’ নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন হতে হবে। আপনাদের সেটা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের সবাইকে মিলে পাহারাদার হতে হবে, ভোটও দিতে হবে। ভোট পাহারা দেওয়া মানেই হলো স্বাধীনতা পাহারা দেওয়া। এ দেশ কোনো রাজতন্ত্র নয়, কোনো মহারানির নয়, কোনো রাজার নয়; জনগণ ক্ষমতার মালিক। জনগণ যেভাবে মালিকানা প্রয়োগ করে ভোটের মাধ্যমে। ভোট সুষ্ঠু না হলে, সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যায়। স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য, ভোটের অধিকার রক্ষা করার জন্য আজকে আমরা এখান থেকে শপথ নিয়ে যাই, আপসহীনভাবে এই আন্দোলন চালিয়ে যাব।’
ড. কামাল অভিযোগ করে বলেন, ‘যেভাবে পুলিশ দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে—এটা মেনে নেওয়া যায় না। এটা কোনো ব্যক্তির রাষ্ট্র নয়। সরকারি দলের জন্য এক রকম, বিরোধী দলের জন্য অন্য রকম। সরকারি দল সব আইনের ঊর্ধ্বে আর বিরোধী দল যেনতেনভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়। প্রতিদিন বিরোধী দলের কর্মীদের পুলিশের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে, জেলে যেতে হচ্ছে। এটা বন্ধ হতে হবে। স্বাধীন দেশে এটা চলতে পারে না।’
জনসভায় সভাপতিত্ব করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সাত দফা দাবি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘‘আজকে এই পিজি হাসপাতালে ছোট একটি কক্ষে আমাদের দেশনেত্রী খালেদা জিয়া অসুস্থ অবস্থায় বন্দি কাটাচ্ছেন। আমি জানি না, জনগণের এই উচ্চারণ পৌঁছাচ্ছে কি না। আমি বিশ্বাস করি, তিনি সেখান থেকে শুনছেন এবং বলছেন, ‘এগিয়ে যাও, গণতন্ত্রের মুক্তির জন্য এগিয়ে যাও, বিজয় নিশ্চিত করো।’ কারাগারে যাওয়ার আগে তিনি বলে গেছেন, ‘আমি কারাগারে যেতে ভয় পাই না।’ তিনি বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্রকে মুক্ত করার জন্য সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করবে, জাতীয় নেতাদের আহ্বান জানাবে।’ আজকে আল্লাহর কাছে এই শুকরিয়া আদায় করছি এই মঞ্চে জাতীয় নেতারা খালেদা জিয়ার মুক্তি চাচ্ছেন, জনগণের মুক্তি চাচ্ছেন।’’
সংলাপ প্রসঙ্গে ফখরুল বলেন, ‘এখনো আমাদের নেতাকর্মীদের নির্যাতন করা হচ্ছে। সংলাপ তথাকথিত প্রহসনের মতো। বলা হলো, আর গ্রেপ্তার করা হবে না, মামলা তুলে নেওয়া হবে। কিছুই করা হয় নাই। প্রতিদিনই গ্রেপ্তার হচ্ছে। এই জনসভা থেকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমার কাছে লম্বা তালিকা আছে, যা পড়ে শেষ করা যাবে না। শুধু গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে চার হাজার ৩৭১টি মামলা হয়েছে। ২৫ লাখ আসামি।’ তিনি আরো বলেন, ‘আগামীকাল একটা ছোট সংলাপের ডাক দিয়েছে। আমরা রাজি আছি। সংলাপে বিশ্বাস করি। আমরা চাই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে জনগণের সমস্যার সমাধান হোক, জনগণ মুক্তি পাক। কিন্তু এটা নিয়ে নাটক করলে চলবে না। আপনাকে ছেড়ে দিতে হবে, সংসদ বাতিল করতে হবে। একই সঙ্গে নির্বাচনের জন্য একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নাই। আমরা আশা করব, আপনাদের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে, জনগণের স্বার্থে সাত দফা দাবি মেনে নেবেন।’
প্রধান বক্তা জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, ‘এই লড়াই মুক্তির লড়াই, এই লড়াই গণতন্ত্রের লড়াই, এই লড়াইয়ে জিততে হবে। প্রধানমন্ত্রীকে বলতে চাই, আমরা দাবি আদায় ছাড়া ঘরে ফিরব না। ৭ দফা দাবি মেনে নিন। তা না হলে আপনার উপায় নেই। আর গায়েবি মামলা দেবেন না, কাউকে গ্রেপ্তার করবেন না, বেগম জিয়াসহ সকল রাজবন্দিকে মুক্তি দিন। অন্যথায় খবর আছে।’
কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেন, ‘আমি বিএনপিতে যোগদান করিনি। আমি ড. কামাল হোসেনের ঐক্যফ্রন্টে যোগদান করেছি। যদি জয়ী হতে চান তাও আপনাদের হাতে, হারতে চাইলে তাও আপনাদের হাতে।’ তিনি বলেন, ‘তারা বলে বিএনপি রাজাকারের হাতে পতাকা তুলে দিয়েছিল। এই অভিযোগ সত্য নয়। আওয়ামী লীগ প্রথম শরিষাবাড়ীর নুরুল হকের হাতে পতাকা তুলে দিয়েছে। রাজাকার মহিউদ্দিন, আশিকুর রহমানের গাড়িতে পতাকা তুলে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচন দিতে হবে হাসিনাকে। আমি বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি চাই না। কারণ খালেদার মুক্তির কোনো দরকার নেই। আমাদের চিন্তা করতে হবে, হাসিনার মুক্তি কবে হবে। বেগম জিয়া জেলখানায় গিয়ে গণতন্ত্রের প্রতীক হয়েছেন। জেলে বন্দি থেকে বাংলাদেশের কোটি মানুষের অন্তরে জায়গা নিয়েছেন। আমি জানি বাংলাদেশকে কেউ বন্দি রাখতে পারে না। তাই খালেদা জিয়াকে বন্দি রাখা যাবে না।’
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘পাঁচ বছর ধরে একটি বিনা ভোটের সরকার ক্ষমতায় আছে। এই পাঁচ বছর ধরে সরকার একটা লুটপাটের তাণ্ডব তৈরি করেছে। ব্যাংক লুট করেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক চুরি করেছে, শেয়ারবাজার চুরি করেছে, সোনা চুরি করে বাংলাদেশকে তামা বানিয়ে দিয়েছে। এই সরকার ভোটের নামে ভোট চুরি করেছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি যখন ভোট হয়, তখন কেন্দ্রে ভোটার ছিল না, টিভিতে দেখেছেন কুকুরের ছবি।’
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘সাত দফা দাবিতে দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ। প্রথম সংলাপ কোনো কাজের সংলাপ হয় নাই। আমরা আগামীকাল যাচ্ছি। আমরা কোনো ঝগড়া করতে চাই না। আমরা বলতে চাই, আগামী দিনে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে আন্দোলনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।’
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, ‘আমরা সংলাপে এখনো কোনো কিছু পাই নাই। আজকে সরকার সংলাপের মাধ্যমে, সমঝোতার মাধ্যমে না আসলে রাজপথ ও আন্দোলন ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প থাকবে না। আপনারা প্রস্তুত হোন।’
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘সরকারের উন্নয়নের জোয়ারে তাদের চোখে ছানি পড়েছে, কানে শুনতে পারে না। উন্নয়ন ও দুর্নীতির কারণে তাদের উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে গেছে। এর থেকে উত্তরণে সকলকে এক হতে হবে।’
জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়ার নেতা সুলতান মো. মনসুর আহমেদ বলেন, ‘আমরা সংলাপে আছি। আমরা জনগণকে বলতে চাই, সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না, আঙুল বাঁকা করতে হতে পারে। সকলে প্রস্তুতি নিন।’
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘এই মঞ্চে যাঁরা আছেন, তাঁরা কেউ প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা না। যারা একাত্তরে গণতন্ত্র উদ্ধারের বিপক্ষে ছিল তারা স্বাধীনতাবিরোধী ছিল। আজ যারা গণতন্ত্রের বিরোধী তারাও স্বাধীনতাবিরোধী।’
দুপুর ২টায় শুরু হয়ে সমাবেশ শেষ হয় সন্ধ্যা ৬টার পর। মূল অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে সংগীতশিল্পী মনির খান, বেবী নাজনীনসহ জাসাসের শিল্পীরা দেশাত্মবোধক গান ও দলীয় সংগীত পেরিবেশন করেন। বিকেল ৩টার মধ্যে উদ্যান কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। মানুষের ঢল উদ্যান ছাড়িয়ে মৎস্য ভবন থেকে শাহবাগ পর্যন্ত সড়কে গড়ায়।
গত ১৩ অক্টোবর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হওয়ার পর ঢাকায় এটি তাদের প্রথম জনসভা।
বিএনপির শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, আবদুস সালাম আজাদ, আমিরুল ইসলাম আলীম, জেএসডির শফিকউদ্দিন আহমেদ স্বপন ও গণফোরামের মোশতাক আহমেদের পরিচালনায় জনসভায় আরো বক্তব্য দেন জেএসডির তানিয়া রব, আবদুল মালেক রতন, এম এ গোফরান, গণফোরামের সুব্রত চৌধুরী, মোস্তফা মহসিন মন্টু, নাগরিক ঐক্যের এস এম আকরাম হোসেন, শহীদুল্লাহ কায়সার প্রমুখ।
বিএনপির ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, মির্জা আব্বাস, ড. আবদুল মঈন খান, আবদুল্লাহ আল নোমান, জয়নাল আবেদীন, আমানউল্লাহ আমান, মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, ফজলুল হক মিলন, কাজী আবুল বাশার, আহসানউল্লাহ হাসান, আফরোজা আব্বাস, সাইফুল আলম নীরব, শফিউল বারী বাবু ও রাজীব আহসান বক্তব্য দেন।
২০ দলীয় জোট নেতাদের মধ্যে বক্তব্য দেন বিজেপির আন্দালিব রহমান পার্থ, জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, কল্যাণ পার্টির সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, ইসলামী ঐক্যজোটের এম এ রকীব, খেলাফত মজলিসের আহমেদ আবদুল কাদের, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মাওলানা নুর হোসাইন কাশেমী, এলডিপির রেদোয়ান আহমেদ, বিকল্পধারার একাংশের অধ্যাপক নুরুল আমিন ব্যাপারী প্রমুখ।