বরিশালে ইউএনওর বাসভবনে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় অবশেষে দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে। গতকাল রবিবার রাত সোয়া ৯টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত বরিশাল বিভাগীয় কমিশনারের বাসভবনে এক বৈঠকে এই সমঝোতা হয়। তবে কোন শর্তে সমঝোতা হয়েছে, সে বিষয়ে রাত ১টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোনো পক্ষই আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি।
বৈঠকে বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ, বিভাগীয় কমিশনার সাইফুল ইসলাম বাদল, পুলিশ কমিশনার শাহাবুদ্দিন খান, জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন হায়দার, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক শেষে তাঁরা একসঙ্গে একটি ছবিও তোলেন, যা ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। তবে বৈঠকে ইউএনও মুনিবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন না।
তবে মহানগর আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা জানিয়েছেন, মেয়রের আহ্বানে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক ইতিবাচক হয়েছে।
মামলা প্রত্যাহারসহ দুই পক্ষই সমঝোতায় একমত হয়েছে।
এর আগে গতকাল বরিশালের অতিরিক্ত মহানগর হাকিম মাসুম বিল্লাহর আদালতে বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুনিবুর রহমান ও কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি নুরুল ইসলামসহ আরো কয়েকজনের বিরুদ্ধে দুটি মামলার আবেদন করে সিটি করপোরেশন। আদালত অভিযোগ দুটি আমলে নিয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্ত করে আগামী ২৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। মামলা দুটির মধ্যে একটির আবেদন করেছেন বরিশাল সিটি করপোরেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা বাবুল হালদার এবং অন্যটি সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র ও জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম খোকন।
দুটি মামলায়ই ইউএনওকে প্রধান আসামি করা হয়েছে।
এর আগে বৃহস্পতিবার দুপুরে ইউএনওর বাসভবনে হামলার অভিযোগে পুলিশের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের কর্মচারী, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনায় ইউএনও ও পুলিশ বাদী হয়ে দুটি মামলা করেন। সেই দুই মামলায়ই বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহকে প্রধান আসামি করা হয়। একই ঘটনায় সিটি করপোরেশন ও আওয়ামী লীগের নেতারাও থানায় মামলা করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু তখন ওসি তাঁদের মামলা নেননি।
গতকাল সচিবালয়ে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, মেয়রের সঙ্গে প্রশাসনের বিরোধ ও পাল্টাপাল্টি মামলার ঘটনাটি ‘ভুল বোঝাবুঝি’ থেকে হয়েছে, এটা অচিরেই মিটে যাবে।
আদালত সূত্র জানায়, রফিকুল ইসলাম খোকনের মামলায় ইউএনও মুনিবুর রহমান, ওসি নুরুল ইসলাম ও এসআই শাহজালাল মল্লিককে আসামি করা হয়েছে। অভিযোগে পাঁচ আনসার সদস্যকেও আসামি করা হলেও তাঁদের নাম উল্লেখ করা হয়নি। এ ছাড়া অজ্ঞাতপরিচয় আরো ৪০-৫০ জনকেও আসামি করা হয়। অন্যদিকে বাবুল হালদারের অভিযোগে ইউএনও মুনিবুর রহমানসহ পাঁচ আনসার সদস্যকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া অজ্ঞাতপরিচয় আরো ৪০-৫০ জনকে আসামি করা হয়।
মামলায় ইউএনও মুনিবুরের বিরুদ্ধে সরকারি চাকরির সুবাদে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা, ষড়যন্ত্রমূলকভাবে জনগণের জানমালের ক্ষতিসাধন করা এবং দেশে অরাজকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করার অভিযোগ করা হয়েছে। পাশাপাশি আসামিদের বিরুদ্ধে সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর সম্মান ক্ষুণ্ন করার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থেকে বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করার অভিযোগ করা হয়েছে।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, কাউন্সিলরদের সমন্বয়ে সভার মাধ্যমে সিটি করপোরেশন এলাকাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য শহরের বিভিন্ন অলিগলিতে টানানো ব্যানার-ফেস্টুন নামিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ শুরু করেন পরিচ্ছন্নকর্মীরা। গত ১৮ আগস্ট রাতে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা নগরের ২৩ নম্বর ওয়ার্ডে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের বিভিন্ন ব্যানার-ফেস্টুন অপসারণকালে ইউএনওর নেতৃত্বে আনসার সদস্যরা বাধা দেন। বিষয়টি মামলার এক নম্বর সাক্ষী বিসিসির প্রশাসনিক কর্মকর্তা স্বপন কুমার দাসের কাছ থেকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে জানতে পারেন সিটি মেয়র। পরে তিনি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে ইউএনওর কার্যালয়ের সামনে উপস্থিত হন। এ সময় মেয়র নিজের পরিচয় দেওয়া সত্ত্বেও ইউএনও উত্তেজিত হন। এমনকি ষড়যন্ত্রমূলকভাবে পরিকল্পনা অনুযায়ী মেয়রসহ তাঁর সঙ্গে থাকা সবার ওপর গুলি করার জন্য এগিয়ে যান। এ সময় ইউএনওর হুকুমে আনসার সদস্যরা মেয়রকে খুন করার উদ্দেশ্যে তাঁকে লক্ষ্য করে শটগান দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করে। পরে ঘটনাস্থলে থাকা লোকজন মানবপ্রাচীর তৈরি করে মেয়রকে রক্ষা করে গাড়িতে উঠিয়ে দেন।
মামলার অভিযোগে আরো বলা হয়, এ খবর ছড়িয়ে পড়লে সিটি করপোরেশনের স্টাফসহ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা সেখানে জড়ো হন। তখনো উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আনসার সদস্যদের তাদের ওপরও গুলি বর্ষণের নির্দেশ দেন। এরপর পুলিশ এসে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। গুলিবর্ষণ ও পুলিশের লাঠিচার্জে ৫০ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মোটরসাইকেল ভাঙচুর ও ১০০টি মোটরসাইকেল গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে এক কোটি টাকার ক্ষতিসাধন করে। ইউএনও দীর্ঘদিন ধরে শত্রুপক্ষের অবৈধ অর্থে প্রভাবিত হয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে মেয়রকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলিবর্ষণ করে গুরুতর অপরাধ করেছেন। থানায় মামলা করতে গেলে সেখানে অভিযোগ না নেওয়ায় আদালতে অভিযোগ দাখিলে বিলম্ব হয়েছে বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে।
মামলার বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট তালুকদার ইউনুস বলেন, বরিশাল সদরের ইউএনও মুনিবুর রহমানকে প্রধান অভিযুক্ত করে দুটি অভিযোগ আদালতে দায়ের করা হয়েছে। সেখানে আনসার বাহিনীর সদস্যসহ অন্যরা আসামি রয়েছেন। মামলা দুটির বাদীর জবানবন্দি নিয়েছেন আদালত।
মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট এ কে এম জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘সিটি মেয়রসহ দলীয় নেতাকর্মীরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে আহত হয়েছেন। দুই কর্মী গুলিতে চোখ হারাচ্ছেন। তাঁদের আইনি সহায়তা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। মূলত সে কারণেই আমরা আদালতে যেতে বাধ্য হয়েছি। আমাদের বিশ্বাস নেতাকর্মীরা ন্যায় বিচার পাবেন।’
মহানগর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি অ্যাডভোকেট আফজালুল করিম বলেন, ‘মামলার সঙ্গে সমঝোতা সাংঘর্ষিক নয়। শোকের মাসে আমরা ওই ঘটনার ব্যাপারে রাস্তায় নামিনি। কোনো কর্মসূচি দিইনি। যদি কর্মসূচি দিতাম তবেই সমঝোতায় দূরত্ব সৃষ্টি হতো।’
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুটি মামলা হয়। এর একটির বাদী হন ইউএনও নিজে এবং অন্যটির বাদী এসআই শাহজালাল মল্লিক। পুলিশের করা মামলায় গ্রেপ্তার ২১ আসামির মধ্যে ১৮ জনকে গতকাল সকালে আদালতে হাজির করে তাঁদের জামিন আবেদন করা হয়। অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাসুম বিল্লাহ জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তাঁদের জেলা কারাগারে পাঠান। একই সঙ্গে তাঁদের সুচিকিৎসা দেওয়ার নির্দেশ দেন আদালত।
গত ১৮ আগস্ট রাতে নগরের সিঅ্যান্ডবি সড়কে উপজেলা পরিষদ কম্পাউন্ডে শোক দিবস উপলক্ষে টানানো রাজনৈতিক ব্যানার অপসারণকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে রাতভর সংঘর্ষ হয়। এ সময় ইউএনওর সরকারি বাসভবনেও হামলার অভিযোগ করা হয়।