<p>বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির প্রভাব, জলবায়ু পরিবর্তন এবং স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উত্তীর্ণ হওয়ার বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে দেশ। এর মধ্যেই অভ্যন্তরীণ ও বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অক্ষুণ্ন রেখে দেশে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা একটি কঠিন কাজ। তবে এমন পরিস্থিতি সামাল দিতে গত দুই বছরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নেওয়া অনেক উদ্যোগ প্রশংসিত হয়েছে।</p> <p>বাজার বিশ্লেষক, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নানা প্রতিকূলতার পরও বাজার স্থিতিশীল রাখার প্রচেষ্টায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাফল্য ছিল প্রশংসনীয়। এ ক্ষেত্রে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।</p> <p>বাজার স্থিতিশীল রাখার উদ্যোগ হিসেবে ঈদুল ফিতর উপলক্ষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ‘বিশেষ সেবা সপ্তাহ’ আজ শুক্রবার থেকে শুরু হয়ে চলবে ৬ মে পর্যন্ত। গতকাল বৃহস্পতিবার মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।</p> <p>বাজার বিশ্লেষকরা বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভালো ভালো উদ্যোগ থাকলেও সেগুলো বাস্তবায়নে যে ধরনের সক্ষমতার দরকার ছিল, সেখানে কিছুটা ঘাটতিও দেখা গেছে। তবে এটা ইতিবাচক যে বাণিজ্যমন্ত্রী নিজে একজন সফল ব্যবসায়ী হওয়ার ফলে ব্যবসায়ীদের অপকৌশল নিয়ন্ত্রণ তাঁর জন্য সহজ হয়। এ ছাড়া তিনি একই সঙ্গে জনবান্ধব ও ব্যবসাবান্ধব হওয়ায় বাজার নিয়ন্ত্রিত ও স্থিতিশীল ছিল। </p> <p>এ বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সাধারণ মানুষের নিত্যপণ্যের বাজার ঠিক রাখা প্রতিবছর একটা চ্যালেঞ্জ হলেও মন্ত্রণালয়ের সময়োপযোগী ও সমন্বিত সিদ্ধান্তের ফলে এখন প্রান্তিক মানুষের আর পণ্যের অভাব হয় না। উচ্চমূল্যের কারণে ফিরে যেতে হয় না ঘরে। অনেক সময় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অপকৌশলে বাজার অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা করলেও মন্ত্রণালয় শক্ত উদ্যোগ নেয়। এর ফলে খুব কম সময়ে অভ্যন্তরীণ বাজার নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। করোনা ও রোজায়ও তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি।’</p> <p>বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, পেঁয়াজ ও ভোজ্য তেলের আন্তর্জাতিক বাজারনির্ভরতার কারণে অনেক সময় স্থানীয় বাজার সামাল দিতে সমস্যা হয়। কিন্তু সরকারের আন্ত মন্ত্রণালয় উদ্যোগ, বেসরকারি বাণিজ্যিক সংগঠন ও দেশের বড় বড় শিল্প গ্রুপের সহযোগিতায় এসব সংকট থেকেও সহজে উত্তরণ সম্ভব হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ‘টিম কমার্স’ সদস্যদের নিয়মিত বাজার পর্যালোচনা বৈঠক থেকে উদ্ভাবনী পরিকল্পনার মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি সহজ হয়েছে।</p> <p>জানতে চাইলে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রোজা ও করোনায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ ছিল বেশ প্রশংসনীয়। বিশেষ করে বাজার ব্যবস্থাপনা, চাহিদা ও জোগান  ঠিক রাখার পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে উৎপাদনে তাদের ভূমিকা ছিল লক্ষণীয়। এ সময়ে কোনো এক দেশ থেকে না এনে বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্য এনে পেঁয়াজের নতুন উৎস দেশ তৈরি করা হয়েছে। এর ফলে সরবরাহ লাইনে কোনো সংকট তৈরি হয়নি।’</p> <p>নাজের হোসাইন আরো বলেন, সম্প্রতি ব্যবসায়ীদের ভোজ্য তেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান ছিল একটি সাহসী পদক্ষেপ। বাজারে পর্যাপ্ত তেলও আছে। রোজায় যেসব ভোগ্য পণ্য বেশি প্রয়োজন হয়, সেগুলোর মজুদ ও আমদানি পর্যাপ্ত আছে। ফলে কোনো পণ্যের সংকট হবে না।</p> <p>ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পণ্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে ভোক্তা পর্যায়ে সহজে পৌঁছে দেওয়া সবচেয়ে সুন্দর উদ্ভাবনী উদ্যোগ ছিল বলে মনে করেন বাণিজ্য বিশ্লেষকরা। তাঁরা বলছেন, এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পেঁয়াজ, ভোজ্য তেলসহ বেশ কয়েকটি পণ্য ভোক্তার নাগালের মধ্যে নিয়ে আসা হয়। তাঁরা আরো বলেন, নানা প্রতিকূলতার পরও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাণিজ্যিক সংগঠন টিসিবির সেবার সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। ট্রাক সেলের পরিমাণ ও পরিধি বেড়েছে বহুগুণ। গতানুগতিকতা থেকে বের হয়ে বাণিজ্যসচিবের নেতৃত্বে ‘টিম কমার্সের’ সদস্যরা সরাসরি বাজার নজরদারি করেছেন।</p> <p>মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বাজারে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ থাকে না উল্লেখ করে বাণিজ্যসচিব ড. জাফর আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্য তেলের দাম বাড়লেও এই খাতের সংগঠনের সঙ্গে বসে মূল্যে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এর পরও বাজার যখন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে, তখন সরকার বসে থাকতে পারে না। সরকারের আন্ত মন্ত্রণালয় সমন্বয়ের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের সঙ্গে সরকারি খাতের সমন্বয়ের ফলে তেলের মূল্য স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হয়েছে।’</p> <p>বাজারে পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে ব্যবসায়ীদের প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা দেওয়া হয় উল্লেখ করে বাণিজ্যসচিব আরো বলেন, ‘কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্ক সুবিধা দেওয়া হয়। রপ্তানি বাড়াতে নগদ প্রণোদনা দেওয়া হয়। বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এক্সপোর্ট কম্পিটিটিভনেস ফর জব (ইসিফোরজে) নামে একটি প্রকল্প নিয়েছে। এর আওতায় পণ্য বহুমুখীকরণ ও কর্মসংস্থানও হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় ব্যক্তিগত সুরক্ষার পণ্য (পিপিই), রোগ নির্ণয়ের কিটস ও মেডিক্যাল পণ্য তৈরির জন্য উদ্যোক্তাদের ৫০ হাজার থেকে পাঁচ লাখ ডলার পর্যন্ত সহায়তাও (ম্যাচিং গ্র্যান্ট) দিচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।</p> <p>বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বাড়াতে যেসব দেশের সঙ্গে অগ্রাধিকার বাজার সুবিধা নেই, ওই সব দেশের সঙ্গে প্রেফারেন্স ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (পিটিএ) ও ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (এফটিএ) করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে ভুটানের সঙ্গে প্রথম পিটিএ হয়েছে, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে শিগগিরই চুক্তি হবে। এর ফলে ২০২৬ সালে বাংলাদেশ যেসব দেশ থেকে অগ্রাধিকার বাজার সুবিধা (জিএসপি) হারানোর আশঙ্কা করছে, সেই ধাক্কা সামাল দেওয়া যাবে বলে আশা করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।</p> <p>বাজার ও রপ্তানি পণ্য বহুমুখী করার ক্ষেত্রে তৈরি পোশাক খাতের ওপর একক নির্ভরতা কমাতে বিদেশে ২১টি মিশনে বাণিজ্যিক ডেস্ক খোলা হয়েছে। ওই সব উইংয়ের কর্মকর্তাদের মাধমে ১৭টি পণ্য চিহ্নিত করা হয়েছে। মিশন কর্মকর্তাদের পরিকল্পনা ও পরামর্শে সেসব দেশে ওই পণ্যগুলো বাজারজাত করা হবে।</p> <p>পোশাক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, করোনার প্রথম ধাপে পোশাক কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত হওয়ায় দেশের পোশাক রপ্তানিতে বড় ধরনের ধস নামার আশঙ্কা করা হয়। এ সময় বাণিজ্যমন্ত্রীর উদ্যোগ এবং প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতায় কারখানা খুলে দেওয়ায় জুন মাসের পর আবার ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হয়েছিল।</p> <p>বাণিজ্যমন্ত্রী কালের কণ্ঠকে বলেন, ওই কারখানা খোলা থাকায় পোশাক শ্রমিকরা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারেননি। চলমান লকডাউনেও সরকার স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত দেওয়ায় চলতি অর্থবছরের রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে বলে আশা করছেন তিনি।</p> <p><strong>‘</strong><strong>বিশেষ সেবা সপ্তাহ</strong><strong>’</strong></p> <p>বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পবিত্র রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণসহ জনসাধারণের প্রত্যাশিত সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সব মন্ত্রণালয়কে ‘বিশেষ সেবা সপ্তাহ’ পালনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।</p> <p>এই নির্দেশনা অনুযায়ী, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সব দপ্তর ও সংস্থা নিজেদের সেবা নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে। বাজারে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে বাজার মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। নিত্যপণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার জন্য বন্দরগুলোসহ সব পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা অটুট রাখার লক্ষ্যে সমন্বয় কার্যক্রমও চলছে।</p> <p>বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, টিসিবি ‘বিশেষ সেবা সপ্তাহ’ উপলক্ষে জনগণের মাঝে বেশি পরিমাণে নিত্যপণ্য বিতরণের ব্যবস্থা নেবে। সংস্থাটি পণ্য বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ানোসহ ট্রাকে বিক্রির কার্যক্রম বাড়াবে।</p> <p> </p>