<p>হাটে ঘুরে ঘুরে পশু দেখবে, পছন্দ করবে, তারপর কিনবে—মানুষের এমন শখে বাদ সেধেছে বেরসিক বৃষ্টি। ফলে হাটে না ঢুকেই রাস্তায় দু-একটি গরুর দরদাম জিজ্ঞেস করে বাড়ি ফিরে যাচ্ছিল ক্রেতারা। অন্যদিকে সারা দিনের বৃষ্টিতে কর্দমাক্ত হাটে পশুর স্বাস্থ্য ঠিক রাখতেই হিমশিম খাচ্ছিল ব্যবসায়ীরা। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর গাবতলী পশুর হাট, উত্তরার কাওলা এলাকার শিয়ালডাঙ্গা এবং খিলগাঁও রেলগেটসংলগ্ন মৈত্রী সংঘের মাঠে পশুর হাট ঘুরে এমন দৃশ্যই চোখে পড়ল। তবে বিক্রেতারা আশা করছে, আজ শুক্রবার থেকে জমে উঠতে পারে বেচাকেনা। তারপরের দুই দিনও আশা দেখাচ্ছে তাদের।</p> <p>রাজা, বাদশাহ, প্রিন্স, রাজাবাবু বিক্রির অপেক্ষায় গাবতলীতে : গাবতলী পশুর হাটে রাজা, বাদশাহ, প্রিন্স, রাজাবাবু নামের বড় বড় গরু নিয়ে ক্রেতার জন্য অপেক্ষায় আছে ব্যবসায়ীরা। তবে হাট শুরুর দ্বিতীয় দিনেও বিক্রিতে ভাটা। সেই সঙ্গে হাট ইজারাদারের নানা জটিলতায় চরম দুশ্চিন্তায় ফেলেছে গরু ব্যবসায়ীদের।</p> <p>গত বুধবার থেকে ঢাকাসহ সারা দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে পশুর হাট শুরু হয়েছে।</p> <p>ঢাকায় সবচেয়ে বড় হাট গাবতলী পশুর হাট। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কখনো হালকা আবার কখনো ভারি বৃষ্টিতে বিপাকে পড়ে হাটে গরু নিয়ে আসা ব্যাপারী ও খামারিরা। </p> <p>কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলা থেকে মাত্র একটি গরু নিয়ে এসেছেন মাসুদ হাসান। তিনি কৃষিকাজ করেন। তবে কোরবানির জন্য গরু পোষা তাঁর শখ। পাশাপাশি এর মাধ্যমে বাড়তি আয়ও হয়। হাটে যে গরুটি এনেছেন তিনি, তার নাম রেখেছেন ‘শাহজাদা’। দাম হাঁকছেন ২০ লাখ টাকা। মাসুদ বলছিলেন, তাঁর গরুর মাংস হবে ২৮ মণের কাছাকাছি। একজন ক্রেতা দাম বলেছে ১২ লাখ টাকা। এ ছাড়া আর কেউ দাম বলেনি। এই নিয়ে খুব মন খারাপ তাঁর। কারণ ১০ হাজার টাকা ট্রাক ভাড়া দিয়ে তিনি গরুটি ঢাকায় এনেছেন কিছু বাড়তি লাভের আশায়।</p> <p>মাসুদ হাসানের মতোই কুষ্টিয়ার কুমারখালী থেকে আটটি গরু নিয়ে এসেছেন ব্যাপারী সোহেল রানা। তাঁর বড় গরুটির মাংস হবে প্রায় ২৫ মণ। তিনি এর নাম রেখেছেন ‘বাদশাহ’। দাম হাঁকছেন ১৫ লাখ টাকা। ১৩ লাখ টাকা পেলেই ছেড়ে দেবেন, কিন্তু গতকাল বিকেল পর্যন্ত তিনি কোনো ক্রেতার দেখা পাননি। সামনের তিন দিনে (আজ শুক্রবারসহ) গরুগুলো বিক্রি করতে পারবেন কি না তা নিয়ে চিন্তায় আছেন তিনি।</p> <p>কিশোরগঞ্জ থেকে দেড় হাজার কেজি ওজনের গরু নিয়ে এসেছেন জাকির হোসেন। গরুটির নাম রেখেছেন ‘শাহজাদা’। দাম চাচ্ছেন ২২ লাখ টাকা। তাঁর মতে, টানা চার বছর খুব যত্ন করে তিনি গরুটি পালন করেছেন। ফ্রিজিয়ান জাতের গরুটির পেছনে তাঁর আট লাখ টাকা খরচ হয়েছে। গত দুই দিনের মধ্যে মাত্র একজন ক্রেতা ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত দাম বলেছে।</p> <p>জাকিরের ‘শাহজাদা’র পাশে ‘বাহাদুর’কে নিয়ে ক্রেতার অপেক্ষায় ছিলেন পাবনার খামারি মঞ্জুর মিস্ত্রি। তিনি গরুটির দাম চাচ্ছেন ১৫ লাখ টাকা। তিনিও ক্রেতা না পাওয়ায় হতাশ। একইভাবে হাটে ৩৯টি দেশি জাতের গরু নিয়ে কুষ্টিয়া থেকে এসেছেন খামারি মোকতার হোসেন। অন্যদের মতো তিনিও ক্রেতা না পাওয়ায় হতাশ।</p> <p>খামারি জাকির হোসেন কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া থেকে তিনটি গরু নিয়ে এসেছেন। তিনি বড় গরুটির নাম দিয়েছেন ‘প্রিন্স’। ৩০ লাখ টাকা দাম হাঁকছেন তিনি, ২৫ লাখ টাকা হলে বিক্রি করবেন বলে জানালেন। আর অন্য দুটির দাম চাচ্ছেন ২৫ লাখ ও ২০ লাখ টাকা করে। জাকির জানালেন, এক ক্রেতা ‘প্রিন্স’-এর দাম বলেছে ১৫ লাখ টাকা।</p> <p>শিয়ালডাঙ্গায় বৃষ্টিতে পশুর স্বাস্থ্য ঠিক রাখতেই হিমশিম : শিয়ালডাঙ্গা পশুর হাটে পাঁচ হাজারের বেশি গরু উঠেছে। এ ছাড়া ৫০০ খাসি এবং ৫০টির মতো ভেড়া নিয়ে এসেছে ব্যবসায়ীরা। কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, গাইবান্ধা, রংপুর ও জামালপুর থেকে এসেছে বেশির ভাগ পশু। গত শনিবার থেকে এসব পশু নিয়ে হাটে বসে আছে ব্যবসায়ীরা। পুরো সপ্তাহ বিক্রেতার জন্য অপেক্ষা করেছে তারা। গতকাল থেকে পশু বিক্রি পুরোদমে শুরু হবে, এমন আশা ছিল তাদের। কিন্তু দুপুর থেকে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় হাটে ক্রেতা খুব একটা আসেনি। শিয়ালডাঙ্গা পশুর হাটে ৫০ হাজার থেকে শুরু করে ছয় লাখ টাকা পর্যন্ত দামের গরু এনেছে ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া ১০ হাজার থেকে শুরু করে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত দামের খাসি রয়েছে হাটটিতে। আর ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকা হাঁকা হচ্ছে ভেড়ার দাম।</p> <p>জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলা থেকে গরু নিয়ে আসা ব্যবসায়ী মো. রাসেল মিয়া বলেন, ‘আটটি ছুডু ও মাঝারি সাইজের গরু লইয়া ডাহা আইলাম। ভাইগ্যে কী আছে জানি না। এহনো একটা গরুও বেইচতে ফারি নাই। শুক্কুর থেকে রববার ফর্জন্ত এই তিন দিনে ভরসা আমাদের। অহন গরুর সাস্ত-চেহারা টিক রাকাই কটিন।’</p> <p>বাজার কমিটির সদস্যরা জানান, উত্তরা, খিলক্ষেত, উত্তরখান ও দক্ষিণখান এলাকার বাসিন্দারা শিয়ালডাঙ্গা হাট থেকে কোরবানির পশু কেনাকাটা করে। পুরো এলাকায় একটিমাত্র বাজারের অনুমোদন দিয়েছে সিটি করপোরেশন। ব্যবসায়ী, পশু ও ক্রেতাদের নিরাপত্তা দিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা রয়েছেন। সিসিটিভি ক্যামেরাও লাগানো হয়েছে।</p> <p>বাজার কমিটির সদস্যরা বলছিলেন, বৃষ্টির কারণে কিছুটা বেগ পোহাতে হচ্ছে। তবে পানি নিষ্কাশন এবং কাদা অপসারণের জন্য বাজারে স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ করছে। এই বৃষ্টির মধ্যেও এক শর মতো গরু ও ১০টির মতো খাসি বিক্রি হয়েছে। বাকি তিন দিনে বেশির ভাগ পশু বিক্রি হয়ে যাবে বলে আশা করছেন তাঁরা।</p> <p>বিক্রি না জমলেও ক্রেতা-দর্শনার্থীর কমতি নেই মৈত্রী সংঘের মাঠে : খিলগাঁও রেলগেটসংলগ্ন মৈত্রী সংঘের মাঠে বসেছে কোরবানির পশুর হাট। গতকাল দুপুরে বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর অনেক ক্রেতা-দর্শনার্থী হাটের প্রবেশমুখের হাসিলঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। হঠাৎ মাঠের ভেতর থেকে চার-পাঁচজন মিলে দুটি গরু নিয়ে দৌড়ে আসতে দেখা গেল। দ্রুত তারা হাসিলঘরের সামনের খুঁটির সঙ্গে গরুগুলোকে বেঁধে ফেলে। এর মধ্যেই শুরু হলে গেল প্রশ্নবাণ। বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই এসে গরু দুটিকে ঘিরে ধরে দাম জানতে শুরু করে। বিক্রেতাকে অন্তত ১০-১২ বার বলতে শোনা গেল, ‘ভাই, দুই লাখ ৬০ হাজার টাকা।’</p> <p>হাট ঘুরে দেখা গেল, বিক্রি না জমলেও বাজারে ক্রেতা-দর্শনার্থীর কমতি নেই। স্কুল ড্রেস পরা অনেক ছেলে-মেয়েকে দেখা গেল ঘুরে ঘুরে গরু দেখছে আর দাম জিজ্ঞেস করছে। দাম জানার চেয়ে গরুর নাম খুঁজতে ব্যস্ত এক স্কুলছাত্রকে পাওয়া গেল। শরিফুল ইসলাম নামের ওই শিক্ষার্থী বড় একটি কালো গরুর বিক্রেতার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আংকেল, এই গরুটার নাম কী রেখেছেন?’ জবাবে বিক্রেতা জানালেন ‘কালা পাহাড়’। কালো কুচকুচে এই গরু সাড়ে তিন লাখ টাকায় বিক্রি করতে চান বলে বিক্রেতার কাছ থেকে জানা গেল।</p> <p>ব্যবসায়ীরা জানায়, বৃষ্টিতে মাঠ কাদায় মাখামাখি হয়ে গেছে। অনেকে বসতেও পারছে না। কোনো কোনো জায়গায় তাঁবুও নেই।</p> <p>তবে হাটে কোনো ধরনের সমস্যা নেই জানিয়ে পরিচালনাকারীদের একজন মো. আব্দুর রহিম কালের কণ্ঠকে বলেন, এখানে পশুর ডাক্তার রয়েছে সার্বক্ষণিক। ব্যবসায়ীদের টাকা রাখার জন্য পরিচালনা কমিটির কাছেই বক্স আছে। ডকুমেন্ট দিয়ে ব্যবসায়ীরা যেভাবে টাকা দেয়, ঠিক সেভাবেই সংরক্ষণ করা হয়। তাদের যখন লাগে তখনই এসে টাকা নিয়ে যায়।</p> <p> </p>