বলা হয়ে থাকে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি নিজ দেশে প্রেস কনফারেন্স করেন না। যুক্তরাষ্ট্রে যখন তিনি গণমাধ্যমের মুখোমুখি হলেন, তখন এ বিষয়টি উঠল। তবে তিনি ভালোভাবেই উত্তর দিলেন। তিনি বলেছেন, ভারতে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য আছে। সবাই সমান। ওখানে এ রকম হয় না।
নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর প্রতি মোদির আচরণের ইতিহাস নিয়েও ওয়াশিংটন ডিসিতে প্রতিবাদ হয়েছে। মোদি বা বিজেপির বিরুদ্ধে রানা আইয়ুবের মতো ব্যক্তিরা সরব। তাঁদের কথা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে স্থান পায়। যুক্তরাষ্ট্রে আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতাবিষয়ক প্রতিবেদনে ভারতকে খুব ভালো স্থানে রাখা হয়নি। বাইডেন-মোদি বৈঠকে হয়তো এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এগুলো নিয়ে প্রশ্ন করলে যুক্তরাষ্ট্র বলে, ভারত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র।
কালের কণ্ঠ : অনেক বিশ্লেষক বলছেন, প্রেসিডেন্ট বাইডেন তাঁর নীতিগত অবস্থানের চেয়ে জাতীয় স্বার্থকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এ কারণে কোনো বিষয়ে উদ্বেগ থাকলেও প্রকাশ্যে বলেন না। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভারতের এই বিশেষ গুরুত্বের কারণ কী?
রুদাবেহ শহীদ : ভারত নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের আসলে কতটা উদ্বেগ আছে সেটিও বিবেচ্য বিষয়। যুক্তরাষ্ট্র এসব বিষয় দেখছে নিরাপত্তা, বাণিজ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে। ভারত একটি বড় বাজার। আবার নিরাপত্তা ইস্যুতে নিঃসন্দেহে চীনের উত্থান যুক্তরাষ্ট্রের কাছে উদ্বেগের। চীন পারলে দক্ষিণ চীন সাগরের ৯০ শতাংশ জায়গা দাবি করে বসে। ভারত ও জাপানের সঙ্গে চীনের সীমান্ত বিরোধ আছে। আবার রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের খুব ভালো সম্পর্ক। সার্বিকভাবে সব কিছু মিলিয়ে ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের আরেকটি বড় শক্তি হলো ভারতীয় ডায়াসপোরা (প্রবাসী ভারতীয় সম্প্রদায়)। ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান—দুই দলেই তাদের বড় প্রভাব আছে। শুধু ভোটার নয়, দলের তহবিলে অর্থায়নের ক্ষেত্রেও তারা বড় ভূমিকা রাখে। অবশ্যই ভারতীয় লবিস্ট গ্রুপ বড়। মাইক্রোসফটের চেয়ারম্যান সত্য নাদেলা, গুগলের প্রধান নির্বাহী সুন্দর পিচাইয়ের মতো অনেক ভারতীয় আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শীর্ষ নির্বাহী পদে আছেন। বর্তমান মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্টও ভারতীয় বংশোদ্ভূত।
কালের কণ্ঠ : যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বা হোয়াইট হাউসের ব্রিফিং বা দৃশ্যমান বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশ আলোচনায় আসছে। এক দশক আগেও পরিস্থিতি এমন ছিল না। হঠাৎ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার কারণ কী?
রুদাবেহ শহীদ : বড় কারণ নিরাপত্তা ইস্যু ও কোয়াড। দক্ষিণ এশিয়ার মতো এমন কোনো অঞ্চল নেই যেখানে কোনো দেশের একক আধিপত্য আছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভূখণ্ডের ৭৫ শতাংশ ভারতের। ৮০ শতাংশ জিডিপি ভারতের। হয়তো পাকিস্তান বা সার্ক সদস্য আফগানিস্তান আকারে বড়। কিন্তু বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ—এগুলো তো অবশ্যই আয়তনে অনেক ছোট। তবে বৈশ্বিকভাবে বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশ মোটেও ছোট দেশ নয়। জনসংখ্যায় বাংলাদেশ বিশ্বে অষ্টম। জিডিপিতে বিশ্বের বৃহত্তম দেশের তালিকায় ৩৫তম।
গত ১০ বছরে যখন মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা বিরোধের সমাধান হয়েছে, তখন কিন্তু বাংলাদেশ আর স্থলভিত্তিক রাষ্ট্র নয়। সার্কের জন্য বাংলাদেশই উদ্যোগ নিয়েছিল। ভারত, পাকিস্তান ভূ-রাজনৈতিক কারণসহ অনেক কারণে সার্ক ব্যর্থ হয়েছে। সমুদ্রসীমা বিরোধ নিয়ে আদালতের আদেশ বাংলাদেশের পক্ষে আসার পর পররাষ্ট্রনীতিতে মেরিটাইম গুরুত্ব পাচ্ছে।
কালের কণ্ঠ : চীনের ভূমিকার কারণে কি যুক্তরাষ্ট্র এখানে আরো সক্রিয় হয়ে উঠছে?
রুদাবেহ শহীদ : চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশের পুরনো সাবমেরিন কেনা নিয়ে প্রথমে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু পরে যখন দেখা গেল, সাবমেরিনের সঙ্গে বিশেষজ্ঞরাও আসছেন, তখন পশ্চিমারা ভয় তো পেলই, প্রতিবেশী ভারতের গণমাধ্যমেও নানা প্রশ্ন উঠল।
বাংলাদেশের অনেক অবকাঠামো প্রকল্পে চীনারা সম্পৃক্ত। পশ্চিমাদের ভয় হচ্ছে, শ্রীলঙ্কার মতো অবস্থা যেন বাংলাদেশের না হয়। শ্রীলঙ্কার অবস্থা যদি দেখেন, ওরা সবার কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে। চীনের কাছ থেকে ঋণ দিয়েছে ১০ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে জাপান ও প্যারিস ক্লাব থেকে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্সও আছে।
আরেকটা ভয় হচ্ছে, মালদ্বীপের মতো যেন না হয় বাংলাদেশের। মালদ্বীপের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ ঋণ চীনের। যখন ওই দেশটি বিপদে পড়েছে তখন ভারত সহজ শর্তে অনেক ঋণ দিয়েছে। মালদ্বীপের সোলিহর সরকার ভারতপন্থী।
যুক্তরাষ্ট্রের ভয়, এখানে কি চীনের প্রভাব বাড়ছে? হতে পারে, এ কারণে বাংলাদেশ নিয়ে অনেক ইস্যু ওঠানো হচ্ছে। তা না হলে দুনিয়ার অনেক জায়গায় মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। ওগুলো নিয়ে কেন বলা হয় না!
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে ভূমিকা রাখছে সেখানে ভারতও কি একই অবস্থানে আছে?
রুদাবেহ শহীদ : না। এটি এখনো বলা যাচ্ছে না। কারণ ভারত এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেয়নি। ভারত-বাংলাদেশের বাণিজ্যসহ অনেক ধরনের সম্পর্ক আছে। ভারতেরও এখানে জাতীয় স্বার্থ আছে। কোন সরকারের আমলে তাদের জাতীয় স্বার্থ কতটা রক্ষা হয় নিশ্চয় তারাও তা চিন্তা করবে।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশের আগেও তো কিছু দেশের ক্ষেত্রে ভিসানীতি নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের কী সাফল্য এসেছে?
রুদাবেহ শহীদ : অনেক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির সন্তানরা যুক্তরাষ্ট্রে পড়ালেখা করে। নির্বাচনের ক্ষেত্রে ওই সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের ভূমিকা যাতে সংযত থাকে সে জন্য এই নীতি করা হয়েছে। নাইজেরিয়ার ক্ষেত্রে এর সাফল্য সীমিত।
তবে এ ধরনের ভিসা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কতটা পড়বে তা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। বিশেষ করে, আপনি ওই নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্তের সঙ্গে আপনার অন্য অংশীদারকে কতটা পাশে পাচ্ছেন তাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
মিয়ানমারের দিকেই দৃষ্টি দেওয়া যাক। মিয়ানমারের ওপর অনেক নিষেধাজ্ঞা এসেছে। অনেক কম্পানি মিয়ানমার ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু চীন মিয়ানমারকে অনেক সমর্থন দিয়েছে। ভারত, ইসরায়েল, রাশিয়াও ওই দেশটির সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে।
কালের কণ্ঠ : প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও প্রধানমন্ত্রী মোদি মিয়ানমার ও আফগানিস্তান প্রসঙ্গে কথা বলেছেন।
রুদাবেহ শহীদ : মিয়ানমার ও আফগানিস্তান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হওয়াটা ভালো। যুক্তরাষ্ট্র গত বছরই বলেছে, রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে তা জেনোসাইড। আফগানিস্তানেও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আছে। তালেবানরা এবার আরও প্রশিক্ষিত। তারা কাতারে কূটনীতি শিখেছে। কিন্তু এর পরও আমার সন্দেহ আছে সরকার চালানোর মতো দক্ষতা তাদের আছে কি না। এর আগে আশরাফ ঘানীর সরকার ছিল দুর্নীতিবাজ। এখন তো পরিস্থিতি অন্যরকম।
আফগানিস্তানের অনেক সম্পদ যুক্তরাষ্ট্রে জব্দ আছে। মিয়ানমারে অনেক রাজনৈতিক বন্দি আছে। মিয়ানমারের অনেক জায়গায় পুরোদমে গৃহযুদ্ধ চলছে।
যুক্তরাষ্ট্র সম্ভাব্য যা করতে পারছে করছে। কিন্তু সম্ভবত নিষেধাজ্ঞা একমাত্র সমাধান নয়। মিয়ানমারে ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বেশি। রাখাইন রাজ্যে চীন ও ভারতের স্বার্থ আছে। এখানে যদি যুক্তরাষ্ট্র সবাইকে পাশে না পায় তাহলে মিয়ানমারে তার গণতন্ত্র দেখা অনেক কষ্টকর হবে।
কালের কণ্ঠ : আমরা আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ দেখেছি, আবার মিয়ানমারে সু চির সরকারকে শক্তিশালী করতে মার্কিন উদ্যোগ দেখেছি। দুই দেশেই কি যুক্তরাষ্ট্র লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলো?
রুদাবেহ শহীদ : আপনি কোন দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়গুলোকে দেখছেন তার ওপর সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাব-নিকাশ নির্ভর করছে। বাইডেন প্রশাসন আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের সময় বলেছে, রাষ্ট্র গড়া তাদের লক্ষ্য ছিল না। কিন্তু তার আগের মার্কিন প্রশাসনগুলোর বক্তব্য ভিন্ন ছিল।
বাইডেন প্রশাসন বলেছে, ওসামা বিন লাদেন ও আল-কায়েদাকে নিষ্ক্রিয় করাই লক্ষ্য ছিল। ওই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে মনে হবে, তাদের উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে।
আবার মিয়ানমারে প্রায় ১০ বছর গণতন্ত্রের চেষ্টা হয়েছে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগ ছিল। ২০১৪ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মিয়ানমারে গেছেন। অং সান সু চির সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সু চি রোহিঙ্গা নিপীড়নের সময় চুপ থাকার পথ বেছে নিয়েছিলেন। পরে এ সংকট আরো অনেক বড় হলো। সেখানেও যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা করেছে। মিয়ানমারে বড় ধরনের অবকাঠামো উন্নতি হয়েছে।
তাই যুক্তরাষ্ট্র ওই দুই দেশে পুরোপুরি সফল বা পুরোপুরি ব্যর্থ—এমনটি বলা যাবে না।
কালের কণ্ঠ : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
রুদাবেহ শহীদ : কালের কণ্ঠকেও অনেক ধন্যবাদ।