<p>পার্বত্য এলাকার আঞ্চলিক দলগুলোর আধিপত্য বিস্তারের জের ধরে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্তে কিছু দুর্গম এলাকা রয়েছে। এসব সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় যে অস্ত্র ব্যবহার করা হয় তা সীমান্তের ওই দুর্গম এলাকা দিয়ে বাইরে থেকে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। সর্বশেষ রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে সরকারি অফিসে ঢুকে গুলি করে হত্যা করা হয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য সমর বিজয় চাকমাকে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ভেঙে ইউপিডিএফ গঠনের পর এ পর্যন্ত চারটি পাহাড়ি আঞ্চলিক দলের এক হাজারের বেশি নেতাকর্মী পাল্টাপাল্টি হামলায় নিহত হন। এঁদের বেশির ভাগ গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন। এর আগে ২০১৮ সালের ৩ মে একইভাবে নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমাকে উপজেলা পরিষদ কার্যালয় প্রাঙ্গণে হত্যা করা হয়। একই দিন শক্তিমানের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাওয়ার পথে ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) আহ্বায়ক তপন জ্যোতি চাকমাসহ কয়েকজনকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়।</p> <p>গত বছর ২২ ফেব্রুয়ারি বান্দরবান সদরের রাজভিলা ইউনিয়নের জামছড়ি বাজারে ওই ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ সভাপতি বাচানু মারমাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আর গত বছর ১ এপ্রিল কাপ্তাই উপজেলার ৩ নম্বর চিত্মরম ইউনিয়নের ওয়ার্ড যুবলীগের ভাইস চেয়ারম্যান উসুইপ্রু মারমাকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। জেএসএস (সন্তু) দলের সন্ত্রাসীরা এসব হত্যাকাণ্ড ঘটায় বলে অভিযোগ রয়েছে। সর্বশেষ বিজয় চাকমাকে হত্যার ঘটনায়ও একই দলের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে স্থানীয় লোকজন।</p> <p>স্থানীয় অনেকের ধারণা, প্রকাশ্যে হত্যাকাণ্ড ঘটানোর মূল উদ্দেশ্য হলো এলাকার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে আধিপত্য বিস্তার করা। একই সঙ্গে বড় ধরনের কোনো ঘটনা ঘটাতে এরা ভারী অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা চালাচ্ছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনও বলছে, ‘ওরা’ এখন ‘সেকেন্ড ফেজ ইনসারজেন্সি’ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অপচেষ্টা করছে। সীমান্তের ওপারে গড়ে তুলেছে ১৪টি ক্যাম্প। গত এক বছরে মূল জেএসএস এবং ইউপিডিএফের সশস্ত্র রাজনৈতিক শাখার সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রায় ৮০ জন তাঁদের পরিবারের সদস্যদের পাশের কয়েকটি দেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এই পাহাড়ি সশস্ত্র গ্রুপগুলোর কাছ থেকে সম্প্রতি যেসব অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে তাতে তাদের ভারী অস্ত্র সংগ্রহের প্রমাণ মিলছে। গত বছর ২৮ নভেম্বর সকালে বাঘাইহাটে একটি আঞ্চলিক দলের গোপন আস্তানা থেকে সেনাবাহিনী দুটি একে-৪৭ ও একটি এসএমসি উদ্ধার করে। এর আগে এলএমজি, ৭.৬২ মিলিমিটার রাইফেল, এম-১৭ রাইফেল, জি-৩ রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল, মর্টার, হ্যান্ড গ্রেনেড ও রকেট লঞ্চার উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে।</p> <p>জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) গ্রুপের তথ্য ও প্রচার বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুপিটার চাকমা অভিযোগ করেছেন, সন্তু লারমার পক্ষ ত্যাগের পর এ পর্যন্ত জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) গ্রুপের কমপক্ষে ৮৩ নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে সন্তু লারমা গ্রুপের হামলায় ৫৮ জন ও ইউপিডিএফ (প্রসীত) গ্রুপের হামলায় ২৫ জন নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়।</p> <p>এদিকে ইউপিডিএফ (প্রসীত) গ্রুপের খাগড়াছড়ি জেলা সংগঠক অংগ্য মারমা জানান, ২০১৭ সালের আগ পর্যন্ত তাঁদের সংগঠনের ৩১৫ জন এবং এরপর ২০২০ সাল পর্যন্ত আরো ৩৫০ জনের বেশি নেতাকর্মী প্রতিপক্ষের হামলায় মারা গেছেন।</p> <p>এর বাইরে পার্বত্য এলাকার সর্বশেষ আঞ্চলিক দল ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) শীর্ষ নেতা ও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মাসহ কয়েকজনকে প্রতিপক্ষের অস্ত্রধারীরা ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। দলটি প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতিকালে এবং প্রতিষ্ঠার পর অন্তত ১৭ জন হত্যার শিকার হয়েছেন বলে দাবি করেছেন দলটির বর্তমান সভাপতি শ্যামল কান্তি চাকমা ওরফে জলায়া।</p> <p>কথা বলার মতো কাউকে না পাওয়ায় সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির কতজন নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন এর সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে অসমর্থিত একটি সূত্র জানিয়েছে, ওই সংগঠনেরও অন্তত ৫০০ নেতাকর্মী প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত হয়েছেন।</p> <p>চাঁদার টাকায় অস্ত্র আসছে : আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে তিনটি সংগঠনের নেতারা অভিযোগ করেছেন, নজরদারির বাইরে থাকা সীমান্ত ভেদ করেই মূলত অবৈধ অস্ত্র আসছে পার্বত্য চট্টগ্রামে।</p> <p>পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি আলকাছ আল মামুন ভূঁইয়া জানান, ভারত ও মিয়ানমারের ১৭৮ কিলোমিটার সীমানায় যেখানে নজরদারি কিছুটা শিথিল, সম্ভবত সেখান দিয়েই অস্ত্র আসছে। পার্বত্য এলাকা থেকে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি করে সেই টাকায় তারা অস্ত্র কিনছে।’</p> <p>তিনি আরো বলেন, ‘মূলত চাঁদার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে নিজেদের মধ্যে গোলাগুলি হচ্ছে। সংঘর্ষে গুলিতে প্রাণ হারাচ্ছেন তাঁদের লোকজন। এর শিকার হচ্ছেন সাধারণ পাহাড়ি বাঙালিরাও।’ তিনি অবিলম্বে পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্র উদ্বারে সাঁড়াশি অভিযান চালানোর দাবি জানান।</p> <p>জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) গ্রুপের তথ্য ও প্রচার বিভাগের যুপিটার চাকমা বলেন, ‘যাদের অবৈধ টাকা আছে তারাই অস্ত্র কারবারিদের কাছ থেকে অস্ত্র কিনছে। তবে কিভাবে অস্ত্র ঢুকছে, সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কিছু জানি না।’</p> <p>অবশ্য ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) সভাপতি শ্যামল কান্তি চাকমা জলায়া বলেন, ‘বাংলাদেশের সীমান্তের পূর্বাঞ্চল থেকে দক্ষিণাঞ্চল পর্যন্ত বিশাল এলাকা অতি দুর্গম হওয়ায় সেখানে ঠিকভাবে নজরদারি করা যায় না।  ফলে টাকা থাকলে অস্ত্র আনা যায়। প্রসীত খীসার ইউপিডিএফ ও সন্তু লারমার জনসংহতি সমিতি চাঁদা তুলে সেই টাকায় অস্ত্র কিনে আনছে। সেই অস্ত্র দিয়ে খুনাখুনি চালাচ্ছে।’</p> <p>প্রসীত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফের খাগড়াছড়ি জেলা সংগঠক অংগ্য মারমা বলেন, ‘কোথা থেকে অস্ত্র আসছে, তা বলা মুশকিল। পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই পাহাড়ে হানাহানি চলছে।’</p> <p>অস্ত্রের উৎস সম্পর্কে প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিজিবির দায়িত্বশীল কারো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।</p> <p> </p>