নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার বিশনন্দী ইউনিয়নের মেঘনা নদীর পারে ছোট্ট এক গ্রাম মানিকপুর। এই গ্রামের সিদ্দিকুর রহমান কখনো নদীতে মাছ ধরে, কখনো বা কৃষিকাজ করে সংসার চালাতেন। স্ত্রী আর তিন সন্তান নিয়ে অভাবের ঘর। সন্তানদের মৌলিক চাহিদা মেটাতেই হিমশিম অবস্থা।
মানুষ বেচে ওরা কোটিপতি
রাসেল আহমেদ, রূপগঞ্জ

সম্প্রতি বিলকিস বেগমের জীবনের এই কঠিন ট্র্যাজেডি শুনতে গেলে আশপাশে আরো কিছু মানুষ জড়ো হয়। মানিকপুর গ্রামের বাসিন্দারা বলছিল, কৃষক সিদ্দিকুর একা নন, তাঁর মতো পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে আরো বহু মানুষকে। আর এই গল্প মানিকপুর ছাড়িয়ে পুরো উপজেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামের। ভাগ্যক্রমে কেউ মালয়েশিয়ায় পৌঁছে যান, অনেকেরই সলিলসমাধি ঘটে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সাগরে।
এখানকার আরো কয়েকটি বাড়ি ঘুরে কালের কণ্ঠ জানতে পারে, দালাল নকীবের চক্র জাল পেতে রেখেছে পুরো আড়াইহাজার উপজেলায়। তাঁর দলে আছে অন্তত ৬০ জনের বিশাল মাঠকর্মী। এই মাঠকর্মীদের কাজ হলো গ্রামের অভাবী সহজ-সরল মানুষ বাছাই করা। এরপর চটকদার প্রলোভন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলা। বিনিময়ে মাঠকর্মীদের পকেটও গরম হয়। কালের কণ্ঠ পুরো উপজেলা ঘুরে ৭৯টি পরিবারের সন্ধান পেয়েছে, যাদের পরিবারে একমাত্র কর্মক্ষম পুরুষ মানুষটি সচ্ছল জীবনের খোঁজে বেরিয়ে হারিয়ে গেছেন প্রায় চিরতরে, যাঁদের বিপথে ঠেলে দেওয়ার অন্যতম কুশীলব নকীব।
কালের কণ্ঠ অনুসন্ধানে নামে জানতে যে কে এই নকীব। মানিকপুর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে দিঘলদী গ্রামে নকীবের বাড়ি। বাড়ি তো নয়, সুনসান নিশ্চল গ্রামের ভেতরে আলিশান এক ত্রিতল বাড়ি। স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপে জানা গেল, এই বাড়িতে গত সাত-আট বছর ধরে কোনো মানুষ থাকে না। দেড় থেকে দুই দশক আগে নকীব ছিলেন তাঁত শ্রমিক। তাঁতকল অধ্যুষিত আড়াইহাজারের শ্রমিকরা এমন বাড়ির মালিক হওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবেন না। অথচ নকীব এমন চার-চারটি বাড়ি গড়েছেন।
দিঘলদী গ্রামে নকীবের একে একে তিনটি বাড়িতে সরেজমিনে গেছেন কালের কণ্ঠ’র প্রতিবেদক। বাকি দুটির একটি দোতলা, আরেকটি তিনতলা। তিনটি বাড়ির কোনোটিতেই কেউ থাকে না। এমনকি ভাড়াও দেওয়া হয় না। ইব্রাহিম নকীবের নামে দিঘলদী মৌজাতেই সন্ধান মেলে আরো প্রায় ১৫ একর জমির। এ ছাড়া ফাউসা বাজারে তাঁর রয়েছে একটি বাণিজ্যিক ভবন, যেখানে রয়েছে তিনটি দোকান। স্থানীয়দের ভাষ্য মতে, মানুষ বেচার কারবার শুরু করেই যেন আলাদিনের চেরাগ হাতে পেয়ে বদলে গেছে নকীবের জীবন।
অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে মাঠকর্মীদের নিয়ে গড়ে তোলা দালাল নকীবের সাম্রাজ্যের চেয়ে আরো বড় এক চক্রের সন্ধান পেল কালের কণ্ঠ। এই চক্রের নেতৃত্বে আছেন ঈসমাইল হোসেন। বিশনন্দী গ্রামের ঈসমাইল ২০০১ সালে শ্রমিক হিসেবে মালয়েশিয়া গিয়েছিলেন। ২০০৫ সালে দেশে ফিরে তিনি গড়ে তোলেন আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্র। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ইসমাইলের চক্রে মায়ানমার ও মালয়েশিয়ার ১০ থেকে ১২ জন নাগরিক যুক্ত রয়েছেন, যাঁরা আড়াইহাজার থেকে শিকার সংগ্রহ করেন এবং পরে তাদের মায়ানমারে বন্দি করে মুক্তিপণ আদায় করেন। মুক্তিপণ না পেলে অনেক ক্ষেত্রেই বন্দিকে নির্যাতন করে মেরে ফেলা হয়। গত আগস্টে দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রকাশ্যেই সহযোগীদের নিয়ে মানবপাচার কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছিলেন ঈসমাইল। কিন্তু এর পর থেকে তাঁকে আর দেখা যায়নি। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করাও সম্ভব হয়নি। বিশনন্দী গ্রামের যে পৈতৃক বাড়িতে পরিবার নিয়ে থাকতেন ঈসমাইল, সেখানে গিয়ে দেখা যায় সেটি তালাবদ্ধ। কোনো মানুষ সেখানে থাকে না। তারা কোথায় গেছে প্রতিবেশীরাও জানে না।
কালের কণ্ঠ’র দীর্ঘ অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য এবং ভুক্তভোগীদের ভাষ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, অনিশ্চিত সমুদ্রপথে নামিয়ে দেওয়ার পর স্থানীয় দালালরা লাপাত্তা হয়ে যায়। কিন্তু অভিবাসীদের ঠেলে দেওয়া হয় মরণপণ এক সংগ্রামে। সাগরে ভাসতে ভাসতে পথের কষ্টে, খাদ্যাভাবে, নির্যাতনে অনেকেই প্রাণ হারান। তাঁদের কঙ্কালসার মৃতদেহ ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয় সমুদ্রে। কেউ বা ধরা পড়েন পথিমধ্যে কোনো দেশে। কিংবা ধরা পড়েন মালয়েশিয়া পুলিশের হাতে। ফলাফল কারাবাস। কেউ বা আন্তর্জাতিক অপহরণ চক্রের খপ্পরে পড়ে নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন কিংবা তাদের হাতেই প্রাণ হারিয়েছেন। ওদিকে বাংলাদেশে থাকা তাঁদের দরিদ্র পরিবার মুক্তিপণের অর্থ জোগাতে গিয়ে হয়েছে সর্বস্বান্ত। কেউ বা মুক্তিপণের টাকা পাই পাই করে বুঝিয়ে দেওয়ার পরও ফেরত পেয়েছেন লাশ।
বাংলাদেশ, মায়ানমার, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া—পর পর চারটি সমুদ্র উপকূলবর্তী দেশ। পরস্পর লাগোয়া চারটি দেশই হয় বঙ্গোপসাগর, নয়তো আন্দামান সাগরের উপকূলবর্তী। এই উপকূলই হচ্ছে পাচারকারীচক্রের রুট, যার শুরু বাংলাদেশের টেকনাফ উপকূলে। শেষ হয় মায়ানমার হয়ে থাইল্যান্ড বা মালয়েশিয়া উপকূলে।
পাচারচক্রে ফেঁসে গিয়ে ভাগ্যক্রমে ফিরে আসতে পেরেছেন, এমন অন্তত ৭০ জনের সঙ্গে কথা বলতে সমর্থ হয় কালের কণ্ঠ। তাঁদের তথ্য মতে, আড়াইহাজার থেকে পাচারের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে থাইল্যান্ডে নিয়ে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায় করা হয়। এ জন্য গড়ে তোলা হয়েছে একাধিক টর্চার সেল। মায়ানমার ও থাইল্যান্ডে এসব টর্চার সেল রয়েছে, যেখানে এখনো অনেক বাংলাদেশি বন্দি থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে একের পর এক গণকবর আবিষ্কার হওয়ার ঘটনা ঘটে। সেই সব গণকবরে পাওয়া গিয়েছিল বহু হতভাগ্য মানুষের কঙ্কাল, দেহাবশেষ। এসব দেহাবশেষ ছিল মায়ানমার ও বাংলাদেশের নাগরিকদের।
মানবপাচার নিয়ে তৎপর বেসরকারি সংস্থাগুলো বলছে, যে উপজেলাটি একসময় বিখ্যাত ছিল দেশি কাপড় উৎপাদনের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র হিসেবে, সেই আড়াইহাজার এখন মানবপাচারের রাজধানী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বেসরকারি সংস্থা ওকাপ জানায়, দেশের ছয়টি জেলায় সবচেয়ে বেশি মানবপাচারের ঘটনা শনাক্ত করা গেছে। এগুলো হচ্ছে : ফরিদপুর, নড়াইল, ঝিনাইদহ, শরীয়তপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জ। কিন্তু রাজধানী ঢাকার একেবারে কানের পাশে আড়াইহাজারের মতো উপজেলা দেশে আর কোনোটি নয়।
গরুর ট্রলারে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের অনিশ্চিত যাত্রা
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চৈতনকান্দি গ্রামের ষাটোর্ধ্ব রুস্তম মিয়াও পাচারকারীর খপ্পর থেকে রেহাই পাননি। তাঁকে টেকনাফে নিয়ে একটি বড় জাহাজের সামনে নেওয়া হয়। দালালচক্রের এক সদস্য তখন জানায় যে এই বিশাল জাহাজে করেই তাঁকে মালয়েশিয়া পৌঁছে দেওয়া হবে। সরল মনে রুস্তম তখন মোটামুটি নিশ্চিন্তই হয়েছিলেন। কিন্তু ঘোর ভাঙতে বেশি সময় লাগেনি তাঁর। যাত্রার দিন অন্য সঙ্গীদের সঙ্গে তাঁকেও তোলা হয় একটি গরুর ট্রলারে।
নিজের বাড়িতে বসে রুস্তম বলেন, ‘বুড়া মানুষ আমি। ভাবছিলাম জাহাজে করে যেতে পারলে কাজ করে খেতে পারব। জাহাজের ছবি দেখিয়েছিল। কিন্তু আমাদের নিয়েছিল গরুর ট্রলারে।’ গরুর ট্রলারে যাত্রা শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত মাঝপথে ধরা পড়ে দেশেই ফিরে আসতে হয়েছিল তাঁকে।
ব্রাহ্মদী ইউনিয়নের স্বপন ভূঁইয়াসহ ৪০ জনকে সমুদ্রগামী ট্রলারে তোলা হয়েছিল ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে। জাহাজ ছাড়ার কয়েক ঘণ্টা পরই মুক্তিপণের দাবিতে তাঁদের ওপর নির্যাতন শুরু হয়। পাচারকারীদের দাবি অনুযায়ী স্বপনের স্ত্রী হাসিনা বেগম দালালদের সরবরাহ করা একটি বিকাশ নম্বরে ৫০ হাজার টাকা পাঠান। এরই মধ্যে স্বপনদের এক সঙ্গীকে মেরে সমুদ্রে লাশ ফেলে দেয় পাচারকারীরা। ট্রলারটি শেষ পর্যন্ত মায়ানমারের কোস্ট গার্ডের হাতে ধরা পড়ায় বেঁচে যান স্বপনসহ অন্যরা।
চৈতনকান্দী গ্রামের বাবু মিয়া ট্রলারে চেপে ভেসে বেড়িয়েছিলেন পাঁচ মাস। এক পর্যায়ে দালালরা তাঁদের ট্রলারসহ ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। পরে স্থানীয় একটি জেলে নৌকা তাঁদের ভাসতে দেখে পুলিশে খবর দিলে থাইল্যান্ডের পুলিশ তাঁদের উদ্ধার করে।
মানিকপুর গ্রামের আরেক ভুক্তভোগী আল-আমীন। তিনবার বিক্রি হয়ে বহুদিন সাগরে ভেসে মালয়েশিয়ার লঙ্কাউই দ্বীপ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লঙ্কাউইতে মালয়েশিয়ার পুলিশের হাতে ধরা পড়েন।
নকীব ও ঈসমাইল চক্রে শতাধিক মাঠকর্মী
নকীবের অবস্থান নিয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি। তথ্য মতে, আড়াইহাজার থানায় ইব্রাহীম নকীবের নামে তিনটি মানবপাচারের মামলা আছে। এসব মামলায় ২০১৩ সালে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন তিনি। পরে ছাড়াও পেয়ে যান। সেই থেকে তিনি নিরুদ্দেশ। পুলিশের দাবি, নকীব বিদেশে অবস্থান করছেন।
এলাকাবাসীর বক্তব্য, তিনি মাঝেমধ্যে খুব গোপনে আড়াইহাজার এসে ঘুরে যান। ২০১৩ সালে আড়াইহাজারের যেসব পরিবারের সদস্যরা মালয়েশিয়া উদ্দেশে যাত্রা করে চিরতরে নিখোঁজ হয়ে গেছেন, তাঁদের অন্তত চারটি পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেছেন, নকীবই ওই মানবপাচারের ঘটনাগুলোর মূল কুশীলব।
স্থানীয়রা বলছে, নিজে প্রকাশ্যে না এলেও আড়ালে থেকে মানবপাচারের কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছেন নকীব। তাঁর হয়ে আড়াইহাজারে পাচারের জন্য মানুষ সংগ্রহ করার মাঠকর্মী হিসেবে কাজ করে অন্তত ৬০ জন মানুষ। নকীবের ছোট ভাই ইয়াহিয়া নকীব আড়াইহাজারে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ হিসেবে এলাকায় পরিচিত ছিলেন। তাঁরা দুজনও এখন পলাতক।
কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে উঠে এসেছে মাঠ পর্যায়ে কাজ করা দালালচক্রের বেশ কয়েকজনের নাম। এর মধ্যে আইয়ুব খান, আলম খান, ইমরান, ইয়াকুব, আলাউদ্দীন, সোহাগ, মোবারক, আরিফ ও হায়দার মিয়া নকীবের চক্রের সদস্য। নকীব আগে থেকেই গোপন অবস্থানে থেকে কাজ করে এলেও তাঁর সহযোগীরা এত দিন প্রকাশ্যেই ছিল। তবে ৫ আগস্টের পর তারা সবাই পলাতক। তবে এদের মধ্যে হায়দার মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয় কালের কণ্ঠ। হায়দার নিজেও একসময় কৃষি শ্রমিক ছিলেন। এখন আড়াইহাজারে তিনি তিনটি বাড়িসহ মার্কেট এবং ১০ একর কৃষিজমির মালিক।
মানবপাচারের দালাল হিসেবে কাজ করার কথা স্বীকার করে হায়দার মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দালালি তো সবাই করে। আমার কেন দোষ হবে?’
আগস্টে পটপরিবর্তনের পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন ঈসমাইল। গত বছরের আগস্টে আড়াইহাজার থানায় তাঁর নামে মানবপাচার আইনে একটি মামলা হয়। ওই মামলায় ঈসমাইলসহ মোট আটজনের বিরুদ্ধে ২০ থেকে ২৫ জন ব্যক্তিকে বিদেশে পাচারের অভিযোগ আনা হয়। মামলার সূত্র ধরে ঈসমাইলকে তাঁর দুই সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করে র্যাব। সে সময় ব্রিফিংয়ে র্যাব জানিয়েছিল, ২০০৫ সাল থেকে ঈসমাইল মায়ানমারের দুই নাগরিককে সঙ্গে নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক পরিচালনা করছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আড়াইহাজারের মানুষকে ফুসলিয়ে টেকনাফ থেকে নৌকায় তুলে দিত ঈসমাইলের দলের সদস্যরা। সেখান থেকে তাঁদের মায়ানমারের আরাকানে পাঠিয়ে দেওয়া হতো জামাল নামে তাদের এক চক্রের সদস্যের কাছ। মায়ানমারে গোপন ক্যাম্পে জামাল ও তাঁর সহযোগীরা ভুক্তভোগীদের বন্দি করে নির্যাতন চালাত। তারা নির্যাতনের ভিডিও ধারণ করে ঈসমাইলের কাছে পাঠাত। ঈসমাইল সেই ভিডিও ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যদের কাছে পাঠাতেন এবং জনপ্রতি ছয় লাখ টাকা করে মুক্তিপণ দাবি করতেন। যেসব পরিবার মুক্তিপণ দিতে পারত তাদের সদস্যদের থাইল্যান্ডের সমুদ্রসীমা হয়ে মালয়েশিয়ায় রশিদুল নামে চক্রের অন্য এক সদস্যের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। এভাবে শেষ হতো একেকটি অপহরণ চক্র। ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে সংবাদ সম্মেলন করে এসব তথ্য জানিয়েছিল র্যাব।
জানা গেছে, ঈসমাইল চক্রের অন্তত ৪০ জন সদস্য মাঠ পর্যায়ের দালাল হিসেবে কাজ করে। বাকি সব দালালের মতো এরাও এখন পলাতক। তবে এই ঈসমাইল চক্রেরও দুজন সদস্যের সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের।
তাদের একজন কলাগাছিয়া গ্রামের মজিবুল্লাহ বলেন, ‘মাইনসের উফকার করছি ভাই। ক্ষতি করি নাই। বিদেশ পাডাইছি। গিয়া আমাগো ট্যাকা দিছে। অহন হেরা সুখে আছে।’ আরেকজন তাঁতীপাড়া গ্রামের ইয়াকুব বলেন, ‘দালালি তো খারাপ না। মানুষ পাডাইছি, হেরা আমাগো ট্যাকা দিছে।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, মানব পাচারকারীদের মধ্যে দুজন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার রেকর্ডও গড়েছেন। তাঁদের একজন আড়াইহাজার পৌরসভার মেয়র সুন্দর আলী। সুন্দর আলী নিজেই একসময় একটি মানব পাচারকারী চক্রের প্রধান ছিলেন। অবশ্য ২০১৯ সালে পৌর মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তিনি আর মানব পাচার চক্রের সঙ্গে প্রকাশ্য সম্পর্ক রাখেননি। অন্যদিকে ২০০৯ সালে হাইজাদি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত আরেকটি চক্রের প্রধান ছিলেন আলী হোসেন। গত ৫ আগস্টের পর থেকে তাঁদেও এলাকায় প্রকাশ্যে দেখা যায়নি।
‘মানবপাচারের এয়ারপোর্ট’
টেকনাফের বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি নৌকা মানবপাচারের কাজে যুক্ত রয়েছে। প্রতি রাতে অন্তত ১০টি নৌকা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের নিয়ে এখান থেকে ছেড়ে যায়। প্রতিটি নৌকায় ঠাসাঠাসি করে বসানো হয় ৫০ থেকে ৭০ জন মানুষ। অবশ্য গত ৫ আগস্টের পর এই চিত্র বদলে গেছে বলে প্রশাসনসহ একাধিক সূত্র দাবি করেছে।
এর আগে সরেজমিনে গিয়ে ও এলাকাবাসীদের সঙ্গে কথা বলে মোট তিনটি ঘাটের অস্তিত্ব জানা গেছে। এর মধ্যে টেকনাফ সদর ইউনিয়নে রয়েছে তুলাতলী ও লম্বরী ঘাট। আর বাহারছড়া ইউনিয়নে রয়েছে কচ্ছপদিয়া ঘাট। আব্দুল লতিফ নামের টেকনাফের একজন জেলের সঙ্গে কথা হয় কালের কণ্ঠ’র। তিনি বলেন, এই ঘাট তিনটিকে স্থানীয়রা চেনে ‘মানবপাচারের এয়ারপোর্ট’ হিসেবে।
তুলাতলী ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, ১০ থেকে ১২টি জেলে নৌকা ঘাটে বাঁধা। দৈর্ঘ্য ৫০ থেকে ৬০ ফুটের বেশি হবে না। এই নৌকাগুলো গভীর সমুদ্রে যাওয়ার উপযোগী নয়। একজন স্থানীয় যুবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নোঙর করা এই বোটগুলোই গভীর রাতে মালয়েশিয়াগামী লোকজনকে তুলে নিয়ে গভীর সমুদ্রে বড় জাহাজে তুলে দিয়ে আসে।
তুলাতলী ঘাটের দুজন জেলে বলেন, তাঁরা সাগরের কাছাকাছি আরো ছোট নৌকায় করে মাছ ধরে সংসার চালান। আর ঘাটে যে নৌকাগুলো বাঁধা অবস্থায় দেখা গেছে, কালের কণ্ঠ’র প্রতিবেদককে সেগুলো মাছ ধরে না বলে জানান তাঁরা। এগুলো মানুষ পাচার করে। সাগরে এসব নৌকার আনাগোনাই বেশি—বলেন দুই জেলে।
তিনটি ঘাটের কাছেই ঝুপড়ির মতো কিছু ঘর চোখে পড়ে এই প্রতিবেদকের। ঘরগুলো চাটাইয়ের বেড়া দিয়ে তৈরি। টিনের চাল। কোনো জানালা নেই। যে দুজন জেলের সঙ্গে কথা হয় তাঁরা বলেন, এই ঘরগুলোতেই প্রথমে পাচারের শিকার মানুষদের এনে আটকে রাখা হয়। যখন ঘরগুলোর ভেতরে মানুষ থাকে তখন এগুলোর চারপাশে পাহারা থাকে। এই ঘরগুলো থেকেই তাদের রাতের বেলা তুলে নেওয়া হয় নৌকায়, যে নৌকাগুলোকে একমাত্র তুলনা করা যায় সত্যজিৎ রায়ের লেখা সেই পাপাঙ্গুল ছড়ার ‘ছাঁকনি’র সঙ্গেই।
প্রশাসন কী করছে?
তবে এই ধারাবাহিক প্রতিবেদনের জন্য সাত মাস ধরে অনুসন্ধান ও মাঠ পর্যায়ের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে—মানবপাচার আড়াইহাজারে এত ব্যাপক আকার ধারণ করেছে যে এটা এখন অনেকটা স্বাভাবিক বিষয় এই এলাকার বাসিন্দাদের কাছে। এই মানবপাচারের দালালদের শেকড় সমাজের এত গভীরে প্রথিত যে দিনশেষে এরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। যারা এই পেশার সঙ্গে জড়িত তারা এটাকে কোনো অপরাধ বলে গণ্যও করে না।
আড়াইহাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাহিদুর রহমান অবশ্য কালের কণ্ঠকে বলেছেন, মানব পাচারকারীদের শনাক্তকরণের কাজ প্রশাসনের পক্ষ থেকে করা হচ্ছে। গ্রামের নিরীহ ও সহজ-সরল যুবকদের স্বপ্ন দেখিয়ে অবৈধভাবে যারা বিদেশে পাচার করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সম্পর্কিত খবর

মূল্যস্ফীতি কমে ৮.৪৮%, বেড়েছে জিডিপি প্রবৃদ্ধি
নিজস্ব প্রতিবেদক

বহুদিন ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছিল উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের অস্থিরতা। প্রায় তিন বছর ধরে মূল্যস্ফীতির লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের জীবনযাত্রা ব্যয় বেড়ে যায় ব্যাপকভাবে। তবে অবশেষে আশার আলো দেখা যাচ্ছে। সদ্য শেষ হওয়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুন মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে এসেছে ৮.৪৮ শতাংশে, যা গত ৩৩ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
গতকাল সোমবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত হালনাগাদ তথ্যে এই চিত্র উঠে এসেছে। ভোক্তা মূল্য সূচকের (সিপিআই) তথ্য অনুযায়ী, মে মাসে যেখানে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.০৫ শতাংশ, জুনে তা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।
মূল্যস্ফীতির এই পতন দেশের অর্থনীতিতে স্বস্তির বার্তা বয়ে আনলেও বাজারের বাস্তব চিত্র ভিন্ন।
খাদ্যমূল্য কিছুটা নিয়ন্ত্রণে
বিবিএসের ভোক্তা মূল্যসূচক অনুযায়ী, খাদ্য মূল্যস্ফীতি জুনে নেমে এসেছে ৭.৩৯ শতাংশে, যা মে মাসে ছিল ৮.৫৯ শতাংশ।
তবে বাজারের চিত্র বলছে ভিন্ন কথা। ঢাকার খুচরা বাজারে মিনিকেট চালের দাম বেড়ে ৮৫ থেকে ৯০ টাকা/কেজিতে পৌঁছেছে, যেখানে ঈদের আগে তা ছিল ৭২ থেকে ৮২ টাকা। মাঝারি মানের চাল ব্রি‑২৮ এখন বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৪ টাকা কেজি দরে, যা আগের তুলনায় তিন থেকে পাঁচ টাকা বেশি। এ ছাড়া বিভিন্ন সবজির দাম ৭০ থেকে ১৫০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করছে।
আয় বেড়েছে কম, ব্যয় বেড়েছে বেশি
মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জীবনে এক ধরনের ‘অদৃশ্য কর’-এর মতো। বিশেষ করে মজুরিনির্ভর মানুষের ওপর এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে। বিবিএসের তথ্য মতে, জুনে জাতীয় মজুরি হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮.১৮ শতাংশে, কিন্তু একই সময়ে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮.৪৮ শতাংশ। অর্থাৎ আয় বৃদ্ধির চেয়ে ব্যয় বৃদ্ধির হার বেশি হওয়ায় প্রকৃত আয় কমেছে।
প্রবৃদ্ধিতে ফিরছে গতি
মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি জিডিপি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রেও কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তনের আভাস মিলেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রাথমিক প্রাক্কলন অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) স্থির মূল্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৪.৮৬ শতাংশ, যা আগের প্রান্তিকে ছিল ৪.৪৮ শতাংশ।
তবে পুরো অর্থবছরের (জুলাই-মার্চ) প্রথম তিন প্রান্তিক মিলিয়ে গড় প্রবৃদ্ধি মাত্র ৩.৮১ শতাংশ। এই ধীরগতির প্রবৃদ্ধির বিষয়ে সতর্কবার্তা আগেই দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। বিশ্বব্যাংক ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি হবে ৩.৩ শতাংশ, আর এডিবির পূর্বাভাস অনুযায়ী এটি ৩.৯ শতাংশ।
প্রবৃদ্ধির খাতভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, তৃতীয় প্রান্তিকে কৃষি খাত কিছুটা উন্নতি করলেও গতি কমেছে শিল্প খাতে। কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২.৪২ শতাংশ, যা গত বছর একই সময়ে ছিল ৪ শতাংশ। শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৬.৯১ শতাংশে, যা আগের প্রান্তিকে ছিল ৭.১০ শতাংশ। সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি তুলনামূলক ভালো—৫.৮৮ শতাংশ, যা গত বছর ছিল ৪.৩১ শতাংশ। চলতি মূল্যে এই প্রান্তিকে জিডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ১৯ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১২ লাখ ৬৬ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারি পরিসংখ্যান বলছে মূল্যস্ফীতি কমেছে, প্রবৃদ্ধিও কিছুটা বাড়ছে। তবে বাজারে এর প্রতিফলন নেই। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এখনো ঊর্ধ্বমুখী, মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির নিচে, ফলে মানুষের বাস্তব আয়ে ঘাটতি রয়ে গেছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল
শেখ হাসিনা-কামালকে অব্যাহতির আরজি মামুনের বক্তব্য নেই
নিজস্ব প্রতিবেদক

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রাথমিক উপাদান (প্রাইমা ফেসিয়া) পাওয়া যায়নি বলে দাবি করেছেন রাষ্ট্র নিযু্ক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। মামলার অভিযোগ থেকে তাঁদের অব্যাহতি দেওয়ার আরজি জানান তিনি।
এ সময় আদালতে উপস্থিত আরেক আসামি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের আইনজীবী শুনানিতে অংশ নেননি এবং অভিযোগ থেকে তাঁর অব্যাহতিও চাওয়া হয়নি।
গতকাল সোমবার চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ অভিযোগ গঠনের শুনানি চলাকালে আমির হোসেন ওই আরজি তুলে ধরেন।
শুনানির পর ট্রাইব্যুনাল আগামী ১০ জুলাই আদেশের তারিখ ধার্য করেন। এর আগে গত ১ জুলাই মামলার ‘আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের’ ওপর শুনানি শেষ করে প্রসিকিউশন।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ ভিত্তিহীন : দাবি আইনজীবীর
অব্যাহতির আবেদনের শুনানিতে আমির হোসেন প্রসিকিউশনের অভিযোগ খণ্ডন করে বলেন, গত বছর ১৪ জুলাই গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনকারীদের রাজাকারের বাচ্চা বা রাজাকারের নাতি-পুতি বলে উসকানিমূলক কোনো বক্তব্য দেননি। মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে তিনি এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন। সেই জবাবেও তিনি আন্দোলনকারীদের রাজাকারের বাচ্চা বা রাজাকারের নাতি-পুতি বলেননি।
আন্দোলনে নিহতদের মৃত্যু সনদে মৃত্যুর সঠিক কারণ লিখতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, মৃতদেহ হস্তান্তর না করে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে গণদাফন, লাশ গুম করে ফেলার নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ভিত্তিহীন ও মনগড়া বলে উল্লেখ করেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী। তিনি বলেন, এসব অভিযোগের দালিলিক কোনো প্রমাণ নেই। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এসব অভিযোগ আনা হয়েছে তাঁদের হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য।
আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের শুনানিতে প্রসিকিউশন বলেছিল, জুলাই গণ-আন্দোলন চলার সময় বিটিভি ভবন, মেট্রো রেলসহ কেপিআইভুক্ত (কি পয়েন্ট ইনস্টলেশন) স্থাপনায় হামলা চালিয়ে তার দায় আন্দোলনকারীদের ওপর চাপানো হয়েছে। এই অভিযোগও অস্বীকার করেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন।
কোটা সংস্কার আন্দোলন চলার সময় গত বছর ১৬ জুলাই রংপুরে গুলিতে শহীদ হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। এই হত্যাকাণ্ডে শেখ হাসিনাসহ আসামিদের বিরুদ্ধ প্ররোচনা, সহায়তা ও ষড়যন্ত্রের যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা অস্বীকার করে আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শহীদ আবু সাঈদের মা-বাবা, ভাই-বোনদের গণভবনে এনে সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন। আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছেন। ফলে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ ভিত্তিহীন।
গণ-অভ্যুত্থানে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে এই আইনজীবী বলেন, আন্দোলনের সময় পুলিশ মানুষের জানমাল রক্ষার স্বার্থে দায়িত্ব পালন করেছে। তিনি বলেন, দেশে-বিদেশে বিভিন্ন আন্দোলনে বহু মানুষ হতাহত হওয়ার নজির আছে। কিন্তু এর জন্য মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে কোনো দেশ বিচার করেছে—এমন নজিরও নেই।
জুলাই গণ-আন্দোলনে আসামিদের বিরুদ্ধে পদ্ধতিগত হত্যাকাণ্ডের যে অভিযোগ আনা হয়েছে, সেটিকে মিথ্যা দাবি করে আমির হোসেন বলেন, গণ-আন্দোলনের সময় এবং সরকার পতনের পরে দেশের বিভিন্ন থানায় হামলা চালানো হয়েছে, থানা লুট করা হয়েছে। এমনকি পুলিশ হত্যা করা হয়েছে। ফলে পদ্ধতিগত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও মনগড়া। পরে তিনি অভিযোগ থেকে তাঁদের (শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল) অব্যাহতি দেওয়ার আরজি জানান।
ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনে গত বছর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। ১৪ আগস্ট সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ দাখিল করা হয়। তদন্ত শুরু হয় গত বছর ১৪ অক্টোবর। ছয় মাস ২৮ দিনে তদন্ত শেষে গত ১২ মে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। আসামিদের বিরুদ্ধে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপন্সিবিলিটি বা ঊর্ধ্বতনের নির্দেশনার দায়সহ হত্যা, হত্যাচেষ্টা, ব্যপক মাত্রায় পদ্ধতিগত হত্যা, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, ষড়যন্ত্রসহ অন্যান্য অমানবিক আচরণ, সংঘটিত অপরাধ প্রতিরোধ না করার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়। গত ১ জুন প্রসিকিউশন ‘আনুষ্ঠানিক অভিযোগ’ দাখিল করলে তা আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল।

মানবতাবিরোধী অপরাধ
চলতি বছর শেষ হতে পারে ৪ মামলার বিচার
মেহেদী হাসান পিয়াস

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে যেসব মামলা হয়েছে, এর মধ্যে অন্তত চারটি মামলার বিচারকাজ চলতি বছর শেষ হতে পারে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়। চারটি মামলার অভিযোগই আমলে নিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। এখন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের পর্যায়ে রয়েছে। তবে মামলার তদন্ত ও বিচারে সময় নিয়ে হতাশা ও ক্ষোভ রয়েছে ভুক্তভোগী এবং শহীদ পরিবারের সদস্যদের।
চার মামলায়ই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আসামি করা হয়েছে। তিনিসহ এই চার মামলায় মোট আসামি ৫৭ জন। তাঁদের মধ্যে পলাতক ৪১ জন। গ্রেপ্তার করে কারাগারে রাখা হয়েছে ১৬ জনকে।
এ ব্যাপারে প্রসিকিউটর গাজী মনোয়ার হোসেন তামিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চারটি মামলা আনুষ্ঠনিক অভিযোগ গঠনের পর্যায়ে রয়েছে। তার মধ্যে দুটি মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানি শেষ হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ গঠন করলে বিচার হবে। অভিযোগ থেকে আসামিদের অব্যাহতি দিলে মামলা ওইখানেই শেষ।
বিচারিক প্রক্রিয়া নিয়ে আইনি বিধান তুলে ধরে এই প্রসিকিউটর বলেন, ‘আইনে আছে, অভিযোগ গঠনের পর বিচার শুরু হলে তা চলবে বিরতিহীনভাবে। কোনো পক্ষ মুলতবির আবেদন করতে পারবে না।
নিয়ম অনুযায়ী, প্রথমে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয় বা তদন্ত সংস্থায় লিখিত অভিযোগ দিতে হয়। অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেলে মামলা হিসেবে তা নথিভুক্ত করে তদন্ত সংস্থা। এরপর অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়। তদন্ত শেষে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় তদন্ত সংস্থা। চিফ প্রসিকিউটর সেই তদন্ত প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই, পর্যালোচনা করে ফরমাল চার্জ বা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ হিসেবে তা ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেন। পরে এই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গ্রহণ করে তা আমলে নিতে ট্রাইব্যুনালের কাছে আবেদন করেন চিফ প্রসিকিউটর। অভিযোগ আমলে নেওয়া হলে আসামিদের বিরুদ্ধে ‘আনুষ্ঠানিক অভিযোগ’ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। যে চার মামলার অভিযোগ আমলে নিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল মানবতাবিরোধী অন্যান্য অপরাধের পাশাপাশি গণ-অভ্যুত্থান চলার সময় পরিকল্পিতভাবে ড্রোন, হেলিকপ্টার, প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের পদ্ধতিগতভাবে নির্মূলের অভিযোগ রয়েছে একটি মামলায়। মামলাটি ঊর্ধ্বতনের নির্দেশে দায় বা ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপন্সিবিলিটির মামলা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন এই মামলার আসামি। তাঁদের মধ্যে আবদুল্লাহ আল মামুনকে গ্রেপ্তারের পর আদালতের নির্দেশে কারাগারে রাখা হয়েছে। অন্য দুজন পলাতক। এ মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের ওপর উভয় পক্ষের শুনানি শেষ হয়েছে। আগামী ১০ জুলাই আদেশের দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল। ঘটনা ও অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় বাকি তিনটি মামলাও বেশ আলোচিত।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় মামলাটিকে ‘আবু সাঈদ হত্যা মামলা’ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। গত ৩০ জুন এই মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। আগামী ১০ জুলাই এ মামলায় পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে। এ মামলার ৩০ জন আসামির মধ্যে গ্রেপ্তার চারজন। বাকি ২৬ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
রাজধানীর চানখাঁরপুলে ছয় আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় মামলাটিকে বলা হচ্ছে ‘চানখাঁরপুল হত্যাকাণ্ড’ মামলা। সরকার পতনের আন্দোলন ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে অংশ নিতে ঢাকায় এসেছিলেন ছয় তরুণ। গত বছর ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় পুলিশ তাঁদের গুলি করে হত্যা করে। সেদিন শহীদ হন শাহরিয়ার খান আনাস, শহীদ শেখ মাহদি হাসান জুনায়েদ, শহীদ মো. ইয়াকুব, শহীদ মো. রাকিব হাওলাদার, শহীদ মো. ইসমামুল হক ও শহীদ মানিক মিয়া। এ ঘটনায় মামলা দায়েরের পর ছয় মাস ১৩ দিনে তদন্ত শেষ করে গত ২০ এপ্রিল প্রতিবেদন দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। এটিই ছিল জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার প্রথম তদন্ত প্রতিবেদন। গত ২৫ মে এই মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হলে ট্রাইব্যুনাল তা আমলে নেন। গত ৩ জুলাই এ মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের ওপর শুনানি শেষ হয়। আগামী ১৪ জুলাই এ বিষয়ে শুনানির তারিখ ধার্য করা রয়েছে। মামলার আট আসামির মধ্যে গ্রেপ্তার করে কারাগারে রাখা হয়েছে চারজনকে।
আশুলিয়ায় মৃতপ্রায় একজন ও পাঁচজনের লাশ পোড়ানোর মামলাটি ‘লাশ পোড়ানোর’ মামলা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। গত ১৯ জুন চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দেয় তদন্ত সংস্থা। গত ২ জুলাই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হলে সেদিনই তা আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। এ মামলার ১৬ জন আসামির মধ্যে ট্রাইব্যুনালে ১১ জনের নাম প্রকাশ করে প্রসিকিউশন। এই ১১ জনের মধ্যে আটজনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে রাখা হয়েছে।
প্রত্যাশার সঙ্গে আছে হতাশা
মামলার তদন্তকাজ নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করলেও বিচার নিয়ে আশাবাদী শহীদ আবু সাঈদের বড় ভাই আবু হোসেন। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা ছিল যে দ্রুত সময়ের মধ্যে আমরা এই বিচারটা দেখতে পাব এবং ন্যায়বিচার পাব। কিন্তু তদন্তেই দীর্ঘ সময় লাগল। তার পরও বলতে চাই, যারা আবু সাঈদ হত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত, তাদের সবার বিচার চাই। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে কাউকে যেন এ মামলায় যুক্ত না করা হয়।’
শেখ হাসিনার পতনের আগের দিন রাজধানীর মিরপুর-১০ নম্বরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয় দেশ পলিটেকনিক কলেজের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী শাহরিয়ার হাসান আলভীর। পরে ১৯ আগস্ট ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে শেখ হাসিনাসহ ২৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেন শহীদ আলভীর বাবা মো. আবুল হাসান। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘অভিযোগটি কী পর্যায়ে আছে, জানি না। গত সপ্তাহেও আমি প্রসিকিউশনে গিয়েছিলাম। গেলে শুধু একটা কথাই বলে, কাজ করছি, বিচার হবে। কিন্তু আদৌ বিচার হবে কি না—জানি না। আসামিরা এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এতে আমরা হতাশায় ভুগছি।’
মামলার বাদী এবং শহীদ পরিবারগুলোর জন্যও বিশেষ নিরাপত্তার দাবি জানান আবুল হাসান।
প্রসিকিউশনের তথ্য অনুযায়ী, এই অভ্যুত্থানের সময় দেশজুড়ে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ট্রাইব্যুনালে ২৭টি পর্যন্ত মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২০৬ জনকে আসামি করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার এসএসসির ফল প্রকাশের প্রস্তাব
নিজস্ব প্রতিবেদক

আগামী ১০ জুলাই বৃহস্পতিবার এ বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশের প্রস্তাব করেছে আন্ত শিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটি। এরই মধ্যে এই প্রস্তাব শিক্ষা মন্ত্রণালয় হয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে সম্মতি পেলে ফল প্রকাশ করা হবে।
আন্ত শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কমিটির আহবায়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগামী ১০ জুলাই এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশের প্রস্তাব করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, সাধারণত পরীক্ষা শেষ হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে ফলাফল প্রকাশ করা হয়ে থাকে। গত ১০ এপ্রিল সারা দেশে একযোগে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়।
জানা গেছে, এ বছর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় মোট শিক্ষার্থী ছিল ১৯ লাখ ২৮ হাজার ১৮১ জন। এর মধ্যে সাধারণ ৯টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে ১৪ লাখ ৯০ হাজার ১৪২ জন। অন্যদিকে মাদরাসা বোর্ডের অধীন দাখিল পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে দুই লাখ ৯৪ হাজার ৭২৬ জন। আর কারিগরি বোর্ডের অধীনে পরীক্ষার্থী ছিল এক লাখ ৪৩ হাজার ৩১৩ জন।