বাংলাদেশে একটি শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায় সব দেশ। সেই নির্বাচনের ভোট কেমন হচ্ছে সেদিকে আজ সবার দৃষ্টি। বাংলাদেশের এবারের নির্বাচন যেমন বৈশ্বিক অঙ্গনে আলোচিত হয়েছে, তেমনি নির্বাচন ঘিরে বড় শক্তিগুলোর কিছু মতপার্থক্যও প্রকাশ পেয়েছে।
জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্রিফিংগুলোতে বাংলাদেশের নির্বাচন, রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রশ্ন উঠেছে।
প্রশ্নের জবাবে জাতিসংঘ তার সদস্য রাষ্ট্রগুলোর নির্বাচন নিয়ে তাদের যে অবস্থান তাই তুলে ধরেছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র ব্রিফিংগুলোতে বলেছেন, অন্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও তাঁরা অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চান।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে জাতিসংঘের ব্রিফিংগুলোতে বাংলাদেশের নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানো নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। দায়িত্ব না পেলে সদস্য কোনো দেশের নির্বাচনে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক পাঠানোর এখতিয়ার নেই বলে মুখপাত্ররা জানিয়েছেন।
বাংলাদেশের নির্বাচনকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন। যুক্তরাষ্ট্রের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়ার কৌশলগত প্রতিযোগিতা রয়েছে। অতীতে কয়েকটি নির্বাচন নিয়ে সমালোচনার প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্র ইস্যুতে বাংলাদেশকে চাপ দেওয়ার জন্য বেছে নিয়েছে বাইডেন প্রশাসন।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন গত বছরের ২৩ মে বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে উৎসাহিত করতে ভিসানীতি ঘোষণা করেন।
এর আওতায় বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী যেকোনো বাংলাদেশির ওপর যুক্তরাষ্ট্র ভিসা বিধি-নিষেধ আরোপ করার সুযোগ পেয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভিসানীতি প্রয়োগ শুরুর কথা জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ঘোষণা অনুযায়ী, কয়েকজন বাংলাদেশি সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা, ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের সদস্য, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য রয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র তার আইন অনুযায়ী, ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসা ব্যক্তিদের পরিচয় প্রকাশ করে না।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের আগে কয়েকটি দেশের ক্ষেত্রে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে।
সেগুলোর প্রয়োগ শুরু হয়েছে নির্বাচনের পর। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নির্বাচনের আগেই ভিসানীতি প্রয়োগ শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এটি ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকতে পারে।
অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের ওপর বাইডেন প্রশাসনের চাপ নিয়ে নয়াদিল্লি-ওয়াশিংটনের মতপার্থক্যের কথা ভারতীয় গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। সর্বশেষ গত নভেম্বর মাসে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের সময় নয়াদিল্লি বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে তার অবস্থান স্পষ্ট করে। গত ১০ নভেম্বর ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় কোয়াত্রা জানান, ‘বাংলাদেশ বিষয়ে আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি খুবই স্পষ্টভাবে জানিয়েছি। তৃতীয় কোনো দেশের নীতির বিষয়ে কথা বলা আমাদের কাজ নয়।’
ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘বাংলাদেশের নির্বাচন তাদের (বাংলাদেশের) অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশের জনগণই তাদের ভবিষ্যৎ ঠিক করবে।’
নয়াদিল্লিতে ওই বৈঠকের কাছাকাছি সময় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক ব্যুরোর অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে চিঠি দিয়ে সংলাপে বসার আহবান জানান। সেই চিঠিতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিরপেক্ষ অবস্থান জানানোর পাশাপাশি সহিংসতার বিরোধিতা করেন এবং ভিসানীতি প্রয়োগ অব্যাহত রাখার কথা জানান।
এদিকে যুক্তরাজ্যও বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আহবান জানিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও (ইইউ) বাংলাদেশে বিশ্বাসযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখার প্রত্যাশা জানিয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পশ্চিমা কূটনীতিক কালের কণ্ঠকে জানান, সবাই সুষ্ঠু নির্বাচন চাইলেও কৌশলগত কারণে প্রকাশভঙ্গি ভিন্ন। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র যতটা সরব, অনেক পশ্চিমা দেশ সেভাবে সরব নয়।
তিনি বলেন, পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যেও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ও ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা রয়েছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁর সফরে গণতন্ত্রের বিষয়টি সেভাবে গুরুত্ব না পাওয়ার মধ্য দিয়ে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
চীন ও রাশিয়াও বাংলাদেশের নির্বাচনে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে। চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেছেন, চীন বাংলাদেশের সংবিধান ও আইন অনুযায়ী নির্বাচন চায়। নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এখানে বাইরের কারো হস্তক্ষেপ চায় না চীন।
রাশিয়াও এবার বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের সমালোচনা করেছে। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বিরুদ্ধে বিরোধী পক্ষের কর্মসূচির সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ এনেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই এসব অভিযোগ নাকচ করেছে।
বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতার বিপরীতে সরকার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে তার উদ্যোগগুলো বারবার তুলে ধরেছে।
পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেছেন, নির্বাচনের পর নিষেধাজ্ঞা আসা না-আসা নিয়ে এখনই অস্থির বা ভীত হওয়ার তিনি কোনো কারণ দেখছেন না। আর যদি কিছু আসে, তা বাংলাদেশ মোকাবেলা করবে।