<p>ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে ভারতীয় অর্থনৈতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের ভৌগোলিক গুরুত্ব, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সম্ভাবনা তুলে ধরেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে চার দিনের সফরে নয়াদিল্লি পৌঁছার পর দুপুরে হোটেল তাজ প্যালেসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম আয়োজিত ওই সম্মেলনে যোগ দিয়ে বাংলাদেশের কৌশলবিষয়ক আলোচনায় অংশ নেন। এ সময় তিনি এই অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ‘ইকোনমিক হাব’ (অর্থনৈতিক কেন্দ্র) হয়ে ওঠার সম্ভাবনার কথা বলেন। বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি ও ধর্মীয় সম্প্রীতি এবং স্থিতিশীলতার কথাও উল্লেখ করেন।</p> <p>ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনীতিক, শীর্ষ ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা ও নীতিনির্ধারকদের সামনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ দেশের ১৬ কোটি ২০ লাখ মানুষের মধ্যে তিন কোটিরও বেশি মধ্যবিত্ত। এটি অবশ্যই একটি বিশাল বাজার। এর বাইরেও বাংলাদেশ বিশ্বের প্রায় ৩০০ কোটি লোকের সম্মিলিত বাজারের সংযোগ সৃষ্টিকারী ভূখণ্ড হতে পারে।</p> <p>প্রধানমন্ত্রী ভারতের পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মধ্যে এবং চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কাছাকাছি বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘ভৌগোলিক এই অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ নির্ঝঞ্ঝাট অর্থনৈতিক ক্ষেত্র হিসেবে বৈশ্বিক ও ভারতীয় ব্যবসায়ীদের দৃষ্টি আকর্ষণের দাবি রাখে। আমরা উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক কেন্দ্রের ভূমিকা রাখতে পারি।’</p> <p>প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং এ নিয়ে আন্তর্জাতিক পূর্বাভাস তুলে ধরে এ দেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “অনেকের কাছে বাংলাদেশ হলো ‘উন্নয়নের বিস্ময়’। আমার কাছে, আমাদের শক্তি হলো বাংলাদেশের প্রতি জনগণের বিশ্বাস ও সামাজিক মূল্যবোধ এবং একইভাবে অগ্রগতির জন্য জনগণের প্রত্যাশা এবং তাদের সহনশীলতা ও আমাদের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা।”</p> <p>বঙ্গবন্ধুর ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও শোষণমুক্ত ‘সোনার বাংলার’ স্বপ্নের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর ওই স্বপ্নই আগামী ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্র ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে বর্তমান সরকারের লক্ষ্য অর্জনে আস্থা জোগাচ্ছে।</p> <p>পোশাকশিল্পের বাইরেও যে বাংলাদেশে দ্রুতবর্ধনশীল উচ্চগুণসম্পন্ন ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ আছে তা দর্শক-শ্রোতাদের জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘গত বছর আমরা কোরিয়ায় ১২টি শিল্প রোবট রপ্তানি করেছি। বাংলাদেশে তৈরি চারটি জাহাজ ভারতে পৌঁছেছে। সম্প্রতি রিলায়েন্স বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক রেফ্রিজারেটর কিনেছে।’</p> <p>তিনি বলেন, বাংলাদেশে ছয় লাখ তথ্য-প্রযুক্তি (আইটি) ফ্রিল্যান্সার, বৃহত্তম ফ্রিল্যান্সিং কমিউনিটি আছে। এটি একটি নীরব রূপান্তরের ইতিহাস, যেখানে লোকজন প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার মতো ঝুঁকি নিয়েছে ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, গতানুগতিক খাতগুলোর বাইরে বাংলাদেশের শিক্ষা, হালকা প্রকৌশল, ইলেকট্রনিকস, অটোমোটিভ শিল্প, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মতো খাতগুলোতে বৈশ্বিক বিনিয়োগকারী, বিশেষ করে ভারতীয় উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের এখনই সময়।</p> <p>বাংলাদেশে দ্রুত নগরায়ণ ঘটছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৪৮ শতাংশ শহর ও নগরে বাস করবে। তাদের বেশির ভাগই থাকবে তরুণ, উদ্যমী ও ডিজিটাল ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত। তারা হবে কর্মদক্ষ। তারা নতুন ভাবনার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেবে এবং সম্পদ সৃষ্টির নতুন পথ খুঁজবে। কার্যত বাংলাদেশে ১১ কোটিরও বেশি সক্রিয় ইন্টারনেট গ্রাহকের ক্ষেত্রে এটি হচ্ছে।’</p> <p>প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪১ শতাংশের কাছে মোবাইল ইন্টারনেট পৌঁছবে। দ্রুত নগরায়ণের ফলে বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ছে। তিন কোটিরও বেশি মধ্যবিত্ত অবশ্যই একটি বড় বাজার।  তিনি বলেন, ‘অনেক দেশের মতো আমাদেরও চ্যালেঞ্জ আছে। তবে চ্যালেঞ্জকে কিভাবে সম্ভাবনায় রূপান্তর করতে হয় তা আমরা জানি।’</p> <p>বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এ বছর আমাদের অর্থনীতি ৮.১ শতাংশ রেকর্ড প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। আমরা দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি অর্জনের কাছাকাছি আছি। ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ১৮৮ শতাংশ বেড়েছে। আমাদের মাথাপিছু আয় দুই হাজার ডলারের কাছাকাছি। আমাদের কৃষি এখন আর কেবল নিজেদের চাহিদা মেটানোর জন্য নয়। স্বনির্ভরতা অর্জনের পাশাপাশি আমরা এখন ধান উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, আম উৎপাদনে চতুর্থ, শাকসবজি উৎপাদনে পঞ্চম ও অভ্যন্তরীণ মৎস উৎপাদনে চতুর্থ। একে আরো এগিয়ে নিতে আমরা প্রধান প্রধান শস্য ও ফলের জেনোম ‘ডিকোড’ করছি।”</p> <p>বাংলাদেশকে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে’ রূপান্তর করতে ২০০৯ সাল থেকে তৃণমূল পর্যায়ে শতভাগ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘সাধারণ জনগণের উন্নয়ন চ্যালেঞ্জগুলো প্রযুক্তির মাধ্যমে সমাধানে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি। এর ফলে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে পঞ্চম বৃহত্তম ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এখন বাংলাদেশে।’</p> <p>নগদ অর্থের বদলে প্রযুক্তিভিত্তিক ‘ক্যাশলেস’ সমাজের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার কথাও বলেন প্রধানমন্ত্রী। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, গত বছর বাংলাদেশে ই-কমার্স লেনদেন ২৬ কোটি মার্কিন ডলার ছুঁয়েছে।</p> <p>বিনিয়োগ সম্ভাবনা প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ সুরক্ষা, উদার অর্থনৈতিক সুবিধা, যন্ত্রাংশ আমদানিতে ছাড়, অবাধ ‘এক্সিট’ (ফিরে যাওয়া) নীতি এবং ফিরে যাওয়ার সময় মূলধন ও লভ্যাংশ পুরোপুরি নিয়ে যাওয়ার সুযোগের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে উদার বিনিয়োগব্যবস্থা এখন বাংলাদেশেই আছে।</p> <p>তিনি বলেন, ‘আমরা ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ করছি এবং বাংলাদেশজুড়ে ওয়ানস্টপ সেবা চালু করছি। ১২টি অঞ্চলে ইতিমধ্যে কাজ চলছে। দুটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী উদ্যোক্তাদের জন্য বেশ কিছু হাইটেক পার্কও প্রস্তুত আছে।’</p> <p>প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত বছর এইচএসবিসি আভাস দিয়েছে যে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের ২৬তম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে। এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় মুখ্য; একটি হলো আমাদের উন্মুক্ত সমাজ, ধর্মীয় সম্প্রীতি, উদার মূল্যবোধ ও অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি। অপরটি, আমাদের মোট জনগোষ্ঠীর দুই-তৃতীয়াংশই তরুণ। তাদের অধিকাংশের বয়স ২৫ বছরের কম। তারা দ্রুত দক্ষতা অর্জন ও প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে। প্রতিযোগিতামূলক মজুরিতে কাজ করতে তারা প্রস্তুত। আমাদের আত্মবিশ্বাসী জনগণ, যোগ্য নেতৃত্ব ও শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় অব্যাহতভাবে শিখছি।’</p> <p>সংবেদনশীল ও দায়িত্ববোধসম্পন্ন নেতৃত্বের কারণে বাংলাদেশকে স্থিতিশীল ও মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, এসবের পাশাপাশি জোরালো সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভিত্তি, বাস্তবসম্মত ও উন্মুক্ত অর্থনীতি, বৈশ্বিক ধারা সৃষ্টি এবং শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল রাষ্ট্রের উদাহরণ হওয়া অব্যাহত রাখবে বাংলাদেশ।</p> <p>প্রধানমন্ত্রী আজ শুক্রবার বিকেলে এই সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠানের আলোচনা পর্বে অংশ নেবেন।</p>