সরকারের আয়ের ক্ষেত্রে যেমন ত্রুটি আছে, তেমনই ব্যয়ের ক্ষেত্রেও ত্রুটি রয়েছে। দেশে সুশাসনের অভাবে দুর্নীতি, অর্থপাচার, মূল্যস্ফীতিসহ সামষ্টিক অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হচ্ছে। দেশে সুশাসন নিশ্চিত হলে ৯০ শতাংশ সমস্যা দূর হবে।
গতকাল বুধবার রাজধানীর একটি হোটেলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত বাজেট সংলাপে অংশ নিয়ে এমন নানা উদ্বেগের কথা জানিয়ে সুশাসন নিশ্চিত করতে বলেছেন অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিবিদরা।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সিপিডির বোর্ড ট্রাস্টিজের কোষাধ্যক্ষ সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী।
অনুষ্ঠানে সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, ‘আমার রাজনৈতিক জীবনে বর্তমান সময়ের মতো অর্থনীতিতে এতটা দুর্বল পজিশন কখনো দেখিনি। এখন আইএমএফ এসে বলছে। যদিও আমরা আরো কয়েক বছর আগে থেকে এসব সমস্যা সমাধানের কথা বলে এসেছি।
’
১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘চুরি, ডাকাতি, মার্ডার করে আয় করা টাকা অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে না। তারা কি চুরির টাকা দেশের উন্নয়নে আনবে? আমি যদি কর না দিয়ে পরের বছর ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ পাই, তাহলে কেন কর দেব? আমরা শুনছি কানাডা, মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশে কারো কারো বাড়ি আছে, সেই লিস্ট করা হয়। তাদের চিহ্নিত করে ধরা হচ্ছে না কেন?’
বিরোধীদলীয় উপনেতা বলেন, ‘ব্যাংক খাতে ২০১৮ সালে ছিল ৫৮ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ। আর সব হিসাব করলে সেটি সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা।
এই টাকা উদ্ধারে তেমন কিছুই করা হচ্ছে না। অথচ যারা পরিশোধ করছে, করার চেষ্টা করছে—তাদেরই ধরা হচ্ছে।’
এই মুহূর্তে কিছু মেগাপ্রকল্প পিছিয়ে দেওয়া যেত উল্লেখ করে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী ও বর্তমানে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এম এ মান্নান বলেন, ‘আমরা বাস করি ভূতলে কিন্তু বিনিয়োগ করি পাতালে। আমি মন্ত্রী থাকতে এমন অনেক প্রকল্প একনেকে পাস করতে হয়েছে, যেগুলোর সঙ্গে আমি একমত ছিলাম না। দেশে এমন অনেক প্রকল্প রয়েছে।
জনগণ এসব থেকে কী পাচ্ছে কিংবা আদৌ পাচ্ছে কি না, তা দেখা দরকার।’
সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী আরো বলেন, ‘এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জনগণ সূক্ষ্ম সুশাসন, গণতন্ত্র চায় না। তারা চায় আরো ভালো পানি, আরো ভালো রাস্তা, আরো বেশি স্কুল। গ্রামের দরিদ্র শ্রেণির ভোটাররা টিউবওয়েল, ল্যাট্রিন চায়, ছেলে-মেয়েদের জন্য উপবৃত্তি চায়। এই যখন বাস্তবতা, তখন বিরোধী দলের ভাইয়েরা বলছেন, দেশে গণতন্ত্র নেই, সে কারণে তাঁরা আসতে পারছেন না। এটা বলে তাঁরা জাতির প্রতি দায়িত্বে অবহেলা করছেন।’
মূল্যস্ফীতি নিয়ে সমালোচনার জবাবে এম এ মান্নান বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি প্রবৃদ্ধিরই একটি ফল। মূল্যস্ফীতি যেমন হচ্ছে, তেমনি বেতনও বাড়ছে। তার মানে ছোবলটা একটু কমছে। কার্ডে সাশ্রয়ী মূল্যে ও কাজের বিনিময়ে খাদ্য দিয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ নিম্ন আয়ের মানুষকে টার্গেট করে সহায়তা দিচ্ছি। যদি নিম্ন আয়ের মানুষদের টার্গেট করে ব্যবস্থা না নিতাম, তাহলে মূল্যস্ফীতি ১৫-১৬ শতাংশ হয়ে যেত।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘দেশের পরিশ্রমী উদ্যোক্তারা সোনার ডিম পাড়া হাঁস। কিন্তু এসব হাঁস জবাই করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। ব্যবসার পরিবেশ তাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু লাল ফিতার দৌরাত্ম্য এখনো প্রবলভাবে বিদ্যমান। তাই দেশের সম্ভাবনা এখন রাজনৈতিক অর্থনীতির লৌহ ত্রিভুজে আটকে আছে।’
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, আগামী অর্থবছরের (২০২৪-২৫) প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে দুই লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এ ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হবে এক লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যা মোট ঘাটতির ৫৩.৭১ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে এটি একটি অসামঞ্জস্য প্রাক্কলন। এটি অর্জনযোগ্য নয়। এই ঘাটতি ঋণ নেওয়া হলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ব্যাহত হবে।
অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য দেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি কাজী নাবিল আহমেদ, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন ও বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ।