<p>ভোক্তা ঠকানোর তালিকায় পিছিয়ে নেই নামি-দামি সুপারশপগুলোও। গলাকাটা দাম রাখা, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রি করা, বাসি-পচা খাবার রাখাসহ নানা অনিয়মের মাধ্যমে ভোক্তাকে ঠকানোর প্রমাণ মিলছে প্রায়ই। বিভিন্ন সময় অভিযানের মাধ্যমে এসব অনিয়ম ধরা পড়ায় মোটা অঙ্কের জরিমানাও গুনেছে অনেক সুপারশপ। তার পরও থেমে নেই ভোক্তা ঠকানোর অপকৌশল।</p> <p>এসব অনিয়মে পড়ে ক্রেতাদের কেউ কেউ অভিযোগ দিলেও বেশির ভাগই বিষয়গুলো এড়িয়ে যায় ঝামেলা থেকে বাঁচতে। এর ফলে অনিয়মের প্রমাণ মিলছে খুব কমই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নানা চটকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ভোক্তার আস্থা অর্জন করে শেষ পর্যন্ত সেই আস্থা রাখতে পারছে না সুপারশপগুলো। সুযোগ পেলে তারাও নামহীন দোকানের মতো আচরণ করে। ইচ্ছামতো দাম রাখে আর মেয়াদহীন পণ্যে আলাদা ট্যাগ লাগিয়ে মেয়াদ বাড়িয়ে দেয়। তারা দিনের পর দিন এসব করে আসছে সাধারণ মানুষের সঙ্গে।</p> <p>খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সংস্থার অভিযানে রাজধানীসহ দেশের সুপারশপগুলোতে নানা ধরনের অপরাধ নজরে আসছে। সঠিকভাবে প্যাকেজিং না করা, নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি রাখা, বাসি-পচা খাদ্য বিক্রি করাসহ নানা ধরনের অনিয়ম দেখা যায় আগোরা, স্বপ্ন, মীনাবাজারসহ প্রায় সব সুপারশপেই। এসব কারণে তাদের গুনতে হয়েছে বিভিন্ন অঙ্কের জরিমানাও।</p> <p>জানতে চাইলে অধিদপ্তরের অভিযানের সদস্য মাসুম আরেফিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কতগুলো সুপারশপকে এখন পর্যন্ত শাস্তি দেওয়া হয়েছে তার কোনো হিসাব নেই। তবে আমাদের বিভিন্ন টিম বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনার সময় সুপারশপগুলোও তদারক করে। এতে প্রায় সময়ই কোনো না কোনো অনিয়ম ধরা পড়ছে তাদের।’</p> <p>জানা যায়, ২০১৭ সালের ১৭ আগস্ট ধার্য করা দামের চেয়ে বেশি দামে পণ্য বিক্রি এবং নিম্নমানের খাদ্যপণ্যের দায়ে রাজধানীতে মীনাবাজার ও আগোরার দুটি শাখাকে জরিমানা করা হয়। উত্তরা ১৪ নম্বর সেক্টরের মীনাবাজার সুপারশপ ও আগোরা সুপারশপের ব্যবস্থাপককে এই জরিমানা করেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ সাজিদ আনোয়ার। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন এপিবিএন-৫-এর চালানো যৌথ অভিযানে মীনাবাজারের ব্যবস্থাপক মাহাদী হোসেনকে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং আগোরার ব্যবস্থাপক আরমান হোসেনকে এক লাখ ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।</p> <p>২০১৮ সালের ৫ জুন আলমাস সুপারশপকে শাস্তি দেওয়া হয় লোগো জালিয়াতির কারণে। বিএসটিআইয়ের অনুমোদনবিহীন আমদানি করা কসমেটিকস বিক্রি এবং বাধ্যতামূলক পণ্য না হওয়া সত্ত্বেও অবৈধভাবে মানচিহ্ন ব্যবহার করায় আলমাসকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আনিসুর রহমান ধানমণ্ডি ও মোহাম্মদপুর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করেন। আলমাসে বিএসটিআইয়ের অনুমোদনবিহীন আমদানি করা কসমেটিকস বিক্রি এবং অবৈধভাবে বিএসটিআইয়ের মানচিহ্ন ব্যবহার করা হচ্ছিল। অভিযানে বিএসটিআইয়ের ছাড়পত্র গ্রহণ ছাড়া আমদানি করা কসমেটিকস বিক্রি-বিতরণ করায় মীনাবাজারকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।</p> <p>সুপারশপের পণ্য নিয়ে সবচেয়ে বড় পশ্ন ওঠে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। র‌্যাবের কাছে তথ্য ছিল—তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় বেশ কয়েকটি হিমাগারে অনেক দিন ধরে মাংস মজুদ রাখা হয়েছে এবং সেগুলো পচে গন্ধ বের হচ্ছে। এর পরও সেগুলো ফেলে না দিয়ে দিব্যি বিক্রি করা হচ্ছে। রাজধানীর নামি-দামি যত ব্র্যান্ডের সুপারশপ ও ফাস্ট ফুডের দোকান রয়েছে তারাই মূলত এসব পচা মাংস ও অন্যান্য দ্রব্য কিনছে। এ তথ্যে ২৫ ফেব্রুয়ারি দুপুর থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত অভিযান চালান র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় দেশি সুপার অ্যাগ্রো লিমিটেডের হিমাগারে ৮০০ মণ মেয়াদোত্তীর্ণ দুম্বা ও মহিষের মাংস পাওয়া যায়। সেখানে সুপারশপ স্বপ্ন, মীনাবাজার ও ডেইলি শপিংয়ের ক্রয়াদেশ পাওয়া যায়।</p> <p>পরে অবশ্য কয়েকটি সুপারশপ থেকে নিজেদের পক্ষে সাফাই দেওয়া হয়। স্বপ্নের বক্তব্য ছিল, আউটলেটে বিক্রির জন্য ওই কম্পানির কাছ থেকে মাংস কেনা হয়নি, কেনা হয়েছিল করপোরেট সেলের জন্য। মীনাবাজার বলেছিল, মীনাবাজারে মেয়াদোত্তীর্ণ কোনো পণ্য কখনোই মজুদ বা বিক্রি করা হয় না। তারা টাটকা মাংস গ্রহণ করার পর অবিক্রীত মাংস দিন শেষে ফেরত দেয়।</p> <p>র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলমের নেতৃত্বে ওই অভিযান চালানো হয়েছিল। তিনি তখন বলেন, ‘অভিযান শুরুর সময় মনে হয়েছিল পচা মাংস আর কতটুকু মজুদ রাখতে পারে। কিন্তু হিমাগারগুলোতে প্রবেশের পর চোখ উল্টে যাওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হলো। পচা মাংসের গন্ধে সেখানে থাকাই মুশকিল হয়ে গেল। থরে থরে সাজানো মাংস আর মাংস। পরিমাণ এতটাই বেশি ছিল যে মনে হচ্ছিল, সারা দেশের মাংস এসব কারখানা থেকে সরবরাহ করা হয়। মহিষের মাংস, দুম্বার মাংস, খাসির মাংস, গরুর মাংস সবই ছিল পচা অবস্থায়। সেখানে যে রক্ত রয়েছে সেগুলোও দুর্গন্ধে ভরা।’</p> <p>সিগারেটের বিজ্ঞাপন প্রদর্শনের অপরাধে ২০২০ সালের ২১ আগস্ট চট্টগ্রামে মীনাবাজারকে ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। নগরীর ষোলশহর দুই নম্বর গেটে ‘মীনাবাজার’ আউটলেটকে এ জরিমানা করেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আলী হাসান ও জিল্লুর রহমান। ধূমপান ও তামাকজাতদ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইন-২০০৫-এ তামাকজাতদ্রব্যের বিজ্ঞাপন ও ভেন্ডিং মেশিন স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করায় এ জরিমানা করা হয়।</p> <p>হঠাৎ চাহিদা বেড়ে গেলেও দাম বাড়িয়ে দেওয়ার নজির রয়েছে সুপারশপগুলোর। ডেঙ্গুর প্রকোপের মধ্যে বেশি দামে মশা প্রতিরোধী ওডোমস ক্রিম বিক্রি ও অনুমোদনহীন পণ্য রাখায় গুলশানের সুপারশপ ল্যাভেন্ডারকে লাখ টাকা জরিমানা করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট দোকানটিতে অভিযানে যান অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। ল্যাভেন্ডারে ৫০ গ্রামের একটি ভারতীয় ওডোমস ক্রিমের দাম ৬৫০ টাকা রাখার প্রমাণ পাওয়া যায়। পণ্যটি এর সপ্তাহখানেক আগেও ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।</p> <p>২০১৯ সালের ৮ মে মাংসের দাম বেশি রাখায় জরিমানা গুনেছিল আগোরা ও বেঙ্গল মিট। সিটি করপোরেশন নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে গরুর মাংস বিক্রি করায় আগোরার কাকরাইল শাখা এবং মগবাজারে বেঙ্গল মিটের বিক্রয়কেন্দ্রকে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ভ্রাম্যমাণ আদালত।</p> <p> </p>