<p>জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের আবহাওয়ার চরমভাবাপন্নতা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধির বিষয়টিই মূলত আলোচনায় আসে। এবার বাংলাদেশে রোগব্যাধির বিস্তার ও জনস্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাবের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছে বিশ্বব্যাংক। ‘দ্য ক্লাইমেট অ্যাফ্লিকশনস’ (জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব) রিপোর্ট নামে গতকাল বৃহস্পতিবার প্রকাশিত নতুন এক প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক সংস্থাটি বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সংক্রামক ব্যাধি বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশবাসীর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।</p> <p>বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে গত ৪৪ বছরে বাংলাদেশের তাপমাত্রা ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রীষ্মকালে আগের তুলনায় যেমন বেশি গরম পড়ছে, তেমনি তা দীর্ঘতর হচ্ছে। অন্যদিকে শীতকাল তুলনামূলকভাবে হচ্ছে উষ্ণতর। বর্ষা মৌসুমের মেয়াদ বেড়ে গেছে। মৌসুমি বায়ুর তৎপরতা চলছে এখন ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে ঋতুগুলোর মধ্যকার তফাত ক্রমেই মিলিয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা ১.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে।</p> <p><img alt="" src="http://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/ckfinder/innerfiles/images/Print Version Online/print /2021/10.October/08-10-2021/121/Untitled-1.jpg" style="float:left; height:311px; margin:12px; width:400px" />বিশ্বব্যাংক বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে শ্বাসতন্ত্রের এবং পানি ও মশাবাহিত রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি এর সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যারও যোগসূত্র রয়েছে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে শিশু ও বয়স্করা। আর অঞ্চল হিসেবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো বড় নগরে বসবাসকারীরা।</p> <p>প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আবহাওয়ার খামখেয়ালি আচরণ ঢাকা মহানগরে ২০১৯ সালের ডেঙ্গু মহামারির এক বড় কারণ ছিল। সে বছর দেশে ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যুর ৭৭ শতাংশই ঘটে এ মহানগরে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় সে মাসের গড় হারের চেয়ে তিন গুণ বেশি বৃষ্টি হয়েছিল। পরের মার্চ থেকে জুলাইয়ের মধ্যে ছিল উচ্চ তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা।</p> <p>প্রতিবেদনে বলা হয়, শুকনো মৌসুমে সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বর্ষাকালের চেয়ে ২০ শতাংশ কম। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে শ্বাসতন্ত্রের অসুখবিসুখ বৃদ্ধি পায়। তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি বাড়লে শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায় ৫.৭ শতাংশ। আর আর্দ্রতা ১ শতাংশ বৃদ্ধির ফলে শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে ১.৫ শতাংশ।</p> <p>প্রতিবেদনে বলা হয়, সারা বছরের বিবেচনায় প্রাণী ও অণুজীবের মতো জীবিত বাহকের মাধ্যমে ছড়ানো এবং পানিবাহিত রোগের তুলনায় দেশে শ্বাসতন্ত্রের রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। জাতীয় এবং অন্যান্য শহর ও গ্রাম এলাকার হারের তুলনায় শুকনো মৌসুমে শ্বাসতন্ত্রের অসুস্থতার হার সবচেয়ে বেশি ঢাকা ও চট্টগ্রাম নগরে, ৬৬ শতাংশ। জীবিত বাহক থেকে ছড়ানো রোগের হার ঢাকা ও চট্টগ্রামে বেশি, যা বর্ষা মৌসুমে ৩৪ শতাংশ। জাতীয় পর্যায়ে বর্ষাকালে মাত্র ১৪ শতাংশ লোক কোনো পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হলেও শুকনো মৌসুমে তা বেড়ে গিয়ে ২৩ শতাংশে ওঠে।</p> <p>আবহাওয়ার ধরনে রদবদল মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও প্রভাব ফেলছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, শীতকালে বেশি মানুষ বিষণ্নতায় ভোগে। অন্যদিকে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে উদ্বেগজনিত রোগের মাত্রা। পুরুষের তুলনায় নারীদের মধ্যে বিষণ্নতার সমস্যা বেশি। অন্যদিকে তুলনামূলকভাবে উদ্বেগের সমস্যায় বেশি ভোগে পুরুষরা।</p> <p>প্রতিবেদনের বক্তব্য নিয়ে বাংলাদেশ ও ভুটানের দায়িত্বে থাকা বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর মার্সি টেম্বন বলেছেন, ‘বাংলাদেশ সবচেয়ে বিপন্ন দেশগুলোর অন্যতম হওয়া সত্ত্বেও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত চ্যালেঞ্জগুলো লক্ষণীয়ভাবে মোকাবেলা করেছে। এই দেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামলে নেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করেছে এবং কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির দেশীয় সমাধান বের করেছে।’</p> <p>কান্ট্রি ডিরেক্টর টেম্বন পাশাপাশি স্বাস্থ্যক্ষেত্রে অধিকতর উদ্যোগ গ্রহণেরও তাগিদ দিয়েছেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের সুস্পষ্ট প্রভাবের বিষয়ে আরো বেশি সাক্ষ্য-প্রমাণ উঠে এসেছে। তাই বাংলাদেশকে এখন অভিযোজনের ক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্যের ওপর নির্ভর করে নতুন নতুন জলবায়ুসংশ্লিষ্ট রোগব্যাধির বিস্তার রোধ করতে একটি অধিকতর শক্তিশালী স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।’</p> <p>বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র অপারেশনস অফিসার এবং প্রতিবেদনের অন্যতম রচয়িতা ইফফাত মাহমুদ এ প্রসঙ্গে বলেছেন, জোরদার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ নিশ্চিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশ জলবায়ুসংশ্লিষ্ট রোগের বিষয়গুলো আরো ভালোভাবে অনুসরণ করতে পারবে। বিশেষ করে স্থানীয় পর্যায়ে আবহাওয়ার নিখুঁত উপাত্ত রেকর্ড করে এবং তাকে স্বাস্থ্যের তথ্য-উপাত্তের সঙ্গে যুক্ত করে রোগের সম্ভাব্য প্রাদুর্ভাবের পূর্বাভাস দেওয়া এবং জলবায়ুভিত্তিক আগাম ডেঙ্গু সতর্কীকরণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে।</p> <p>স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমীন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনজনিত রোগব্যাধির দিকে নজর রেখে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক শাখা কাজ করছে। এরই মধ্যে একাধিক জরিপ হয়েছে। অন্যদিকে কিভাবে জলবায়ুজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানো যায় বা এসব রোগে আক্রান্তদের সেবার পরিধি বাড়ানো যায়, তা নিয়েও আমাদের পরিকল্পনা চলছে।’</p> <p>জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. বে-নজীর আহম্মেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভেক্টর বর্ন ডিজিজগুলোর (বিভিন্ন প্রাণী/অণুজীববাহিত রোগ) সঙ্গে যেহেতু তাপমাত্রার যোগসূত্র আছে, তাই এ ক্ষেত্রে জলবায়ুর প্রভাব আছে। তবে পরিবেশের সব কিছুই জলবায়ুর পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত নয়। মানুষের আচরণগত বিষয়গুলোও অনেক ক্ষেত্রেই মুখ্য ভূমিকা রাখছে। যেমন—ভাইরাস কখনো বাড়ে, আবার কখনো কমে যায়। এডিস মশার প্রজনন উপযোগী পরিবেশ না থাকলে তাপমাত্রা যা-ই থাকুক, ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটবে না। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঢাকা বা চট্টগ্রামে এসব রোগ বেড়েছে—এমন তথ্য থেকে অন্য আরো গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলো চাপা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’</p> <p>পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সঞ্জয় কুমার ভৌমিক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট এখনো আমরা পাইনি। তবে এ ধরনের কোনো রিপোর্ট পেলে আমরা সাধারণত টেকনিক্যাল কমিটির মাধ্যমে যাচাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিই। আমরা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় মুজিববর্ষেই তিন কোটি গাছ লাগানোসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছি।’</p>