ভারতের ওড়িশা রাজ্যের বালাসোরে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার জন্য প্রাথমিকভাবে সিগন্যাল ত্রুটিকে দায়ী করা হয়েছে। গতকাল শনিবার প্রকাশিত প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, কলকাতা থেকে চেন্নাইগামী যাত্রীবাহী করমণ্ডল এক্সপ্রেস মেইন লাইন থেকে লুপ লাইনে ঢুকে গিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মালবাহী ট্রেনকে ধাক্কা দেয়। এর পরপরই হাওড়াগামী যাত্রীবাহী বেঙ্গালুরু-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত ট্রেনের বগিতে ধাক্কা দেয়।
ভয়াবহ ওই ট্রেন দুর্ঘটনায় গত রাত ১২টা পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ২৮৮ জনে পৌঁছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গতকাল দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তিনি ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তির বার্তা দেন।
কলকাতায় বাংলাদেশের উপহাইকমিশন জানিয়েছে, ওই দুর্ঘটনায় দুই বাংলাদেশি আহত হয়েছেন।
পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা থেকে ছেড়ে আসা করমণ্ডল এক্সপ্রেস ট্রেনটি বালাসোরের বাহানগা স্টেশনের কাছে পৌঁছলে এই দুর্ঘটনা ঘটে।
এ সময় মালবাহী ট্রেনের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় চেন্নাইগামী করমণ্ডলের। এরপর কর্ণাটক থেকে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়াগামী যাত্রীবাহী ট্রেনের দুটি বগিও সংঘর্ষের জেরে লাইনচ্যুত হয়। এই দুর্ঘটনা ভারত তো বটেই, পৃথিবীর অন্যতম ভয়ংকর রেল দুর্ঘটনার তালিকায় নাম লিখিয়েছে।
নিহতদের জন্য ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছে।
ওড়িশা সরকার নিহতদের জন্য ১০ লাখ করে এবং গুরুতর আহতদের চিকিৎসায় দুই লাখ রুপি করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার নিহতদের পাঁচ লাখ এবং গুরুতর আহতদের এক লাখ রুপি করে ক্ষতিপূরণ দেবে। হতাহতদের বেশির ভাগই এই দুই রাজ্যের।
বালাসোরের ট্রেন বিপর্যয় নিয়ে ভারতীয় রেল কর্তৃপক্ষের যৌথ প্রাথমিক তদন্ত কমিটি গতকাল জানায়, সংকেতসংক্রান্ত (সিগন্যাল) ব্যর্থতার কারণে তিন ট্রেনের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, আপ প্রধান লাইনে সবুজ সংকেত দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু করমণ্ডল এক্সপ্রেস ওই লাইনে যায়নি। মালবাহী ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকা লুপ লাইনে ঢুকে যায় এটি এবং এতে সংঘর্ষ ঘটে। এর ফলে লাইনচ্যুত হয় করমণ্ডল। একই সময় ডাউন লাইনে যাচ্ছিল হাওড়াগামী দ্রুতগতির ট্রেনটি।
দুর্ঘটনার পর দেখা যায়, করমণ্ডলের ২৩টি বগির ১৫টিই লাইনচ্যুত হয়েছে। ট্রেনটির সামনের অংশ মালবাহী ট্রেনটির একদম ওপরে উঠে গেছে। কিছু বগি লাইন থেকে ছিটকে পড়ে গেছে। কোনোটির চাকা খুলে গেছে এবং বগিগুলো দুমড়েমুচড়ে গেছে। উদ্ধার অভিযান, হাসপাতালে আহত রোগীদের নিয়ে দিনভর ছোটাছুটির মধ্যে ব্যস্ত রয়েছেন ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েকসহ রাজ্যের অন্যান্য দলের নেতাকর্মীরা। তবে দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে সন্তোষজনক উত্তর এখনো আসছে না।
এই দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। গত বছর স্বয়ংক্রিয় ট্রেন সুরক্ষা (এটিপি) যন্ত্র ‘কবচ’ চালু করে রেল মন্ত্রণালয়। রেলের দুর্ঘটনা ব্যাপক হারে কমানোর ক্ষেত্রে এটির ‘সম্ভাব্য’ ভূমিকার দাবি করেছিল সরকার। কিন্তু এবার সেই প্রযুক্তি কেন কাজ করল না, তা নিয়ে বড়সড় প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে।
বন্দে ভারত এক্সপ্রেস ট্রেন নিয়ে কাজ করা ভারতের বিশেষজ্ঞ সুধাংশু মানি মনে করছেন, এটি সংকেতজনিত ব্যর্থতার কোনো কারণে ঘটেনি। তিনি আরো বলেন, কবচ এ ধরনের দুর্ঘটনা বন্ধ করতে পারবে না। সরকারের তদন্ত করা উচিত, কেন প্রথম ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়েছিল।
দেশের সাবেক রেলমন্ত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করেছেন, করমণ্ডলে সুরক্ষাযন্ত্র ছিল না। দুর্ঘটনায় মৃত্যু কমানো যেতে পারত। গতকাল কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবের পাশে দাঁড়িয়ে মমতা আরো অভিযোগ করেন, রেলে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। আরো যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন।
দুর্ঘটনাস্থলে মোদি : বালাসোর দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত আহতের সংখ্যা প্রায় হাজার। তাদের অনেকেই বালাসোর হাসপাতালে ভর্তি। গতকাল নয়াদিল্লিতে বিশেষ বৈঠক সেরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছে যান। উদ্ধারকাজ পরিদর্শন ও আহতদের দেখতে হাসপাতালে যান তিনি। দুর্ঘটনাস্থলে রেলমন্ত্রীসহ রেলের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা দুঃখজনক ঘটনা। আহতদের চিকিৎসায় কোনো কমতি রাখবে না সরকার। ঘটনার সঠিক তদন্ত হবে এবং দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।
১৪ ঘণ্টার উদ্ধার অভিযান : কেন্দ্রীয় সরকারসহ ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গসহ বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা সহযোগীরা এতে অংশ নেয়। ১৪ ঘণ্টা ধরে চলা উদ্ধার অভিযান শেষ করার পর রেল কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র অমিতাভ শার্মা সকাল ১১টার দিকে বলেন, ‘উদ্ধার অভিযান শেষ হয়েছে। আমরা এখন পুনরুদ্ধারের কাজ করছি।’
রেলমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি : ভারতের বিরোধী দলগুলো কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবের পদত্যাগ দাবি করেছে। কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে গতকাল দলীয় নেতাকর্মীসহ সবার উদ্দেশে দুর্ঘটনাস্থলে থেকে ভুক্তভোগীদের সহায়তার আহবান জানান। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও রেলমন্ত্রীকে নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় মহাসচিব কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন।
দুই বাংলাদেশি আহত : কলকাতা থেকে চেন্নাইগামী করমণ্ডল এক্সপ্রেসে দুর্ঘটনায় দুই বাংলাদেশি আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন কলকাতায় বাংলাদেশের উপহাইকমিশন। গতকাল শনিবার দুপুরে কলকাতায় উপহাইকমিশনার আন্দালিব ইলিয়াস সাংবাদিকদের এ তথ্য জানিয়েছেন।
উপহাইকমিশনার বলেন, ‘কোনো বাংলাদেশি নিহত হওয়ার খবর আমরা এখনো পাইনি। আমাদের কাছে দুজন আহত হওয়ার খবর আছে।’ উপহাইকমিশনের একটি দল ঘটনাস্থলে গেছে। সূত্র : এনডিটিভি, ইন্ডিয়া টুডে