আপনারা, এনইউজিও চান জান্তার পতন হোক। আরাকান আর্মির মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর যুদ্ধে আপনারা প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা দিচ্ছেন কি না?
অং কিয়াউ মো : সমন্বিত আক্রমণ বা যুদ্ধ কিন্তু মিয়ানমারজুড়েই চলছে। জান্তার বিরুদ্ধে সবাই লড়ছে। এখানে আমরা বাইরে থেকে বিশেষ কোনো সমর্থন বা সহযোগিতা দিচ্ছি না। বিদ্রোহী বা বিপ্লবী শক্তিগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সংগঠনগুলো জনগণকে সঙ্গে নিয়ে নিজস্ব সম্পদ দিয়েই লড়াই চালাচ্ছে। দৃশ্যত তাদের অস্ত্রসহ সামরিক সরঞ্জামের বড় অংশই এসেছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে। সামরিক বাহিনীর ব্যাটালিয়নগুলোর একের পর এক পতন ঘটছে। সেই অস্ত্র যাচ্ছে প্রতিপক্ষের কাছে। কৌশলগতভাবে জান্তা হেরে যাচ্ছে। তাই এখানে সশস্ত্র লড়াইয়ে বাইরের সমর্থন বা সহযোগিতার প্রয়োজন হচ্ছে না।
কালের কণ্ঠ : আপনি সম্প্রতি বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সঙ্গেও আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। বাংলাদেশের আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কি এনইউজির আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ শুরু হয়েছে?
অং কিয়াউ মো : আমরা জাতীয় ঐক্য সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন পরামর্শমূলক বৈঠক করেছি। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গেও আমরা কয়েকটি বৈঠক করেছি। রোহিঙ্গা ইস্যু জাতীয় ঐক্য সরকারের অগ্রাধিকারমূলক এজেন্ডা। জাতীয় ঐক্য সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে রোহিঙ্গা ইস্যুটি তদারকি করার দায়িত্ব আমার। সুতরাং রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমরা একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই এগোচ্ছি।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কি এনইউজির যোগাযোগ হচ্ছে?
অং কিয়াউ মো : বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আমাদের কোনো আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক নেই। কিন্তু আমরা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন লোকের সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যমে কথা বলছি। আমি বলব, আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য রোহিঙ্গা জনগণের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অনুকূল পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তন। মিয়ানমারে গণতন্ত্র থাকলেই শুধু এটি সম্ভব।
সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় রোহিঙ্গারা ফিরে গেলে তাদের প্রত্যাবাসন টেকসই হবে না। এই সামরিক বাহিনীই রোহিঙ্গাদের ওপর আন্তর্জাতিক অপরাধ করেছে। অপরাধগুলোতে জেনোসাইডের আলামত আছে বলে দাবি করা হয়।
কালের কণ্ঠ : আপনাদের জাতীয় ঐক্য সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক স্বীকৃতি কত দূর?
অং কিয়াউ মো : আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কূটনীতির ক্ষেত্রে আমরা ক্রমবর্ধমান সাড়া পাচ্ছি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আমাদের বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সম্পর্ক আছে। মিয়ানমারের অনেক অঞ্চল এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণে। জাতীয় ঐক্য সরকারের মন্ত্রিসভার বেশির ভাগ সদস্য এখন মিয়ানমারেই আছেন। যাঁদের বিদেশ সফরের প্রয়োজন তাঁরা বিদেশ সফর করছেন। আমি বলতে চাই, আমরা আমাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় নিজস্ব শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছি। আমরা খুব দ্রুতই মিয়ানমার জান্তার সামরিক বাহিনীকে বিভিন্ন এলাকা থেকে উত্খাত করছি।
কালের কণ্ঠ : আপনি বলছিলেন, মিয়ানমারের অনেক এলাকা এখন আপনাদের অর্থাৎ জান্তাবিরোধীদের নিয়ন্ত্রণে।
অং কিয়াউ মো : হ্যাঁ। মিয়ানমারের মোট ভূখণ্ডের অন্তত ৬০ শতাংশ এখন এনইউজি ও জাতিগত প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর নিয়ন্ত্রণে। সেখানে জান্তার নিয়ন্ত্রণ নেই। জান্তা এখনো বড় বড় শহর নিয়ন্ত্রণ করছে। আমরা আমাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় নিজস্ব সরকারব্যবস্থা ও সেবা চালু করেছি।
কালের কণ্ঠ : গত ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের জান্তার অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার তৃতীয় বার্ষিকী ছিল। এবার বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে আপনাদের কী আহ্বান ছিল?
অং কিয়াউ মো : আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারের জান্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। জান্তা এখনো কোনো সরকার নয়, বরং সামরিক কর্তৃপক্ষ হিসেবে পরিচিত। তবে আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আরো জোরালো ভূমিকা প্রত্যাশা করি। মিয়ানমারে চলমান বিপ্লব সংঘটিত হচ্ছে দেশে-বিদেশে মিয়ানমারের জনগণের সমর্থন নিয়ে। আমরা অবশ্যই এভাবে জান্তার অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার চতুর্থ বার্ষিকী পালন করতে চাই না। আমাদের প্রত্যাশা, ২০২৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারির আগেই মিয়ানমারে জান্তা কর্তৃপক্ষের পতন ঘটবে।
কালের কণ্ঠ : চীনের সমর্থন কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
অং কিয়াউ মো : চীন মিয়ানমারের জান্তাকে সমর্থন করছে—এমনটি আমরা মনে করি না। আর মিয়ানমারে গণতন্ত্রীকরণ প্রক্রিয়ায় চীনের ভূমিকা ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চীনের একটি ভালো প্রতিবেশী হতে চাই। আমরা আশা করি, চীন সমৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। আমরা আমাদের দেশে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সাম্য, ন্যায়বিচার ও সমৃদ্ধি কামনা করি। এটি মূলত আমাদের অবস্থান এবং আমরা চীনের ক্ষেত্রেও নীতিটি প্রকাশ করেছি।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যোগাযোগ, আলাপ-আলোচনায় আপনারা কী বার্তা দিচ্ছেন?
অং কিয়াউ মো : ‘বসন্ত বিপ্লব’ এখন বাস্তব। মিয়ানমার রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার এই উপলক্ষ রোহিঙ্গাদের মতো দীর্ঘদিন ধরে প্রান্তিক, বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার হওয়া জনগোষ্ঠীগুলোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্তর্ভুক্তিমূলক ফেডারেল গণতন্ত্র গড়তে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্তি খুবই প্রয়োজন। রাষ্ট্র গঠনে অবদান রাখার পাশাপাশি অধিকার আদায়েও রোহিঙ্গারা বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীকে পরাজিত করতে হবে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকেও এখানে অবদান রাখতে হবে। তবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগই এখন মিয়ানমারের বাইরে। আমাদের পরিকল্পনা হলো তাদের প্রাপ্য অধিকার দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়া। অন্য জাতিগোষ্ঠীর পাশাপাশি রোহিঙ্গারাও যাতে সমান সুযোগ পায় তা নিশ্চিত করার সুবর্ণ মুহূর্ত এটি।
মিয়ানমার যখন স্বাধীন হয়েছিল তখন রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের সমাজের অংশ ছিল। রোহিঙ্গাদের অবশ্যই আবারও মিয়ানমার সমাজের অংশ হওয়া উচিত। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মনে রাখতে হবে, বসন্ত বিপ্লবের ফলে সৃষ্ট এই সুযোগ যেন রোহিঙ্গাদের হাতছাড়া না হয়।
কালের কণ্ঠ : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
অং কিয়াউ মো : কালের কণ্ঠকেও ধন্যবাদ।