প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল সংক্রান্ত সরকারি পরিপত্র জারি অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করে দেওয়া উচ্চ আদালতের পুরো রায় বাতিল চাইবে সরকার। অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন গতকাল শনিবার সাংবাদিকদের এ কথা জানান। আজ রবিবার সকাল ১০টায় কারফিউয়ের মধ্যেই আপিল আদালত বসবেন।
অন্যদিকে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর তিনজন সমন্বয়ক গত শুক্রবার রাতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত তিনজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে এক সংক্ষিপ্ত বৈঠকে তাঁদের আট দফা দাবি জানিয়েছেন।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, সরকার শিক্ষার্থীদের দাবি নীতিগতভাবে মেনে নিয়েছে। আপিল বিভাগের শুনানির সময় সরকারপক্ষ কোটার ভিত্তিতে ২০ শতাংশ এবং মেধার ভিত্তিতে ৮০ শতাংশ প্রার্থী নিয়োগ দেওয়ার জন্য প্রস্তাব তুলে ধরবে।
প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরির কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে সরকার যে পরিপত্র জারি করেছিল, গত ৫ জুন সেই পরিপত্র অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করে রায় দেন উচ্চ আদালত। এ রায়ের পর কোটা সংস্কারের আন্দোলনে নামেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীরা।
প্রথমে কিছুদিন অবস্থান কর্মসূচি পালন করলেও পরে আন্দোলনকারীরা অবরোধের মতো কর্মসূচি পালন করেন। চলমান আন্দোলনের মধ্যে হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী। গত ৯ জুলাই সে আবেদনে শুনানির পর কোটাসংক্রান্ত বিষয়বস্তুর ওপর স্থিতাবস্থা জারি করেন সর্বোচ্চ আদালত। প্রধান বিচারপতি সেদিন আন্দোলনকারীদের আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে এসে বক্তব্য উপস্থাপনেরও আহবান জানান। সে আহবান উপেক্ষা করে আন্দোলনকারীরা আন্দোলন চালিয়ে আসছিলেন। গত ১৬ জুলাই চলমান আন্দোলন সংঘাতে রূপ নেয়। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের সংঘাতে ওই দিন ছয়জন প্রাণ হারান। এমন পরিস্থিতিতে গত বুধবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই ভাষণে প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনকারীদের আশ্বস্ত করে সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ বা রায় পর্যন্ত অপেক্ষার আহবান জানান। একই সঙ্গে সহিংসতা এবং প্রাণহানির ঘটনা তদন্তে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের প্রতিশ্রুতি দেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এদিকে সরকারি চাকরিতে অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ কোটা রেখে বাকিটা মেধার ভিত্তিতে করার দাবি জানিয়েছেন ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর নেতারা। গত শুক্রবার রাতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত তিনজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে এক সংক্ষিপ্ত বৈঠকে আট দফা দাবি জানান কোটা আন্দোলনের তিনজন সমন্বয়ক। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী ও তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত।
বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের পক্ষে অংশ নেন তিনজন সমন্বয়ক—হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলম ও হাসিব বিন ইসলাম।
শিক্ষার্থীদের প্রধান দাবিগুলো হচ্ছে তদন্ত সাপেক্ষে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করে তাঁদের গ্রেপ্তার এবং দ্রুত সময়ে বিচার করতে হবে। শহীদ ভাইদের পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা, মাসিক ভাতা ও মা-বাবার মতামতের ভিত্তিতে একজন সদস্যকে চাকরির নিশ্চয়তা দিতে হবে। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে প্রশাসনিকভাবে সিট বরাদ্দ দিতে হবে, সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে এবং ছাত্রসংসদ চালু করতে হবে। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে করা সব মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত সব শিক্ষার্থীকে সব ধরনের রাজনৈতিক, আইনি বা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন কর্তৃক একাডেমিক হয়রানি না করার নিশ্চয়তা দিতে হবে। হামলার নির্দেশনার জন্য দায়ী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে তদন্ত সাপেক্ষে বিচারের আওতায় আনতে হবে। সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে অপসারণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে আবাসিক হলগুলো খুলে দিতে হবে।
বৈঠক শেষে শিক্ষার্থীরা সাংবাদিকদের বলেন, কর্মসূচি জানানোর জন্য আমাদের মাধ্যম ছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। কারফিউ জারি হওয়ায় সারা দেশের প্রতি আমাদের যে বার্তাটি রয়েছে, তা স্পষ্ট করা উচিত বলে মনে করি। এ ছাড়া তাঁরা কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহতদের জন্য দোয়া ও কালো ব্যাজ ধারণ কর্মসূচি ঘোষণা করেন, যা গতকাল শনিবার পালিত হয়েছে।
বৈঠক শেষে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা কোটার যে পরিমাণের কথা বলেছেন, সেটা আমরা দেখেছি। এটার একটা যৌক্তিক সমাধানে যাওয়া সম্ভব বলে আমরা মনে করি।’
সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লেখিত অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য কোটাকে ন্যূনতম ৫ শতাংশে এনে সংসদে আইন পাস করতে হবে মর্মে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় ভুল তথ্য বা বিভ্রান্তি ছড়ানো বন্ধে এবং দেশজুড়ে চলমান অস্থিতিশীলতা নিরসনে শিক্ষার্থীরা তাঁদের দাবি জানানোর সিদ্ধান্ত নেন। এ ছাড়া দেশজুড়ে সংঘটিত ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তাঁদের আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক নেই এবং এর দায়ভার তাঁরা নেবেন না বলে জানিয়েছেন। এই দাবিগুলো জানানোর মাধ্যমে আলোচনার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে বলেও মনে করেন শিক্ষার্থীরা।