<p>ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) পর্যবেক্ষণ, দুর্নীতি দমন প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ওপর জনসাধারণের আস্থার ঘাটতি আছে। জনগণ মনে করে, দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে দুদক ক্ষুদ্র দুর্নীতির ওপর বেশি মনোযোগী এবং ‘বড় দুর্নীতিবাজ’ ধরার ক্ষেত্রে দুদকের দৃশ্যমান সাফল্য নেই।</p> <p>টিআইবি বলছে, স্বাধীনতা ও মর্যাদার প্রশ্নে দুদককে পর্যাপ্ত স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কার্যক্রম ও ক্ষমতার ব্যবহারের ক্ষেত্রে এর স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ। বিরোধী দলের রাজনীতিকদের হয়রানি করলেও ক্ষমতাসীন দল বা জোটের রাজনীতিকদের প্রতি নমনীয় দুদক।</p> <p>‘দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণ উদ্যোগ : বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশনের ওপর একটি ফলোআপ গবেষণা’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এ কথা বলেছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি।</p> <p>প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুদক রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ আচরণ দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। এর বিরুদ্ধে পক্ষপাতপূর্ণ ভূমিকা পালন করার অভিযোগ রয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে বেশির ভাগই তদন্ত চলছে বলে সাধারণের মধ্যে ধারণা রয়েছে; যদিও ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধেও তদন্ত চলছে।</p> <p>ধানমণ্ডির মাইডাস সেন্টারে গতকাল মঙ্গলবার সকালে টিআইবি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করে। সংস্থাটি একে গুণগত গবেষণা বলছে। ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তথ্য-উপাত্ত নিয়ে এই গবেষণা করা হয়েছে।</p> <p>সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. পারভীন হাসান, নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ও উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের। গবেষণাপত্র তুলে ধরেন টিআইবির রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি বিভাগের প্রগ্রাম ম্যানেজার শাম্মী লায়লা ইসলাম ও সিনিয়র প্রগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম আকরাম।</p> <p>গবেষণার মূল্যায়ন অনুযায়ী, দুর্নীতি দমন কমিশনের সার্বিক স্কোর ৬০ শতাংশ, যা ‘মধ্যম’ মান নির্দেশ করে। ‘উচ্চ’ মান থেকে ৭ পয়েন্ট কম। অর্থাৎ উচ্চ মানে যেতে দুদককে আর মাত্র ৭ পয়েন্ট বাড়াতে হবে।</p> <p>গবেষণা অনুযায়ী, দুদক ৫০টি নির্দেশকের মধ্যে মোট ২১টি নির্দেশকের ক্ষেত্রে ‘উচ্চ’, ১৮টি ক্ষেত্রে ‘মধ্যম’ এবং ১১ নির্দেশকের ক্ষেত্রে ‘নিম্ন’ স্কোর করেছে। দুদকের ‘প্রতিরোধ, শিক্ষা ও আউটরিচ কার্যক্রম’ বিবেচ্য ছয়টি ক্ষেত্রের মধ্যে সর্বোচ্চ স্কোর করেছে (৭৫ শতাংশ), ‘স্বাধীনতা ও মর্যাদা’ ৬৭ শতাংশ এবং ‘সহযোগিতা ও বাহ্যিক সম্পর্ক’ ৬৭ শতাংশ স্কোর পেয়েছে। অন্যদিকে ‘অনুসন্ধান, তদন্ত ও মামলা দায়ের’ ৪৪ শতাংশ অর্থাৎ সবচেয়ে কম স্কোর পেয়েছে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে দুর্নীতি দমনমূলক কার্যক্রমে দুদক পিছিয়ে আছে।</p> <p>অনুসন্ধান, তদন্ত ও মামলা দায়ের ক্ষেত্রে দুদক অনেক পিছিয়ে আছে। গবেষণার সময় দুদকে ৪৭ হাজার ৫৪৯টি অভিযোগের মধ্যে তিন হাজার ২০৯টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য আমলে নেওয়া হয়, যা ৬.৭৫ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ৬৬ শতাংশের বেশি অনুসন্ধান হওয়ার কথা। দুদকে আসা অভিযোগ আমলে নেওয়ার ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া বেশি কঠোর। দুদকের মতে, বেশির ভাগ অভিযোগ দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধের মধ্যে পড়ে না। আর দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান ও তদন্ত কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীদের বিরুদ্ধে ঘুষ লেনদেন ও দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ রয়েছে বিস্তর, আর অনুসন্ধান ও তদন্ত কাজ শেষ করতেও অধিক সময় লাগে।</p> <p>সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘কিছু ব্যতিক্রম ঘটনা ছাড়া প্রায় সব ক্ষেত্রেই তথাকথিত রুই-কাতলা বা বড় ধরনের দুর্নীতিবাজ, যাঁরা ক্ষমতার সঙ্গে সম্পৃক্ত, ওই সব প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজের ক্ষেত্রে দুদক খুব একটা কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। মানসিকতার ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে দুই দিকেই। দুদকের নেতৃত্বের মধ্যে এবং সরকারের মধ্যেও এই ঘাটতি দেখা যায়।</p> <p>টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘এই যে সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে দুদক কর্তৃক গ্রেপ্তারের আগে অনুমতি নিতে হবে। আইনের এই ধারা সম্প্রতি সংযুক্ত করা হয়েছে। এটা অবশ্যই অসাংবিধানিক এবং বৈষম্যমূলক। আশা করছি, এটা আদালত কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হবে। কিন্তু এটার ফলে যা হয়েছে, সেটা হচ্ছে সরকারের সদিচ্ছার ঘাটতির প্রতিফলন ঘটেছে; যদিও দুদক দাবি করছে, ওই ধারা তাদের কাজের খুব বেশি ব্যাঘাত ঘটাতে পারবে না। আর আমরা মনে করি, দুদকের কাজে এই ধারা ব্যাঘাত ঘটাবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘দুদক কাগজে-কলমে স্বাধীন; কিন্তু বাস্তবে দুদক স্বাধীনভাবে কাজ করছে—এটি আমরা বলতে পারব না। দুদকের সৎসাহস ও দৃঢ়তার ঘাটতি আছে। দুদকের মতো প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তিকে যখন সচিবদের নিয়ে প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে দেখি তখন উদ্বেগ তো হতেই হয়।’</p> <p>টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দুদক রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ নয়। কারণ দুর্নীতির ঘটনা মোকাবেলায় এটি নিরপেক্ষ আচরণ দেখাতে সমর্থ হয়নি।</p> <p>প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দুদকের কর্ম সম্পাদনের স্বাধীনতাও কিছুটা নিম্ন। কিছু ক্ষেত্রে দুদক সরকার ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনের চাপের সম্মুখীন হয়ে থাকে। কিছু ক্ষেত্রে সরকারের বিরূপ প্রতিক্রিয়া এড়ানোর জন্য দুদক স্বাধীনভাবে কাজ করা থেকে বিরত থাকে।</p> <p> </p>