সরকারবিরোধী যুগপত্ আন্দোলনের পরবর্তী ধাপেও শক্ত কোনো কর্মসূচি দিচ্ছে না বিএনপি। আরো কিছুদিন গতানুগতিক কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলনের গতি বাড়ানোর পাশাপাশি জনসম্পৃক্ততা ও দেশি-বিদেশি সমর্থন আদায় করতে চায় দলটি।
দলের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে কয়েক ধাপে ৮২টি সাংগঠনিক জেলায় সমাবেশ করবে বিএনপি। এরপর চূড়ান্ত পর্যায়ে সারা দেশ থেকে নেতাকর্মী এনে ঢাকায় বড় জমায়েত করার পরিকল্পনা করছেন দলের নীতিনির্ধারকরা।
এ পর্যায়ে ঢাকামুখী রোড মার্চ, লং মার্চ কিংবা ঢাকা ঘেরাওয়ের মতো বড় কর্মসূচি দেওয়ার ব্যাপারে দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আলোচনা হচ্ছে।
দলীয় সূত্র জানায়, আগামী শনিবার ঢাকায় বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে এই কর্মসূচি করা হবে। শনিবার নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলার প্রতিবাদে এবং ১০ দফা দাবিতে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপি নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করবে। গত রাতে এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
এদিকে কর্মসূচি ঠিক করতে গত মঙ্গলবার রাতে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটি ও বুধবার সাংগঠনিক সম্পাদকদের ভার্চুয়াল বৈঠক হয়েছে। এতে কর্মসূচির একটি খসড়া পথরেখা তৈরি করা হলেও চূড়ান্ত পর্যায়ের আন্দোলন কবে শুরু হবে তা ঠিক করেননি দলের নীতিনির্ধারকরা।
স্থায়ী কমিটির বৈঠকে যুগপত্ আন্দোলনের যৌথ ঘোষণাপত্র প্রণয়ন, গণতন্ত্র মঞ্চে ভাঙন, জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী পালনসহ চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
বৈঠক সূত্র জানায়, গত বছরের ১২ অক্টোবর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বিভাগীয় গণসমাবেশের আদলে জেলা পর্যায়ে কর্মসূচি দেওয়া হতে পারে।
এসব সমাবেশে বড় জমায়েত করার সিদ্ধান্ত হয়। এই কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলনকে একটি যৌক্তিক পর্যায়ে নিতে চায় দলটি।
যুগপত্ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী দলগুলো নতুন কর্মসূচি হিসেবে ঢাকা থেকে অন্য বিভাগ অভিমুখে রোড মার্চের প্রস্তাব দিলেও এ নিয়ে আগ্রহী নয় বিএনপি। দলের নেতারা বলেন, রোড মার্চ বিশাল রাজনৈতিক কর্মযজ্ঞ। তা ছাড়া এই কর্মসূচিতে সাড়া পেতে হলে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নেতৃত্ব দিতে হবে।
দলের অন্য জ্যেষ্ঠ নেতারা রোড মার্চের নেতৃত্ব দিলে মহাসড়কজুড়ে নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণ পাওয়া কঠিন হবে।
বৈঠকে একাধিক নেতা বলেন, সারা দেশে আবার ধরপাকড় শুরু হয়েছে। নতুন গায়েবি মামলা দেওয়া হচ্ছে। নেতাকর্মীদের বাড়ি তল্লাশি ও জামিন বাতিল করে তাঁদের কারাগারে পাঠানোর ঘটনাও বাড়ছে। তাই নতুন কর্মসূচি দিয়ে দ্রুত মাঠে নামতে হবে, নইলে আন্দোলন শুরুর আগেই নেতাকর্মীদের জেলে যেতে হতে পারে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, কর্মসূচি প্রায় চূড়ান্ত, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ঘোষণা করা হবে। তিনি বলেন, এবারও ব্যতিক্রম কিংবা শক্ত কর্মসূচি আসছে না। নিয়মতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মধ্যে থাকবেন তাঁরা।
যৌথ ঘোষণা পিছিয়ে যেতে পারে : রূপরেখা প্রণয়ন নিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের চিন্তার সঙ্গে একমত হননি বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। এ নিয়ে আরো আলোচনা হওয়া দরকার বলে মনে করেন নেতারা। ফলে যৌথ ঘোষণা কিছুদিন পিছিয়ে যেতে পারে।
গণতন্ত্র মঞ্চ সূত্রে জানা যায়, সরকার গঠনের পর রাষ্ট্র মেরামতে কী করা হবে তা নিয়ে ৩৫ দফার খসড়া রূপরেখা তৈরি করেছে এই জোট। বিএনপির রাষ্ট্র মেরামতের ২৭ দফা রূপরেখার সঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চের ১৪ দফার সমন্বয়ে এই ৩৫ দফা খসড়া রূপরেখা তৈরি করা হয়।
স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে সভায় বিশদ আলোচনা হয়েছে। বিএনপি ২৭ দফা অটুট রেখে গণতন্ত্র মঞ্চের দাবিগুলো সমন্বয় করতে চায়।
বিএনপি নেতারা মনে করেন, ১০ দফা দাবি ও রাষ্ট্র মেরামতের ২৭ দফার পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে সারা দেশের বিভাগীয় পর্যায়ে সেমিনার করা হয়েছে। পুস্তিকা আকারে ঢাকার বিভিন্ন দূতাবাসসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে বিতরণ করা হয়েছে। এখন এর মূল কাঠামো পরিবর্তন করলে সবার মধ্যে নেতিবাচক ধারণার জন্ম নেবে।
নুরের দল নিয়ে সমস্যা দেখছে না বিএনপি : বিএনপি নেতৃত্বে যুগপত্ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী জোট গণতন্ত্র মঞ্চ থেকে গণঅধিকার পরিষদের বের হওয়ার বিষয়টি ওই জোটের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে মনে করছেন নেতারা। স্থায়ী কমিটির সভায় নেতারা বলেন, আন্দোলনে এর প্রভাব পড়বে না। সভায় দলের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বলেন, গণঅধিকার পরিষদ যুগপত্ আন্দোলনে থাকবে বলে তাঁকে জানিয়েছে।
খুলনায় যুবদলের সাবেক নেতাকে গুলি ও পায়ের রগ কেটে হত্যা
মুন্সীগঞ্জে ব্যবসায়ী খুন, আরো চার জেলায় তিন লাশ উদ্ধার
কালের কণ্ঠ ডেস্ক
কালের কণ্ঠ ডেস্ক
শেয়ার
মাহবুবুর রহমান
খুলনা মহানগরের দৌলতপুর থানা যুবদলের সাবেক সহসভাপতি মাহবুবুর রহমানকে (৪০) নিজ বাড়ির সামনে গুলি করে ও পায়ের রগ কেটে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। গতকাল শুক্রবার দুপুর দেড়টায় নগরের মহেশ্বরপাশা পশ্চিমপাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া মুন্সীগঞ্জে গত বৃহস্পতিবার রাতে ছুরিকাঘাতে এক ব্যবসায়ী খুন হন। গতকাল আরো তিন জেলায় তিন ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
খুলনা অফিস জানায়, খুলনা মহানগরের দৌলতপুর থানা যুবদলের সাবেক সহসভাপতি মাহবুবুর রহমানকে (৪০) নিজ বাড়ির সামনে গুলি করে ও পায়ের রগ কেটে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। গতকাল শুক্রবার দুপুর দেড়টার দিকে নগরের মহেশ্বরপাশা পশ্চিমপাড়ায় এ ঘটনা ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ জানায়, মাহবুবুর রহমানকে খুব কাছ থেকে প্রথমে গুলি করা হয়। পরে পায়ের রগ কেটে তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করে চলে যায় দুর্বৃত্তরা।
স্থানীয়রা দ্রুত তাঁকে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে জরুরি বিভাগে কর্মরত চিকিৎসক মাহবুবুরকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে তাঁর লাশ খুমেক হাসপাতাল মর্গে রাখা হয়। আজ শনিবার লাশের ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হতে পারে। নিহত মাহবুবুর রহমান মহেশ্বরপাশা পশ্চিমপাড়ার মো. আব্দুল করিম মোল্লার ছেলে।
খুলনা মহানগর পুলিশের (কেএমপি) দৌলতপুর থানার ওসি মীর আতাহার আলী বলেন, দুপুরে বাসার সামনে নিজের প্রাইভেট কার পরিষ্কার করছিলেন মাহবুবুর। ওই সময় হেলমেট পরা তিনজন একটি মোটরসাইকেলে এসে তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকে। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লে পরে মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার জন্য দুর্বৃত্তরা তাঁর দুই পায়ের রগ কেটে দেয়।
তিনি আরো জানান, মাদক বিক্রি নিয়ে প্রতিপক্ষ গ্রুপের সঙ্গে মাহাবুবুুরের দ্বন্দ্ব চলছিল। এর জেরে এ ঘটনা ঘটল কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তারে অভিযান শুরু হয়েছে।
ওসি জানান, ঘটনাস্থল থেকে চারটি গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়েছে। নিহতের মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুলি লেগেছে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। নিহত মাহবুবুরের বিরুদ্ধে আটটি মামলা রয়েছে।
এদিকে মাহবুবুরের হত্যার খবর পেয়ে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ছুটে যান খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট শফিকুল আলম মনাসহ বিএনপি, যুবদলসহ অন্যান্য অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা।
মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে মসজিদ থেকে বাসায় ফেরার পথে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে সাহেব আলী (৫৮) নামের এক ব্যবসায়ী নিহত হন গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টায়। উপজেলার মোড়াপাড়ায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত সাহেব আলীর ছেলে সোহাগ জানান, ‘আমার বাবা রাতে এশার নামাজ পড়ে বাসায় ফিরছিলেন। পথে দুর্বৃত্তরা তাঁকে ছুরিকাঘাত করে। পরে আমরা খবর পেয়ে তাঁকে দ্রুত স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে চিকিৎসক বাবাকে মৃত ঘোষণা করেন।’
এদিকে জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, কুষ্টিয়ায় একটি করে তিন ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। জামালপুর প্রতিনিধি জানান, গতকাল শুক্রবার বিকেলে জামালপুর শহরের দাপুনিয়ার ধানক্ষেতে কচুরিপানার ভেতর থেকে অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। জামালপুর সদর থানার ওসি আবু ফয়সল মো. আতিক বলেন, ‘লাশের পরিচয় এখনো শনাক্ত হয়নি। কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, কিশোরগঞ্জে নিখোঁজের পাঁচ দিন পর গতকাল রোজা মনি (৬) নামে এক শিশুর মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। বাড়ির পেছনে একটি পাটক্ষেত থেকে শিশুটির অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহত রোজা মনি সদর উপজেলার মারিয়া ইউনিয়নের চরমারিয়া গ্রামের মোহাম্মদ সুমন মিয়ার মেয়ে। কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, লাশ ময়নাতদন্তের জন্য শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে।
কুষ্টিয়া থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, গত বৃহস্পতিবার রাতে নিখোঁজ রফিকুল ইসলাম (৪৫) নামের ইজি বাইকচালকের ঝুলন্ত লাশ গতকাল শুক্রবার সকালে উদ্ধার করেছে পুলিশ। সদর উপজেলার মোল্লাতেঘরিয়ার একটি গাছ থেকে তাঁর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। রফিকুল ইসলাম কুষ্টিয়া পৌরসভার মোল্লাতেঘরিয়ার আদর্শপাড়ার মৃত দবির উদ্দিনের ছেলে।
ফরিদা পারভীনের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করার আহবান খালেদা জিয়ার
নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
শেয়ার
লালনসংগীতের বরেণ্য শিল্পী ফরিদা পারভীনের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। বিএনপির মিডিয়া সেল গতকাল শুক্রবার সাংবাদিকদের জানায়, রাজধানীর আয়শা মেমোরিয়াল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বরেণ্য শিল্পী ফরিদা পারভীনের খোঁজখবর নিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। গত বৃহস্পতিবার রাতে দলের যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্সকে হাসপাতালে পাঠিয়ে তিনি ফরিদা পারভীনের শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেন।
বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, খালেদা জিয়া অসুস্থ ফরিদা পারভীনের আরোগ্য কামনা করেন।
একজন গুণী শিল্পীর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করার আহবান জানিয়েছেন তিনি।
এর আগে গত বুধবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও হাসপাতালে যান। সেখানে তিনি উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে সরকারের দুই উপদেষ্টাকে ফোন করে অনুরোধ জানান। ওই সময় তিনি আর্থিক সহযোগিতাও করেন।
এদিকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ গতকাল জানায়, গত দুই দিন ফরিদা পারভীনের শারীরিক অবস্থার কোনো অবনতি হয়নি। বরং তাঁর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে ঝুঁকি রয়েছে। হাসপাতালটির ব্যবস্থাপনা ও জনসংযোগ শাখা জানিয়েছে, ফরিদা পারভীনের চিকিৎসার জন্য গত ৯ জুলাই বিকেল ও ১০ জুলাই সকালে দুই দফা মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়।
চিকিৎসকরা আন্তরিকভাবে তাঁর সুস্থতার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।
হাসপাতালটির একজন পরিচালক বলেন, ‘ফরিদা পারভীনের শারীরিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে খুব ধীরে। আমরা আশাবাদী, তবে চিন্তাও রয়ে যাচ্ছে। তাঁর বর্তমান শারীরিক অবস্থা যেকোনো সময় জটিল আকারে রূপ নিতে পারে। তাঁকে দ্রুত পুরোপুরি সুস্থ করে তুলতে আমরা আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ইতি গৌড়। ছবি : মোহাম্মদ আসাদ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতির পথচলা শুরু গত ২ জুলাই। প্রথম দিন ক্লাসে গিয়ে একটু অস্বস্তি লাগছিল তাঁর। সুরম্য ভবন। ঝলমলে ক্লাসরুম।
সহপাঠীদের চালচলনও একটু আলাদা। যে স্যারদের টিভি পর্দায় দেখেছেন, তাঁরাই চোখের সামনে। আগে কখনো এমন অভিজ্ঞতা হয়নি!
জড়তা কিছুটা কাটল কয়েকজন সহপাঠীর সঙ্গে পরিচয়ের পর। ক্লাস শেষে ক্যাম্পাসটা ঘুরে দেখলেন।
বিশেষ করে মল চত্বর আর অপরাজেয় বাংলা। বটতলায় বসে অপলকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন অপরাজেয় বাংলা ভাস্কর্যের দিকে। মনে মনে হয়তো ভাবছিলেন, দৃঢ়সংকল্প থাকলে মানুষ অসাধ্য সাধন করতে পারে; যার উদাহরণ তিনি নিজেই। না ছিল অর্থ, না ছিল সমর্থন।
সামনে কোনো উদাহরণও ছিল না। এসএসসির পর হারিয়েছিলেন মাকে। ঘরে অসুস্থ বাবা। এর পর থেকে কখনো চা-বাগানে মজুরি দিয়ে, কখনো সেলাইয়ের কাজ করে পড়ার খরচ জুগিয়েছেন। অভাব তাঁকে আটকাতে পারেনি।
অদম্য ইচ্ছা ও প্রাণপণ চেষ্টা তাঁকে শত বাধা পেরিয়ে চা-বাগান থেকে নিয়ে এসেছে স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভর্তি হয়েছেন পছন্দের ফিন্যান্স বিভাগে।
এর মধ্য দিয়ে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখালেন ইতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো বটেই, বরমচাল চা-বাগান থেকে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া প্রথম ছাত্রী তিনি।
আগেই ফোনে কথা হয়েছিল। কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম, ‘কী ভাবছেন?’
ভাবনায় ছেদ পড়া প্রশ্নে মুখ ঘোরালেন ইতি। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘না। তেমন কিছু না। অপরাজেয় বাংলাকে সামনে থেকে দেখব বলে কত কষ্ট যে করেছি! আজ মনে হয় কষ্ট সার্থক হয়েছে। আহা, মা যদি দেখে যেতে পারতেন!’
কঠিন ছিল সেসব দিন : পুরো নাম ইতি গৌড়। জন্ম মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল চা-বাগানে। তিন বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। মা ছিলেন চা শ্রমিক। বুঝতে শেখার পর থেকে ইতি দেখেছেন, সংসারে বিরাট হাঁ করে আছে অভাব। মা বাগানে কাজ করে যে মজুরি পেতেন, তা দিয়ে পাঁচটা মুখে খাবার জোগানো রীতিমতো সংগ্রাম। তিন বেলা পেট পুরে ভাত খাওয়াই যেন ছিল বিলাসিতা।
পরে তাঁর বাবা একটি প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তাকর্মীর কাজ নিলেন। চা-বাগানে তাঁর বয়সীদের অনেকে পাতা তোলার কাজে লেগে যায়। কিন্তু শৈশবেই ইতি বুঝে গিয়েছিলেন, দাসত্বের এই চক্র থেকে মুক্তির জন্য পড়াশোনার বিকল্প নেই। তাই সব কিছু সামলে পড়াশোনায় মন দিতেন। ক্লাসে বরাবর প্রথম সারিতে থাকত তাঁর নাম। বরমচাল চা-বাগানে তখন মধ্য ও দক্ষিণ বাংলাদেশ শিশু উন্নয়ন সংস্থা একটি প্রকল্প শুরু করে। দরিদ্র পরিবারের শিশুদের পড়াশোনার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। তারা ইতির পাশে ছিল।
সেলাইয়ের কাজ নিলেন : মায়ের রোগ-ব্যাধি লেগেই থাকত। অসুস্থ শরীর নিয়েও পাতা তুলতে যেতেন। ইতি তখন দশম শ্রেণির ছাত্রী, বাবা স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এক পর্যায়ে চাকরিটা চলে গেল। তত দিনে করোনা হানা দিয়েছে দেশে। ইতির স্কুলও বন্ধ। তখন তিনি স্থানীয় একজন দরজির কাছে সেলাই প্রশিক্ষণ নেন। কাজ শেখা হয়ে গেলে পড়াশোনার পাশাপাশি কাপড়ের দোকানে কাজ করতে লাগলেন।
হঠাৎ চলে গেলেন মা : বাবার চিকিৎসার টাকা জোগাড়ে মায়ের সঙ্গে মানুষের দ্বারে দ্বারে গেছেন ইতি। তাঁর এসএসসি পরীক্ষা ছিল ১৫ সেপ্টেম্বর। ৯ সেপ্টেম্বর বাবাকে নিয়ে ঢাকায় আসেন মা। চিকিৎসকরা জানিয়ে দিলেন, অস্ত্রোপচার লাগবে। পাঁচ-ছয় লাখ টাকা দরকার। কিন্তু এত টাকা তাঁরা পাবেন কোথায়? আটকে গেল বাবার চিকিৎসা। তাঁকে নিয়ে ফিরে গেলেন মা।
বাবার চিকিৎসার পেছনে দৌড়ে মা আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন। এত ঝুটঝামেলার মধ্যেই এসএসসি পরীক্ষা দেন ইতি। এসএসসির পর ইতি সকাল-সন্ধ্যায় কাজ করতেন কাপড়ের দোকানে। তখনো কলেজে ভর্তি হননি, হঠাৎ তাঁর মায়ের খুব জ্বর হলো। এক পর্যায়ে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ। মা আর ফিরলেন না, চিরতরে চলে গেলেন।
জীবিকার তাগিদে চা শ্রমিক : অসুস্থ বাবা বিছানায়, হুট করে মা-ও চলে গেলেন, সংসারে নেমে এলো ঘোর অন্ধকার। ভেবেছিলেন পড়াশোনা আর হবে না। কিন্তু ইতির প্রবল আগ্রহ দেখে বাগানের সবাই মিলে ভর্তি করিয়ে দিল ইউছুফ-গণি কলেজে। কিন্তু জীবিকার তাগিদে ক্লাস বাদ দিয়ে মায়ের জায়গায় চা পাতা তুলতে লাগলেন ইতি।
ইতি বলেন, ‘চা পাতা তোলার মতো এমন কষ্টের কাজ আর নেই। তবু বাধ্য হয়ে করতে হতো। মায়ের খুব ইচ্ছা ছিল আমাকে অনেক দূর পড়াবেন। আমি সেই স্বপ্ন পূরণ করতে চেয়েছি।’
ইতির কষ্ট দেখে এগিয়ে আসেন তাঁর মাসি। তিনিও চা শ্রমিক। বললেন, ‘এখন থাকি তুই হামার লগে থাকবি। আর কাজে যাতি হবি না। তুই কলেজে যা।’
যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন ইতি। আবার যেতে লাগলেন কলেজে। মাসি কাজে যেতেন, বাবা থাকতেন বাড়িতে। কলেজ থেকে ফিরে অন্যের কাপড় সেলাই করতেন ইতি। পাশাপাশি দুজন ছাত্র পড়াতেন। মাসে ২০০ টাকা দিত তারা। এভাবে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে জিপিএ ৪.৮৩ পেয়ে তিনি কলেজ পার হলেন।
স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে : কলেজে পড়ার সময় এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে জেনেছিলেন, পরীক্ষায় টিকলে গুড্ডি ফাউন্ডেশন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিংয়ের জন্য বৃত্তি মিলবে। সেখানে নির্বাচিত হয়ে বিনা পয়সায় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিংয়ের সুযোগ পান ইতি।
ঢাকা, শাহজালাল, জাহাঙ্গীরনগর ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছেন। সুযোগ পেয়েছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু অর্থাভাবে ভর্তি নিয়ে অনিশ্চয়তায় ছিলেন ইতি। এই প্রতিবেদকের মাধ্যমে খবর পেয়ে ইতির ভর্তি সহায়তায় এগিয়ে আসেন শতাধিক দেশ ভ্রমণ করা বাংলাদেশি দম্পতি রেজাউল বাহার ও শারমীন শাহরিয়াত। গত ২৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগে ভর্তি হয়েছেন ইতি।
শেষ হয়নি লড়াই : ইতির সংগ্রাম এখনো শেষ হয়নি। ঘরে অসুস্থ বাবাকে রেখে এসেছেন। ঢাকায়ও তিনি একেবারেই নতুন। আপাতত একটি মেসে উঠেছেন। প্রতিকূলতাকে জয় করে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ ভালোভাবে উতরাতে চান তিনি। লেখাপড়া শেষে হতে চান চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। প্রতিষ্ঠিত হয়ে দাঁড়াতে চান তাঁর মতো হাজারো তরুণীর পাশে। নতুন করে লিখতে চান চা-বাগানের পিছিয়ে পড়া তরুণীদের গল্প।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ২০২৪ সালের ১১ জুলাই হামলা করে পুলিশ। এর প্রতিবাদে আজকের এই দিনে (শনিবার) ছুটির দিন হওয়া সত্ত্বেও রাজপথে নামেন শিক্ষার্থীরা। ১২ জুলাই (শুক্রবার) সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেন আন্দোলনকারীরা।
পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী, বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে আন্দোলনকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) গ্রন্থাগার চত্বরে জড়ো হতে থাকেন।
বিকেল ৫টার দিকে মিছিল নিয়ে শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেন তাঁরা। পরে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরাও যোগ দেন মিছিলে। শাহবাগ মোড়ে এক ঘণ্টার বেশি সময় সড়ক অবরোধ করে রাখেন তাঁরা।
আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার শাহবাগে বলেন, ‘শনিবার (১৩ জুলাই) দেশের ৬৪ জেলায় অনলাইন ও অফলাইনে প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।
সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের সামনে সংবাদ সম্মেলন করে আমরা পরবর্তী কর্মসূচি জানিয়ে দেব।’
সেদিন রাজধানীর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নেন। বিকেল সাড়ে ৪টায় কলা ভবনের সামনে থেকে শুরু হয়ে মিছিলটি বাহাদুর শাহ পার্ক ও কবি নজরুল কলেজ এলাকা ঘুরে ক্যাম্পাসে গিয়ে শেষ হয়।
ঢাকার বাইরে অন্তত ১৫টি জেলায় বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়।
রাজশাহীতে শিক্ষার্থীরা ঢাকা-রাজশাহী রেলপথ অবরোধ করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীরাও এই কর্মসূচিতে অংশ নেন।
চট্টগ্রাম নগরের ষোলশহর রেলস্টেশন থেকে বিকেল ৫টায় মিছিল বের হয়। তাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন কলেজ ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ও সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) মশাল মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা।
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ শেষে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থান নিতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস থেকে মিছিল বের করেন। ওই দিন একটি স্থানের নামকরণ ‘ছাত্র আন্দোলন চত্বর’ করা হয়। ময়মনসিংহে আনন্দ মোহন কলেজ, মুমিনুন্নেছা কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে অংশ নেন।
এ ছাড়া কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নীলফামারীর সৈয়দপুর, বগুড়া ও নোয়াখালীতেও শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন।
সেদিন রাতে শাহবাগ থানায় শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর ও সদস্যদের মারধরের অভিযোগে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে এই মামলা করা হয়।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের বিষয়ে বলেন, ‘যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, যারা ষড়যন্ত্র করে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছিল—সেই প্রেতাত্মারা যে এ ষড়যন্ত্রে নেই, তা বলা যায় না। সরকার জনগণের জান-মাল রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এই আন্দোলনে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপশক্তির প্রভাব স্পষ্ট।’
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আদালতের প্রতি সবার আস্থা রাখা উচিত। আন্দোলনের নামে কেউ আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’