একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কৃপাধন্য হতে জামায়াতে ইসলামীসহ বেশ কয়েকটি ধর্মীয় উগ্রবাদী দল স্বাধীনতাবিরোধী অপতৎপরতায় যোগ দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিকে বিনাশ করার ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা নিয়েছিল। এরা বাংলাদেশের ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়ে।
শুধু হত্যা নয়, ধর্ষণ, অপহরণ, ধর্মান্তরিত করা, আগুন দিয়ে সম্পদ জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়াও ছিল যুদ্ধাপরাধীদের কাজ।
বাঙালিদের মেধাশূন্য করতে বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদারদের এ দেশীয় দোসররা। হত্যা, নির্যাতনের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের ধনসম্পদও লুট করে তারা। ওই লুট করা সম্পদ দিয়ে স্বাধীনতার পর তারা বিশাল সম্পত্তির মালিক হয়ে ওঠে। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে এদের অনেকের বিচার হলেও তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্তে এখনো কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সম্পদ বাজেয়াপ্তে আইন করার কথা বারবার বলা হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি।
এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পর নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট। শুরু হয় মানবতাবিরোধীদের বিচার। মিরপুরের কাদের মোল্লা ওরফে কসাই কাদেরের বিচারের রায়ের মধ্য দিয়ে বিচার এগোতে থাকে।
একে একে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, কামারুজ্জামান, মতিউর রহমান নিজামী, সাকা চৌধুরী, মীর কাসেম আলীর বিচার সম্পন্নের পর তাঁদের প্রত্যেকের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। আরো অনেকের ফাঁসির রায় হয়েছে।
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অব্যাহত আছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনালের যাত্রা শুরু হয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে যাদের মৃত্যুদণ্ড অথবা আজীবন কারাদণ্ড হয় তাদের বিচারিক নথি থেকে দেখা যায়, শুধু তাদের বিরুদ্ধে হত্যা, খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, নির্যাতনের অভিযোগই ছিল না, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সম্পদ লুট, দখল করে তাদের বিতাড়ন করা, পরে ওই সম্পত্তি দখল করে ভোগ করা, সাধারণ স্বাধীনতাকামীদের সম্পদ লুটের অভিযোগও প্রমাণিত হয়েছে প্রায় প্রত্যেকের বিরুদ্ধে।
মানবতাবিরোধীদের বিচার শুরুর পর কার্যকর করার শুরু থেকে দেশের বিভিন্ন মহল থেকে দাবি ওঠে তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার। একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি, প্রজন্ম একাত্তরসহ যুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সবাই একসঙ্গে এই দাবি তোলে। সরকারের অনেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্যও এই দাবির সঙ্গে একমত হন। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তাঁরা যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার ঘোষণা দেন; কিন্তু এখন পর্যন্ত এসংক্রান্ত আইন করা হয়নি। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছে দাবি তোলা বিভিন্ন পক্ষ।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলাগুলোর রায়ে দেখা গেছে, একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগী ছিল জামায়াতে ইসলামী, যারা এখন জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ নামে দল চালাচ্ছে। জামায়াতের যুদ্ধাপরাধে সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়ার পরও দলটি নিষিদ্ধ করার বিষয়টি এখনো ঝুলে আছে।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মদদে ও উৎসাহে সংখ্যালঘু ও আওয়ামী লীগ নেতা, কর্মী, সমর্থকদের বাড়িঘর, সম্পদ লুট করে বিপুল ধনসম্পদের মালিক বনে যায় যুদ্ধাপরাধীরা। একাত্তরে তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে যুদ্ধের ময়দানে শুধু যে আত্মাহুতি দিয়েছে তা নয়, সেই সঙ্গে তাদের মা-বাবা, ভাই-বোনকে প্রাণ দিতে হয়েছে, সম্ভ্রম হারাতে হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের কাছে। তাদের সব সম্পদ লুট করেছে যুদ্ধাপরাধী রাজাকার, আলবদর, আলশামস। একাত্তরের পর যুদ্ধাপরাধীরা ওই লুট করা সম্পদে ধনী হয়েছে।
জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধীকে মুক্তি দেন। দালাল আইন বাতিল করেন। বাংলাদেশবিরোধী রাজনীতি চর্চার বন্ধ মুখ খুলে দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করার সুযোগ করে দেন মানবতাবিরোধীদের। এই সুযোগে তারা মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশবিরোধী পাকিস্তানবান্ধব রাষ্ট্রগুলোর আর্থিক সহায়তা লাভ করে ব্যাংক, বীমা, হাসপাতাল, ক্লিনিক, এনজিও ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে বিপুল ধনসম্পদের মালিক বনে যায়।
অভিযোগ রয়েছে, এসব সম্পদ তারা ব্যবহার করছে রাষ্ট্রবিরোধী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে। জঙ্গিদের আর্থিক সহায়তাও দেওয়া হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধী যারা ট্রাইব্যুনাল থেকে সাজাপ্রাপ্ত হচ্ছে তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার দাবি সর্বস্তরের স্বাধীনতার সপক্ষের ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর। কিন্তু কয়েক বছর ধরে এই দাবি শুধু আশার বাণী হয়েই রয়েছে।
২০১৬ সালে বিজয় দিবসের প্রাক্কালে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, ‘আইন করে মানবতাবিরোধীদের সম্পদ বাতিল করা হবে।’ এরপর ওই অর্থ দেশের কল্যাণে ব্যয় করার পরিকল্পনা করা হয়েছে বলেও তিনি জানান। মন্ত্রীর এই প্রতিশ্রুতির কথা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পায়। আইনমন্ত্রী অন্য একটি অনুষ্ঠানে এসংক্রান্ত আইনের খসড়া প্রণয়নের কাজ চলছে বলেও জানান।
একই বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সার্ক চলচ্চিত্র সাংবাদিক ফোরামের এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘মানবতাবিরোধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার আইন করা হবে।’ চলতি বছরের গত সেপ্টেম্বরেও তিনি আইন করার কথা বলেন।
মানবতাবিরোধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার বিষয়টি সংসদেও উত্থাপিত হয়। ২০১৬ সালের ২৯ সেপ্টেম্বরে সংসদে সংসদ সদস্য ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পী বিষয়টি প্রস্তাব আকারে উত্থাপন করেন। সর্বসম্মতভাবে ওই প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়; কিন্তু এখনো তা আইনে পরিণত হয়নি।
ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির এ প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ফাঁসি কার্যকরের মধ্য দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সাজা শেষ হয়ে যায়নি। অপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে শহীদ পরিবারের কল্যাণে ব্যয় করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধীরা মনে করেছিল, তাদের হাত অনেক লম্বা। কিন্তু বাংলাদেশের আইন প্রমাণ করেছে, আইনের হাত তার চেয়েও অনেক লম্বা।’
আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখন নির্বাচন সামনে। এ প্রসঙ্গে কোনো কথা বলা ঠিক হবে না।’
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক গত ১৭ সেপ্টেম্বর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় গেলে মানবতাবিরোধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্তের আইন করা হবে।