কালের কণ্ঠ : মিয়ানমারের পরিস্থিতি এখন কেমন?
জন কুইনলি : অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার দুই বছর পেরিয়ে গেছে। অভ্যুত্থানের পর থেকেই মিয়ানমারে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন, সহিংসতার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করছে ফোরটিফাই রাইটস। এ থেকে দেখা যায়, হত্যা, গ্রেপ্তার, নির্যাতন, গুমসহ মানবতাবিরোধী অপরাধও সংঘটিত হচ্ছে সেখানে।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশের সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য।
সংখ্যায় কম হলেও ইউএনএইচসিআরের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় রোহিঙ্গাদের যাওয়া শুরু হয়েছে। অন্য দেশগুলোরও এগিয়ে আসা উচিত। রোহিঙ্গাদের বোঝা বহনের দায়িত্ব শুধু বাংলাদেশের নয়।
মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সময় ইঙ্গিত দিয়েছে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন পরিকল্পনা এখনো চলছে। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। কারণ তা বাস্তবসম্মত নয়। আমরা বিশ্বাস করি, জান্তাবিরোধী জাতীয় ঐক্য সরকার মিয়ানমারে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হবে। তখন রোহিঙ্গারা ফিরতে পারে। এই পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গারা ফিরে চাইবে না। তাদের জোর করে পাঠানোও ঠিক হবে না।
কালের কণ্ঠ : জান্তাবিরোধী শক্তিকে বিদেশ থেকে অস্ত্র সহায়তা দিলে তার প্রভাব প্রতিবেশীদের ওপরও পড়তে পারে। এমনকি জান্তাবিরোধী পক্ষ প্রতিবেশীদের সহযোগিতা চাইতে পারে—এমন আশঙ্কাও করছেন অনেকে।
জন কুইনলি : এ বিষয়ে আমি ঠিক জানি না। তবে জান্তা দুর্বল হলেও থামার কোনো লক্ষণ নেই। আগামী মাসগুলোতে মিয়ানমারে আরো সহিংসতা, বাস্তুচ্যুতি দেখা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারতসহ অন্য প্রতিবেশী দেশগুলোতে আবারও নতুন করে মিয়ানমারের আশ্রয়প্রার্থীদের দেখা যেতে পারে। এটি নতুন আঞ্চলিক সমস্যা হিসেবেও দেখা দিতে পারে।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের শূন্য রেখায় গত মাসে রোহিঙ্গা দুটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার বলছে, ওই এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও)।
জন কুইনলি : আমরাও শুনেছি, শূন্য রেখায় আরএসও-আরসা লড়াই হয়েছে। তবে সংঘাতের সময় সেখানে অবস্থানরত কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে ফোরটিফাই রাইটস কথা বলেছে। তাদের দাবি, তারা সাধারণ রোহিঙ্গা। তারা আরসা, আরএসও বা কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠীর নয়। তবে তারা লোকজনকে লড়াই করতে, ঘরে আগুন দিতে দেখেছে। এরপর সেখান থেকে সাধারণ রোহিঙ্গাদের অন্যত্র সরে যেতে হয়েছে। এটি কোনো ভালো খবর নয়।
কালের কণ্ঠ : কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়শিবিরেও ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা)’ বিরুদ্ধে পোস্টার দেখা গেছে।
জন কুইনলি : বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শিবিরে বেশ কিছু ‘নন স্টেট অ্যাক্টর’ (রাষ্ট্রীয় কোনো বাহিনী নয়) আছে। এর মধ্যে আরসা, আরএসওর মতো রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক, সশস্ত্র গোষ্ঠীও আছে। মাদক চোরাকারবারিও সেখানে সক্রিয়। পাঁচ বছর ধরে এই গোষ্ঠীগুলো রোহিঙ্গাদের অপহরণ, হত্যাসহ নানা ধরনের অপরাধ করছে। ফোরটিফাই রাইটস এসব তথ্য-উপাত্তও সংগ্রহ করছে।
কালের কণ্ঠ : অপরাধের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে ফোরটিফাই রাইটস কী ধরনের কাজ করে?
জন কুইনলি : ফোরটিফাই রাইটস সম্প্রতি ‘সর্বজনীন বিচারিক এখতিয়ারের’ আওতায় মিয়ানমারের কিছু ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে জার্মানির আদালতে মামলা করেছে। ওই মামলার শুনানি এখনো শুরু হয়নি। আমরা আশা করছি, জার্মান প্রসিকিউটর ওই মামলা শুরু করবেন। মামলায় কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের আগে ও পরে জেনোসাইড, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে।
মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত (আইসিজে), আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে (আইসিসি) মামলা চলছে। জাতিসংঘের মিয়ানমারবিষয়ক কাঠামো আইআইএমএম মিয়ানমারে অপরাধের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, যাচাই ও সংরক্ষণ করছে। আমাদের সহকর্মী তুন খিন আর্জেন্টিনায় মামলা করেছেন। মিয়ানমারে নির্যাতন নিয়ে মামলা চলছে তুরস্কেও।
বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার জন্য বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের প্রতি ফোরটিফাই রাইটস আহ্বান জানিয়ে আসছে। কারণ যতক্ষণ তারা বাংলাদেশে আছে ততক্ষণ তাদের সুরক্ষাসহ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বাংলাদেশের।
কালের কণ্ঠ : মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী জাতীয় ঐক্য সরকার এখন দেশটির ৬০ শতাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে—এমন তথ্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে।
জন কুইনলি : এনইউজি এখন মিয়ানমার ভূখণ্ডের কতটা নিয়ন্ত্রণ করছে, সে বিষয়ে আমার কাছে তথ্য নেই। তবে এনইউজিই এখন মিয়ানমারের বেশির ভাগ এলাকায় প্রশাসন চালাচ্ছে, স্বাস্থ্যসহ মৌলিক সেবা দিচ্ছে। জান্তা বর্বরতা ছাড়া কিছুই দিতে পারছে না। আমি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করি, এনইউজিই মিয়ানমারের নির্বাচিত সরকার। বিশ্বজুড়ে সরকারগুলো মিয়ানমারের জান্তার সঙ্গে সম্পৃক্ততা বন্ধ করে দিয়েছে। মিয়ানমারের সরকার হিসেবে তারা এনইউজির সঙ্গে যোগাযোগ করছে। এখন মিয়ানমারের জনগণ, মানবাধিকারকে সম্মান জানিয়ে নীতি গ্রহণ করা উচিত। মিয়ানমারের জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই জোরালো হচ্ছে এবং সাফল্যও দেখা যাচ্ছে।
কালের কণ্ঠ : জান্তা আগামী নির্বাচন সামনে রেখে নতুন করে বিধি-নিষেধ জারি করছে।
জন কুইনলি : মিয়ানমারের জনগণ অভিন্ন এক শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ছে। আর সেই শত্রুটি হলো জান্তা। নির্বাচনের আগে জান্তা পুরো দেশে মার্শাল ল দিচ্ছে। কর্তৃপক্ষ হিসেবে জান্তা নিজেই অবৈধ। তাই মিয়ানমারের নির্বাচনকে কারো সমর্থন করা উচিত নয়।
কালের কণ্ঠ : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
জন কুইনলি : কালের কণ্ঠকেও ধন্যবাদ।