<p>মর্জিনার সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার যখন কথা হচ্ছিল তখন তিনি ছাত্র পড়াচ্ছিলেন। বললেন, ‘ভাই, ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছি। ইফতারের পর আপনাকে কল দেব।’ ইফতারের কিছুক্ষণ পর আবার কল দিলাম। মুঠোফোনের ও-প্রান্ত থেকে সেলাই মেশিন চলার শব্দ শোনা গেল। জিজ্ঞেস করে জানলাম, অর্ডারের ফ্রক বানাচ্ছেন মর্জিনা। দিনের মধ্যেই ফ্রকটা রেডি করে দিতে হবে। এই কাজটা শেষ হলে একটু অবসর মিলবে!</p> <p>আদতে সে অর্থে ‘অবসর’ শব্দটাই নেই মর্জিনা খাতুনের অভিধানে। শৈশব থেকেই টিকে থাকার লড়াই শুরু করেছেন, যে সংগ্রাম আজও থামেনি। পায়ে জোর না থাকলেও মনের জোরে ডিগ্রি পাস করেছেন। সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়ে ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে সাহায্য করেছেন পাঁচ হাজার গ্রামীণ নারীকে। কিন্তু এখানেই থেমে যেতে চান না। যেতে চান আরো অনেকদূর।</p> <p> </p> <p><strong>শক্তিহীন পা</strong></p> <p>পাবনার বেড়া উপজেলার কৈটোলা ইউনিয়নের জয়নগর গ্রামের দরিদ্র মুনতাজ মণ্ডলের মেয়ে মর্জিনা। পরিবারে তিন বোন এক ভাই। বোনদের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। ২০২২ সালে বাবাকে হারিয়েছেন। একমাত্র ভাই মতিউর বাসচালক।</p> <p>আর ১০ জন শিশুর মতোই বেড়ে উঠছিলেন ছোট্ট মর্জিনা। তিন কি চার বছর বয়সে হঠাত্ একবার জ্বরে পড়লেন। সেরে ওঠার পর মর্জিনার মা দেখলেন, মেয়ে আর পায়ে শক্তি পাচ্ছে না! দুই পা হাঁটুর নিচ থেকে যেন শুকিয়েও আসছিল। ডাক্তার-কবিরাজ কম করেননি। কিছুতেই কিছু হলো না। চিকিত্সকরা দেশের বাইরে নিয়ে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু ভাঙ্গারির দোকানি তিনবার নদী ভাঙনের শিকার মুনতাজের সংসার চালানোই দায়; মেয়েকে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নেওয়ার বিষয়টি কল্পনার চৌহদ্দিতেও ঘেঁষতে পারেনি। ফলে মর্জিনার বয়স বেড়েছে। কিন্তু সেই জ্বরের পর আর কখনো দুটি পায়ে ভর করে হাঁটা হয়নি তাঁর।</p> <p>আক্ষরিক অর্থে পায়ে ভর দিয়ে না হাঁটলেও শারীরিক প্রতিবন্ধকতা উতরে ‘নিজের পায়ে দাঁড়াতে’ চেয়েছেন অদম্য এই তরুণী। </p> <p> </p> <p><strong>হামাগুড়ি দিয়েই পড়াশোনা</strong></p> <p>২৩ নম্বর মাছখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মর্জিনার প্রথম স্কুল। বাড়ি থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে এ বিদ্যালয়ে হামাগুড়ি দিয়েই যাওয়া-আসা করতেন। এ কারণে অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি সময় লেগে যেত। বাড়ি ফিরে দিনের পড়া দিনেই শেষ করতেন। প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ভর্তি হন কৈটোলা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে। বাড়ি থেকে সে স্কুলের দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার। বেশির ভাগ সময় স্কুল ছুটির পর রিকশা মিলত না। সহপাঠীরা চলে গেলেও রিকশার অপেক্ষায় দীর্ঘক্ষণ একা একা বসে থাকতে হতো মর্জিনাকে। ছোটবেলায় হামাগুড়ি দিয়ে স্কুলে যাচ্ছে দেখে প্রতিবেশীদের কেউ কেউ কটুবাক্য শোনাত—‘এই মেয়ে পড়ালেখা করে কী করবে?, ভিক্ষা করলেই বরং ভালো হবে।’ এসব শুনে মন খারাপ হয়ে যেত। নীরবে চোখের জল ফেলতেন। তবে দমে যাননি। নিজেকে সান্ত্বনা দিতেন—একদিন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারলে সব ঠিক হয়ে যাবে।</p> <p>এই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর প্রথম পদক্ষেপ ছিল টিউশনি। তখন মর্জিনা সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। প্রথমবার তিনটি শিশুকে পড়ালেন। মাসে ১০০ টাকা করে পেতেন। যত্ন করে পড়ান দেখে ধীরে ধীরে তার শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে লাগল। একসময় ব্যাচ করে পড়ানো শুরু করলেন। টিউশনির টাকায় নিজের পড়ালেখার খরচ জোগাতেন। এভাবে ছোটবেলা থেকেই স্বাবলম্বী হওয়ার চর্চা চলে তাঁর।</p> <p> </p> <p><strong>নিজে শিখলেন সেলাই, শেখালেনও</strong></p> <p>মর্জিনা তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। নদীভাঙনে বসতভিটা হারিয়ে তাঁরা নানার বাড়িতে থেকেছেন। সেখানে এক এনজিওকর্মী এসেছিলেন গ্রামের নারীদের সেলাই শেখাতে। প্রশিক্ষণার্থী মর্জিনার খালাসহ আশপাশের নারীরা। বসে বসে মনোযোগ দিয়ে প্রশিক্ষণ দেখতেন কিশোরী মর্জিনা। তাঁরও খুব ইচ্ছা করত সেলাই মেশিন চালানো শিখতে। কিন্তু প্রশিক্ষকরা পাত্তা দিতেন না। সবাই বলতেন, ‘তোর পা তো অচল। তুই মেশিন চালাবি কিভাবে?’</p> <p>সেলাই মেশিনগুলো নানা বাড়িতেই থাকত। সবাই চলে যাওয়ার পর লুকিয়ে মেশিন চালানোর চেষ্টা করতেন মর্জিনা। কয়েক দিন চেষ্টার পর দেখলেন— কষ্ট হলেও মেশিন ঘোরাতে পারছেন! পরদিন প্রশিক্ষককে মর্জিনা বললেন, ‘দাদা, আমি মেশিন চালাতে পারি!’ বিশ্বাস করতে না পেরে প্রশিক্ষক চালিয়ে দেখাতে বললেন। ঠিকই মেশিন চালিয়ে তাঁকে দেখালেন মর্জিনা। মর্জিনার নাম উঠে গেল প্রশিক্ষণার্থীর খাতায়।</p> <p>মাত্র ১৭ দিনের মাথায় পুরোদমে সেলাইয়ের কাজ শিখে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেন মর্জিনা। কিছুদিন পরই বাবার কাছে আবদার করে আদায় করল নিজের সেলাই মেশিন। প্রথমবার বাচ্চাদের একটা ফ্রক সেলাই করে ৩০ টাকা পেলেন। ধীরে ধীরে গ্রামের লোকজনের নতুন-পুরনো জামা-কাপড় সেলাই করে দিতেন। বছরখানেকের মাথায় তাঁদের গ্রামে আবার সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ দিতে এক নারী প্রশিক্ষক এলেন। তাঁর কাজ দেখে মর্জিনা ভাবত, ‘আমিও যদি অন্য মেয়েদের শেখাতে পারতাম!’ সেই নারী প্রশিক্ষক মর্জিনার ইচ্ছার কথা শুনে খুশিই হলেন। মাসখানেক ধরে তাঁকে একেবারে হাতে-কলমে সব শিখিয়ে দিলেন।</p> <p> </p> <p><strong>পথ দেখালেন তিনি</strong></p> <p>মর্জিনা এবার চাইলেন নিজেই গ্রামের অন্য নারীদের ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে। প্রথমে তিন ছাত্রীকে সেলাইয়ের কাজ শেখালেন। ধীরে ধীরে সংখ্যাটা বাড়ল। গত কয়েক বছরে সেটা গিয়ে ঠেকল প্রায় পাঁচ হাজারে। প্রশিক্ষণ ফি হিসেবে জনপ্রতি ৫০০ টাকা করে নেয়। একেবারে সামর্থ্যহীনদের বিনা পয়সায় শেখান। মর্জিনা বললেন, ‘শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয় করে কর্মজীবী হয়েছি। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রায় পাঁচ হাজার নারীকে স্বাবলম্বী করেছি।’</p> <p>মর্জিনার কাছে সেলাই প্রশিক্ষণ নেওয়া বন্যা খাতুন (২২) জানালেন, ‘মর্জিনা আপা খুব যত্ন করে শেখান। সেলাই শিখে আমি এখন স্বাবলম্বী।’ আরেক প্রশিক্ষণার্থী নাজরিন খাতুন (২০) বলেন, ‘কাজ শিখে আয় করে নিজের খরচ নিজেই মেটাতে পারছি।’</p> <p>কাজ শেখানোর পাশাপাশি নিজের পড়াশোনাও চালিয়ে গেছেন মর্জিনা। কাশীনাথপুর মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাসের পর ভর্তি হয়েছিলেন বেড়া মঞ্জুর কাদের ডিগ্রি কলেজে। শত প্রতিকূলতাকে জয় করে সেখান থেকে ডিগ্রি (অনার্স) পাস করেছেন।</p> <p> </p> <p><strong>আক্ষেপ রয়ে গেছে</strong></p> <p>মর্জিনা সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৬ সালে অ্যাকশনএইড থেকে পেয়েছেন ‘দশম নাসরিন স্মৃতিপদক’। তবু আক্ষেপ রয়েছে তাঁর। সরকারি চাকরি করে নিজের স্থায়ী একটা অবলম্বন চেয়েছিলেন। সেই স্বপ্ন এখনো অধরা। আক্ষেপের সুরে বললেন, ‘কষ্ট করে এতদূর পড়েছি। চাকরির জন্য অনেকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি। কিন্তু কেউ ফিরেও তাকায়নি।’</p> <p> </p> <p><strong>জনপ্রতিনিধি, প্রশাসকের আশ্বাস</strong></p> <p>কৈটোলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মহশীন উদ্দিন বলেছেন, ‘মর্জিনা সহজে কারো কাছে হাত পাতে না। কঠোর সংগ্রাম করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে যে ধরনের সহযোগিতা দরকার করব।’</p> <p>পাবনা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক রাশেদুল কবির বলেন, ‘মর্জিনার সংগ্রামের কথা জেনেছি। উপজেলা সমাজসেবা অফিস থেকে তাঁকে সব ধরনের সহায়তা করা হবে।’</p> <p>বেড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোরশেদুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয় করে এগিয়ে যাওয়ার উজ্জ্বল উদাহরণ মর্জিনা। তাঁর উদ্যোক্তা হওয়া বা চাকরির বিষয়ে উপজেলা প্রশাসন যথাসাধ্য সহযোগিতা করবে।’</p>