বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংঘাত নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের বিবৃতিতে উল্লিখিত তথ্য সঠিক নয় বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গতকাল বুধবার দুপুরে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, বাংলাদেশ সরকার ত্রুটিপূর্ণ এই বিবৃতির প্রতিবাদ জানাবে।
গত রাতেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার আশা করছে, জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর তাদের আগের বিবৃতি সংশোধন করে সঠিক তথ্য তুলে ধরবে।
না হলে প্রতিষ্ঠানটি গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে।
জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক গত সোমবার নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংঘাতে ৯ জনের মৃত্যুর কথা জানিয়েছিলেন। জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের মুখপাত্র লিজ থ্রসেল পরদিন গত মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে এ সংখ্যা ১১ বলে উল্লেখ করেন।
বস্তুত ঢাকায় গত শনিবারের সংঘাতের সময় পুলিশের এক সদস্য ও যুবদলের এক স্থানীয় নেতার মৃত্যু হয়।
পরদিন রবিবার হরতালে ১৩ জেলায় সহিংসতায় চারজনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে দুজন পৃথক ঘটনায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। গত মঙ্গলবার বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর ডাকা অবরোধের প্রথম দিন আরো চারজন নিহত হন।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের মুখপাত্রের দেওয়া বিবৃতিতে হামলাকারীদের পরিচয় সম্পর্কে বিএনপির অভিযোগ জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
এর মাধ্যমে সহিংসতায় সরকার সমর্থিত ব্যক্তিদের সম্পৃক্ততারও ইঙ্গিত করা হয়েছে।
হামলাকারীদের পরিচয় জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর কিভাবে যাচাই করেছে তা জানতে কালের কণ্ঠ মুখপাত্র লিজ থ্রসেলকে মেইল করেন। গতকাল রাত ১০টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তিনি কোনো জবাব দেননি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, ‘জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের বিবৃতির বর্ণনা বেশ ত্রুটিপূর্ণ, বাস্তবতাবিবর্জিত। আমরা এর একটা প্রতিবাদ পাঠাব।
আমরা মনে করি, তাঁরা যথাযথভাবে অবহিত নন।’ তিনি বলেন, জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের তথ্যে ঘাটতি আছে। এ রকম প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যে ঘাটতি থাকা খুবই দুঃখজনক।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তি
বিজ্ঞপ্তিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসনের অধীনে আগামী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের এক দফা অসাংবিধানিক দাবির নামে বিএনপি সহিংসতা ও জনবিচ্ছিন্নতার অভূতপূর্ব প্রদর্শনী করছে। বাংলাদেশ সরকার তাতে গভীরভাবে মর্মাহত। বিএনপির অনুরোধ অনুসারে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কিছু নির্দিষ্ট শর্তে ২৮ অক্টোবর তাদের দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করার অনুমতি দেয়। তবে বিএনপিকর্মীরা রাস্তায় সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ, ব্যক্তি ও সম্পত্তির ওপর হামলার আশ্রয় নেয়। এ ধরনের ব্যাপক সহিংসতার প্রধান শিকার হয়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ, নিরপরাধ নাগরিক, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি সম্পত্তি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, পুলিশের একজন সদস্যকে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সদস্যরা আক্রান্ত ও আহত হয়েছেন। বাস, ফায়ার সার্ভিসের ট্রাকসহ অন্যান্য গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি ও দেশের সর্বোচ্চ আদালতের অন্য বিচারকদের বাসভবন ভাঙচুর করা হয়েছে। পুলিশ হাসপাতাল চত্বর ও অ্যাম্বুল্যান্সে আগুন দেওয়া হয়েছে। বেশ কয়েকটি পুলিশ বক্স ভাঙচুর করা হয়েছে। সাংবাদিক ও ক্যামেরাপারসনদের ওপর হামলা করা হয়েছে। বিএনপির এমন ক্রমাগত নৃশংসতার মুখেও বাংলাদেশ সরকার এবং এর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অত্যন্ত সংযম ও ধৈর্য্য প্রদর্শন করেছে। তারা জনশৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে সর্বনিম্ন পর্যায়ের বলপ্রয়োগ করেছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রলালয় বলেছে, মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের বিবৃতিতে মোটরসাইকেলে চড়ে হামলা করা ‘মুখোশধারী ব্যক্তিদের’ ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের বলে যে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
মার্কিন সরকারকে নিয়ে সবাই খেলছে
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কথিত উপদেষ্টা মিয়া আরেফির বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দেশে মার্কিন সরকারকে নিয়ে সব লোক খেলা করছে। এটা খেলার মতো হয়ে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট বাইডেন অত বোকা লোক নন। তাঁর নাকি উপদেষ্টা (মিয়া আরেফি)! এটা খুব দুঃখজনক, লজ্জাজনক।’
মিয়া আরেফি সম্পর্কে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘একটা ভুয়া লোক। সে সংবাদ সম্মেলন করেছে বিএনপির কার্যালয়ে। শুধু সংবাদ সম্মেলন নয়, এর আগে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে আলাপও করেছে। তারপর যখন সংবাদ সম্মেলন করে তার পাশেই বিএনপি নেতারা বসা ছিলেন।’
বিদেশি মিশনগুলোতে বিএনপির পাঠানো চিঠির প্রতি ইঙ্গিত করে মোমেন বলেন, “বিএনপি সব সময় ভুয়া তথ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তারা একটা বর্ণনা দিয়েছে বলে শুনেছি। তাদের বর্ণনার মধ্যে ভুয়া এবং মিথ্যা তথ্য বেশি। তার নমুনা হচ্ছে, একটা ভুয়া লোককে এনেছে; যেন আরো সহিসংতা হয়। মার্কিন দূতাবাস ‘ডিসক্লেইম’ (সেই লোক তাদের সরকারের প্রতিনিধি নয় বলে দাবি) করেছে। আমার মনে হয়, তারা (যুক্তরাষ্ট্র) তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।”
মার্কিন প্রেসিডেন্টের তথাকথিত উপদেষ্টার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য ঢাকার মার্কিন দূতাবাস ‘কনস্যুলার অ্যাকসেস’ চেয়েছে। সেটি দেওয়া হবে কি না—জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘কনস্যুলার অ্যাকসেসের বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেখে। আমাদের আইন আছে, সেই অনুযায়ী অনুমতি দেওয়া হয়।’