটাছুটি শুরু করেন। ড্রোন মাটিতে পড়ে সৃষ্ট শব্দ থেকে এই ঘটনা বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। ছোটাছুটির সময় শতাধিক মুসল্লি আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৪২ জন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শী গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জের আমজাদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার সামনে হঠাৎ তিনটি ড্রোন পড়ে গিয়ে বাঁশের সঙ্গে লেগে শব্দ হয়। এতে আতঙ্ক দেখা দিলে শুরু হয় দৌড়াদৌড়ি। এ সময় আহত অনেককে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।’
টঙ্গী শহীদ আহসানউল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া আহতরা হলেন বাংলা টিভির গাজীপুর প্রতিনিধি তাওহীদ (২৬), আবুল কালাম (৫৫), আলামিন (৩২), আজাদ (৩০), ওবায়দুল্লাহ (৩২), রাতুল (১৮), আব্দুল করিম (২৮), সাইফুল ইসলাম (৩৮), জাফর উদ্দিন (৩১), জয়নাল (২৪), মকবুল হোসেন (৬৪), সোহাগ (৬০), মোশারফ (৩০), কোরবান আলী (২৫), সাইফুল ইসলাম (৩৫), সালামত (১৮), মুস্তাকিন (৩৩), কবির হোসেন (৩০), মুবিন (১৮), আয়নাল হক (২২), মামুন হোসেন (২১), খোকন (৪৩), কবির হোসেন (৪৬), নাজিম উদ্দিন (৪১), জবরুল (৩১), জয়নাল (৫৪), কাওছারুল আলম (২৮), রায়হান (২৭), আলি নেওয়াজ (৩৮), আফতাব উদ্দিন (৪৭), মো. আমান (২৮), আনোয়ার (৪৫), সোহেল (৩৫), ফজল হক (৪৫), মুজাফফর আলীসহ (৪৪) ৪২ জন। আহত অন্যদের নাম জানা যায়নি।
টঙ্গীর এই হাসপাতালে কর্তব্যরত সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) বেলায়েত হোসেন কালের কণ্ঠকে জানান, ড্রোন পড়ার আতঙ্কে অনেক মুসল্লি দৌড়ে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ইনচার্জ মোস্তাফিজুর রহমান জানান, অনেক মুসল্লি আহত হয়ে হাসপাতালে এসেছেন। তাঁদের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। তাঁরা ইজতেমার মোনাজাত চলাকালে আতঙ্কে হুড়োহুড়ি করার সময় পড়ে গিয়ে আহত হন বলে জানিয়েছেন।
টঙ্গী পূর্ব থানার ওসি ফরিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, ব্যাটারি শেষ হয়ে যাওয়ায় একটি ড্রোন পড়ে যাওয়ার শব্দ থেকে আতঙ্কের সৃষ্টি। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
আজ সোমবার (৩ ফেব্রুয়ারি) শুরু হবে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের দ্বিতীয় ধাপ। আগামী বুধবার আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে দ্বিতীয় ধাপ শেষ হবে।
আট দিন বিরতি দিয়ে ১৪ ফেব্রুয়ারি শুরু হবে ৫৮তম বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব। মাওলানা সা’দ আহমাদ কান্ধলভির অনুসারীদেও ওই পর্বের আখেরি মোনাজাত হবে ১৬ ফেব্রুয়ারি রবিবার।

বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাত শেষে গতকাল টঙ্গী রেলস্টেশনে মুসল্লিদের উপচে পড়া ভিড়। ছবি : কালের কণ্ঠ