<p>ব্যারিস্টার রফিক-উল হক আর নেই, খবরটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে মনটি ভারী হয়ে গেছে। তিনি ছিলেন আমার অভিভাবক। আমার আইকন। শুধু আমার কেন, সব জুনিয়র ব্যারিস্টারের আইকন ছিলেন তিনি। তিনি আইনজীবী হিসেবে যেমন ছিলেন ইউনিক, তেমনি মানুষ হিসেবেও ছিলেন ইউনিক। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশ হারাল একজন সুসন্তানকে। আর সুপ্রিম কোর্ট হারাল আইনের একজন মহীরুহকে। আমরা হারালাম আইনাঙ্গনের গোল্ডেন সময়ের সন্তানদের একজনকে।</p> <p>ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের সরাসরি ছাত্র ছিলাম আমি। তাঁকে প্রথম দেখি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬৭ সালে। একদিন আইন অনুষদের সামনে বসে আছি। আমরা শিক্ষার্থীরা অপেক্ষা করছি ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের ক্লাসের জন্য। এরই মধ্যে একজন লম্বা গড়নের ছিমছাম দেহের মানুষ আমাদের সামনে দিয়ে সোজা হেঁটে ঢুকে গেলেন শ্রেণিকক্ষে। তখনও তাঁকে চিনি না। এরই মধ্যে খবর এলো ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। ছুটে গেলাম। দেখি তিনি ডায়াসে। তখন বুঝলাম ইনিই ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। সেই থেকে তাঁর সঙ্গে পরিচয়। অল্প দিনের মধ্যে আমি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হই।</p> <p>১৯৬৯ সালে পরীক্ষা দিয়েই চলে গেলাম তাঁর চেম্বারে। সেখানে গিয়ে দেখি বহু মানুষের সমাগম। এত এত বই। কারো বাসায় এত বই আগে দেখিনি। বই পেলেই কিনতেন তিনি। বিদেশে গেলে ব্রিফকেস ভরে বই নিয়ে আসতেন। তাঁর চেম্বারের জুনিয়র আইনজীবীরা এখানে সেখানে বসে আছেন। চেম্বারটা দেখে খুব ভালো লাগল। আইন পাস করলাম। এরপর বার-এট ল করতে চলে গেলাম লন্ডন। সেখানে অধ্যয়নকালে তিনি একদিন আমার বাসায় হাজির হলেন। এরপর ব্যারিস্টারি পাস করে ১৯৭৬ সালে দেশে ফিরে এলাম। দেশে ফেরার পর তিনিই প্রথম আমাকে লাঞ্চের দাওয়াত দিলেন। আমি অবাক হলাম। শুনে তিনি বললেন, এটা নিয়ম। কেউ ব্যারিস্টারি পাস করে এলে সিনিয়র তাকে খাওয়াবে।</p> <p>ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের ছিল একটি কোমল মন। জীবনে তিনি যেমন কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন, তেমনি দুই হাতে সমানে বিলিয়েছেন। তাঁর টাকায় অনেক হাসপাতাল, এতিমখানা, কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অনেক হাসপাতালে তিনি নিয়মিত অনুদান দিতেন। এর বাইরেও ব্যক্তিগতভাবে কত মনুষকে যে তিনি সহযোগিতা করেছেন, তার হিসাব মেলানো ভার। তিনি আমাকেও দুইবার আর্থিকভাবে সহযোগিতা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি তাঁর কাছ থেকে আর্থিক সহযোগিতা নিতে পারিনি। একবার ২০০৬ সালে। তখন আমার মেয়ে লন্ডনে। তার মাথায় টিউমার ধরা পড়ল। ওই টিউমার অপারেশনের সময় একদিন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক স্যার আমাকে অর্থ সহায়তার প্রস্তাব দিলেন। আরেকবার ২০০৯ সালে। এবার আমার স্ত্রীর জন্য। কিন্তু কোনোবারই তাঁর কাছ থেকে আর্থিক সহযোগিতা নিতে পারিনি। কারণ আমি তখন বিচারপতি।</p> <p>ব্যারিস্টার রফিক-উল হক কঠোরভাবে নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলতেন। তেমনি জুনিয়রদেরও তা মেনে চলতে বাধ্য করতেন। পান থেকে চুন খসলে রক্ষা ছিল না। তিনি নিয়মিত ভোর ৫টায় বিছানা ছাড়তেন। নিজেকে মামলার শুনানির জন্য প্রস্তুত করতেন। পুরো প্রস্তুত হয়ে আদালতে পৌঁছে এমনভাবে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করতেন যা আমি পারব না। আমার মনে পড়ে, সেই ১৯৭৬-৭৭ সালের দিকে আদালতে বসে আছি। তিনি গড়গড় করে ইংরেজিতে সাবমিশন রাখছেন। আমরা সব বিচারপতি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছি। তাক লাগানো উপস্থাপনা ছিল তাঁর। যত শক্ত মামলাই হোক, তা সহজ করে, সাবলীলভাবে উপস্থাপনে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। শুনানিতে তিনি প্রতিটি যুক্তির সঙ্গে বিভিন্ন মামলার রেফারেন্স তুলে ধরতেন। আমি বিচারপতি হওয়ার আগে নিয়মিত প্র্যাকটিস করেছি। তখন বড় অনেক আইনজীবীকে হারিয়েছি। কিন্তু ব্যারিস্টার রফিক-উল হককে কখনো হারাতে পারিনি।</p> <p>ব্যারিস্টার রফিক-উল হক আদালতে শুনানিকালে মাঝে মাঝে মেজাজ হারাতেন। তাঁর এই আচরণে কোনো বিচারক কোনো দিন কিছু বলেননি। কিছু মনে করেননি। কারণ, ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের শুনানি এমন ছিল যে, তা কেউ মিস করতে চাইত না।</p> <p>ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ছিলেন সংবিধান ও কম্পানি আইনের দিকপাল। বাংলাদেশের অনেক আইন করার সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। ৫৩ বছর ধরে তাঁকে চিনি। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ছিলেন আইনাঙ্গনে হিমালয় পর্বতের মতো। তিনি একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তি ছিলেন। রাজনীতি করতেন না। যা সত্য তা অকপটে বলে দিতেন। তিনি সত্যিকারের একজন দেশপ্রেমিক ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে আমি একজন অভিভাবককে হারালাম। বাংলাদেশ হারাল একজন সুসন্তানকে।</p> <p>লেখক : সাবেক প্রধান বিচারপতি ও আইন কমিশনের চেয়ারম্যান</p> <p>অনুলিখন : এম বদি-উজ-জামান</p>