বিএনপির স্থানীয় বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী এসে ভাঙচুর ও লুটপাটে বাধা দিলে তা না মেনে হামলাকারীরা ভাঙচুর ও লুটপাট চালাতেই থাকে। এক পর্যায়ে রাত সাড়ে ৯টার দিকে কারখানার ভেতরের ছয়তলা ভবনে প্রবেশ করে কয়েক শ লোক।
ভবনে কেমিক্যাল ও টায়ার তৈরির কাঁচামাল ছিল। ভবনের ভেতরে লুটপাট নিয়ে দুটি পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি ও মারপিটের ঘটনা ঘটে। এ সময় একটি পক্ষ ভবন ত্যাগ করে বাইরে থেকে কারখানার গেট বন্ধ করে দেয়। এতে ভেতরে কয়েক শ লোক আটকা পড়ে।
এক পর্যায়ে পুরো ভবনে আগুন লেগে যায়। আগুনের লেলিহান শিখা ৬০ থেকে ৮০ ফুট উঁচুতে পর্যন্ত ওঠে। ভবনের ভেতরে আটকা পড়া অনেকেই স্বজনদের ফোন করে বাঁচানোর জন্য আকুতি জানান বলে বেশ কয়েকজন স্বজন দাবি করেছে।
খবর পেয়ে ঢাকার ফুলবাড়িয়া ফায়ার সার্ভিস, ডেমরা ফায়ার সার্ভিস, কাঞ্চন ফায়ার সার্ভিস, আড়াইহাজার ফায়ার সার্ভিসসহ ১২টি ইউনিট রাত থেকে আগুন নেভানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। গতকাল রাত ৯টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
ভবনে প্রবেশ করে নিখোঁজ হয়েছেন—এমন ব্যক্তির খোঁজে গাজী টায়ার কারখানায় ভিড় করে স্বজনরা। গতকাল রাত পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের কাছে ১৭৬ জন নিখোঁজ ব্যক্তির তালিকা দিয়েছে স্বজনরা। বেশির ভাগ নিখোঁজ ব্যক্তির বাড়ি উপজেলার মৈকুলী, রূপসী কাজীপাড়া, ছাতিয়ান, মুগরাকুল, কাহিনা, বরপা, মাসাবো, তারাব, বরাব, চনপাড়া, মুড়াপাড়াসহ আশপাশের এলাকার।
রাব্বি নামের ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মী সকাল থেকে নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকার কাজ করেন। তাঁর দেওয়া তথ্য মতে, সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৭৬ জন নিখোঁজের তালিকা ছিল। নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা এই তালিকা করায়।
গতকাল সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, কারখানার ভেতর দুটি ভবনে আগুন জ্বলছে। প্রধান ফটকের বাইরে সকাল থেকে নিখোঁজ স্বজনদের ভিড় জমতে থাকে। সন্ধ্যার দিকে কারখানার সামনে শত শত নারী-পুরুষ আহাজারি করতে থাকে।
এ সময় শুভ মিয়া নামের একজন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঘটনার রাতে (রবিবার) মালপত্র লুটপাট করা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ সময় একটি পক্ষ কারখানার ভেতরে থাকলে আরেকটি পক্ষ বের হয়ে বাইরে থেকে গেট বন্ধ করে দেয়। এক পর্যায়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আমি ছাদে উঠে রশি বেয়ে নিচে নেমে আসি। পরে কী হয়েছে, তা জানি না।’
খাদুন এলাকার কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী বলে, রবিবার রাতে মালপত্র লুট করা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। এ সময় তিনটি গুলি ছোড়া হয়। কয়েকজনকে কুপিয়ে আহত করা হয়। রাতে কারখানার ভেতরে চিৎকার শুনেছি। কিন্তু আমরা মনে করেছি হয়তো লুটপাট করতে গিয়ে চেঁচামেচি করছে। এতে আমরা সামনে যাইনি।
বরপা এলাকার ইকবাল হোসেন বলেন, “আমার বন্ধু আলী আসাদ, আবু সাঈদ, স্বপন খান, শাহিনসহ পাঁচজন নিখোঁজ রয়েছে। তারা কারখানার ওই ভবনে রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঢুকে আর বের হয়নি। মোবাইল ফোনে রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত কথা হয়েছে। তখন বলেছে, ‘আমরা ভবনে আটকা পড়েছি। আমাদের বাঁচান।’ এরপর আর ফোনে পাওয়া যায়নি।”
কোনাপাড়া এলাকার রাবেয়া খাতুন বলেন, ‘মেয়ের জামাই হযরত আলী গাজী টায়ার কারখানায় মালপত্র নিতে আসে। এখন আর তার খোঁজ পাচ্ছি না। শুনছি আগুন লাগছে যে ভবনে, সেখানে আটকা পড়েছে।’
ভয়াবহ এই আগুনে কারখানার আশপাশের মার্কেট, হাটবাজার, শিল্প-কলকারখানা এবং এলাকাবাসী চরম আতঙ্কে রয়েছে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে উপজেলা প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও বিএনপি নেতারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (প্রশিক্ষক) রেজাউল করিম বলেন, ‘আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এখনো আগুন নিয়ন্ত্রণে আসেনি। নিখোঁজ ব্যক্তিদের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। আগুন নেভানোর পর নিখোঁজদের ব্যাপারে বলা যাবে। বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত স্বজনরা আমাদের কাছে ১৭৬ জন নিখোঁজের তালিকা দিয়েছে।’
বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য কাজী মনিরুজ্জামান মনির বলেন, ‘দলীয় নাম ভাঙিয়ে কেউ অপরাধ করলে সাংগঠনিকভাবে দল থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গাজী সাহেব অপরাধ করলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী তাঁর বিচার করা হবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের রুটি-রোজগারের জায়গা এই কারখানা। কারখানা ধ্বংস করলে এখানে কর্মরত ২০ থেকে ২৫ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী কোথায় যাবেন?’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আহসান মাহমুদ রাসেল বলেন, কেউ কোনো প্রকার অরাজকতা, লুটপাট, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী তাত্ক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেবে। প্রচলিত আইনে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।